(ব্রিটিশের আমদানি করা মরিশাসের সাদা চিনির সঙ্গে পরবর্তীকালে প্রতিযোগিতায় টিঁকতে না পেরে গোবরডাঙার ঐতিহ্যবাহী দলুয়া বা পাকা চিনি শিল্প ধুঁকতে ধুঁকতে অবশেষে বন্ধ হয়ে যায়। যমুনার পূর্ব পাড়ে এরকম ৮০টি চিনি কলের কথা শুনিয়েছেন সাংবাদিক সুকুমার মিত্র।)

গোবরডাঙার লালচে রঙের দলুয়া চিনি বা পাকা চিনি শুধু অভিভক্ত বাংলায় নয়, সমগ্র ভারতে সরবরাহ হতো। দেশজুড়ে ছিল সেই চিনির কদর। আর তাই এই শিল্পের রমরমায় দুই শতাব্দী আগে সম্পদশালী হয়েছিলেন বাংলার শতাধিক উদ্যোগপতি। বাংলাকে সেদিন চিনির জন্য আজকের মতো মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ কিংবা বিদেশের উপর নির্ভর করতে হতো না। গোবরডাঙায় যমুনার পূর্ব  পাড়ে ছিল ৮০টি চিনির কল। না, আখের গুড়ের প্রযুক্তি বা ব্যবহার তখনও চালু হয়নি। চিনি হতো খেজুর গুড় থেকে। আর এর কাঁচামাল, খেজুর গুড় গোবরডাঙা সন্নিহিত গ্রাম— বসিরহাট, টাকি ছাড়িয়ে আজকের বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, যশোরের নানা এলাকায় খেজুর গুড়ের হাট থেকে সংগ্রহ করা হতো। ব্যবসায়ীর দল খেজুর গুড় কিনে এনে চিনি কলে সরবরাহ করতেন। সুদুর পূর্ব বাংলার নানা এলাকা থেকে রূপসা, ভৈরব, দড়াটানা, কপোতাক্ষ‌, নাওভাঙা, কোদালিয়া, বেত্রবতী, কালিন্দী, রায়মঙ্গল, বিদ্যা, বিদ্যাধরী ধরে চারঘাটের টিপিতে এসে ইছামতী নদী থেকে যমুনা নদীতে প্রবেশ করতেন। আর এই ‘দলুয়া চিনি’-র ব্যবসায় সরগরম ছিল যমুনা। বর্তমান গোবরডাঙার রেলব্রিজ থেকে দক্ষিণে ছোট মির্জাপুর পর্যন্ত চিনি কলে এসে সেই সব হাড়ি হাড়ি খেজুর গুড় এসে মজুত হতো। গোবরডাঙার চিনিকলগুলি ছিল মূলতঃ সরকারপাড়া, কুঠিপাড়া, গয়েশপুর, ছোট মির্জাপুর গ্রামে। 

অলংকরণে দীপঙ্কর ঘোষ

কীভাবে তৈরি হতো এই দলুয়া চিনি? আমদানি করা মজুত খেজুর গুড় ভাড় থেকে, বেশ কয়েকটি ফুটো করা বড় বড় মাটির নাদায় প্রথমে ফেলা হত। তার আগে অবশ্য আগে মাটিতে গর্ত করা হতো। গুড়ের জলীয় অংশ বের করে দেওয়া হতো। সেইসব জল মাটির গর্তে জমা হতো। কোনও পাতন প্রক্রিয়ায় নয়, একেবারে দেশীয় পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক উপায়ে খেজুর গুড় থেকে জল বের করে ফেলার কাজ হতো সুক্ষ‌ ভাবে। এরপর ‘টোপা পানা’ যমুনা থেকে তুলে গুড়ের উপর দেওয়া হতো। মূলত কার্বনকে জারণ প্রক্রিয়ায় হাল্কা লালচে হলুদ রং-এ আনার জন্য। পরে সেই টোপা পানা সরিয়ে খেজুরের পাতার পাটিতে ফেলা হতো। এই অবস্থায় থাকতো  দু’সপ্তাহ। খেজুরপাতার এই পাটিগুলি গাছের ছায়ায় রাখা হতো। কড়া রোদে বা আগুনের তাপে নয়, হাল্কা রোদ-ছায়ায় গুড়টা শুকানো হতো। যমুনার দলুয়া চিনির সুখ্যাতি তখন দেশজোড়া। অষ্টাদশ শতাব্দীর কিছু আগে থেকে উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে এই কারবার রমরমিয়ে চলেছে। গোবরডাঙা থেকে যমুনা নদী পথে কলকাতার বাজারে ফড়েরা এই চিনি পাইকারি কিনে নিয়ে যেতেন। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়তো দেশের নানা প্রান্তে।

গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ-এর কর্ণধার দীপককুমার দাঁ জানালেন, এলাকার প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ ফনিভুষণ ভট্টাচার্য (যাঁর জন্ম ১.০৮.১৯০০) তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আমার তখন বয়স ৮-১০ বছর। আমরা স্কুল থেকে ফিরতাম। ফিরে কোনও মতে ভাত খেয়ে গ্রামে ঘুরে বস্তা থেকে মুঠো মুঠো চিনি খেতাম।’’ ১৯০৮-১০ থেকে এই দলুয়া চিনি শিল্পের মন্দা শুরু হয় সাদা চিনির সঙ্গে প্রতিযোগিতায়। কারণ, এর অনেক আগে থেকেই মরিশাস থেকে ব্রিটিশরা আখের রসের সাদা চিনি আমদানি শুরু করে। মরিশাসের চিনি আসার পর গোবরডাঙার দলুয়া চিনি শিল্প আস্তে আস্তে নিভতে শুরু করে। দীপককুমার দাঁ আরও জানালেন, খাঁটুরার গণেশ আঁশ সেই সময় চিনির কারবার করে তিনটি বিশাল প্রাসাদোপম অট্টালিকা নির্মাণ শুধু নয়, বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। শুধু গণেশ আঁশই নন, চিনি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত গোবরডাঙার মহাজনেরা সকলেই বিপুল সম্পদশালী হয়েছিলেন। প্রত্যক্ষ‌ ভাবে এই চিনি কলে হাজার খানেক শ্রমিক ছাড়াও আমদানি, রফতানি কারবারে আরও হাজার খানেক মানুষের কর্মসংস্থান হতো। অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ— এই তিন মাস তখন গোটা তল্লাটের শিউলিদের বিশ্রাম ছিল না। সব সময় খেজুর গাছ কাটা ও রস সংগ্রহ, গুড় জাল দেওয়ার কাজে শুধু তাঁরা নন, তাঁদের পরিবারের মানুষেরাও ব্যস্ত থাকতেন। আর একদল তৈরি করতেন খেজুরপাতার পাটি, যা চিনি শুকানোর জন্য প্রয়োজন হতো।

প্রায় এক শতাব্দী হয়ে গেল গোবরডাঙা চিনি শিল্পের সেই রমরমা দিন হারিয়েছে। তারও আগে থেকে নাব্যতা হারাতে শুরু করেছিল এই এলাকা দিয়ে বয়ে চলা যমুনা নদী। গোবরডাঙা পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুরেশচন্দ্র মিত্র যমুনা পারের ১০০টি গ্রামের মানুষকে সংগঠিত করেছিলেন যমুনা সংস্কারের দাবিতে। সেটাও উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার কথা।

নদিয়ার চাকদহ স্টেশনের পূবদিকে খোজারহাট। এর দক্ষিণে প্রদুম্ন হ্রদ। এই হ্রদের দক্ষিণে ত্রিবেণী। এখান থেকেই যমুনা নদীর উৎপত্তি।  এরপর যমুনা নদীয়ার বালিয়ানি, চাঁদমারী, মদনপুর, চণ্ডিরামপুর, বিরহী, হরিণঘাটা, সুবর্ণপুর, মোল্লাবেনিয়া, গোপালনগর, চৌবেড়িয়া অতিক্রম করে গাইঘাটায় প্রবেশ করেছে। গাইঘাটার ঘোঁজা, জলেশ্বর, ইছাপুর, নাইগাছি, মল্লিকপুর, বেলেনি,  গৈপুর,গোবরডাঙ্গা, গয়েশপুর হয়ে স্বরূপনগরের চারঘাটের মোল্লাডাঙ্গার উল্টোদিকে টিপিতে ইছামতী নদীতে মিশেছে যমুনা। এই মিলিত ধারাটি কালিন্দী, রায়মঙ্গল হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। মধ্যযুগে এতদঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ নদী ছিল যমুনা। ইংরেজ আমলে কাঁচরাপাড়ার কাছে বাগের খাল দিয়ে হুগলি নদীর জল যমুনায় ঢোকানোর চেষ্টা হয়েছিল। যমুনার উৎস মুখে প্রবাহ টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টাও বেশী দিন বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। বাগের খালের মুখে হুগলি নদীতে তৈরি স্লুইস গেট দিয়ে যমুনা সারা বছর কোনও জল না পাওয়ায় যমুনা ক্রমশ তার নাব্যতা হারাচ্ছে। বর্তমান কাঁচরাপাড়া(কাঞ্চনপল্লি) উত্তরে নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্তে অবস্থিত বাগের খালই যমুনার স্রোতরেখার শেষ চিহ্ন। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় বাগের খাল আজ লুপ্তপ্রায়। যমুনা পথেই সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কাঁঠালপাড়া থেকে চৌবেড়িয়ায় দীনবন্ধু মিত্রের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন।

উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরের চারঘাটের কাছে যমুনা

যমুনা এখন খালের রূপ নিলেও ১৭৬৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মেজর রেনেল সাহেব তাঁর অধীনস্থ কর্মচারী উইলিয়াম রিচার্ডকে সঙ্গে নিয়ে জরিপ কাজের জন্য দমদম থেকে ক্রমশ উত্তর দিকের সড়ক ধরে বনগাঁ পর্যন্ত এক সমীক্ষা করেছিলেন। রেনেল যমুনাকে একটি নাব্য নদী বলে বর্ণনা করেছেন। যমুনা নদী তিনি নৌকা যোগে অতিক্রম করেছিলেন বলে তাঁর প্রতিবেদনে বর্ণনা করেছেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে যাত্রিবাহী লঞ্চ সার্ভিস চালু হয় টাকী ও গোবরডাঙ্গার মধ্যে যমুনা নদীর মাধ্যমে। এরপর ১৮৬৭ সালের ১ নভেম্বরে এক আকস্মিক জলোচ্ছ্বাসে ১২ ফুট পর্যন্ত জল বেড়ে যাওয়ায় কালিন্দীর জোয়ার যমুনায় প্রবেশ করে যমুনাকে ভরাট করে দেয়। এর ফলে যমুনা কালিগঞ্জের দক্ষিণে একেবারে মজে যায়। কোথাও কোথাও দূর থেকে দেখলে সবুজ গালিচা বলে ভুল হতেই পারে। তবে এটিই হল গাইঘাটার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদী। একদা খরস্রোতা নদীটি বহু অযত্নে নাব্যতা হারিয়ে মজে যেতে বসেছে। অথচ, বাদুড়িয়া নিবাসী মনসামঙ্গলের কবি বিপ্রদাস পিপলাই ১৪৯৫ সালে লিখেছিলেন, ‘গঙ্গা আর সরস্বতী যমুনা বিশাল অতি।’ ধোয়ীর পবনদূতে যমুনার উল্লেখ আছে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকেও এই যমুনা ছিল স্রোতস্বিনী নদী। বাংলার দুর্ভাগ্য, সড়ক ও রেল যোগাযোগের জন্য শেরশাহ-র আমল থেকে নদীগুলির উপরে বিশেষ করে যমুনা নদীর উপরে বাঁধ দেওয়া শুরু  হয়। ফলে যমুনা ক্ষীণস্রোত হয়ে ধীরে ধীরে মজে যেতে থাকে। সড়ক ও রেলপথে পরিবহন যতই প্রসারিত হতে থাকে, হারাতে থাকে নদীপথের গুরুত্ব।  ধীরে ধীরে অবহেলা ও উপেক্ষায় যমুনাও কোনও মতে তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। যেমন গোবরডাঙার গয়েশপুর, সরকারপাড়া, কুঠিপাড়া, ছোট মির্জাপুরে মাটির গর্ত, পুকুর খনন করতে গেলেই আজও উঠে আসে প্রায় দেড়- দুই শতাব্দীর আগের খেজুর গুড়ের মাটির হাড়ির অংশগুলি। মনে করিয়ে দেয় এই এলাকায় দলুয়া চিনির সমৃদ্ধশালী ইতিহাস।