রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছেই। থামার নাম নেই। ব্যর্থ কূটনীতি, গোটা দুনিয়ার রাষ্ট্রনায়কেরা বিভক্ত কয়েকটি শিবিরে। এরই মধ্যে যুদ্ধ থামাতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে আবেদন করেছেন রাশিয়ার ফুটবল, টেনিস খেলোয়ারেরা। খেলোয়ারদের সেই আর্জি কি পারবে যুদ্ধ থামাতে? দেখে নেওয়া যাক, অতীতে বিভিন্ন সময়ে খেলাধূলা কী ভাবে যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছে…। কী ভাবে খেলোয়ারদের তুমুল জনপ্রিয়তা সম্ভব করে তুলেছে অসম্ভবকে। সেগুলি একেকটি চিত্তাকর্ষক কাহিনী। আজ যা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে…।

কারও ঢোকার অনুমতি নেই সেই দেশে। রুদ্ধদ্বার। উত্তর কোরিয়া। তবুও অনুমতি পেয়েছিলেন আমেরিকার বাস্কেটবল খেলোয়াড় ডেনিস রডম্যানের নেতৃত্বে থাকা একটি দল। হ্যাঁ, কিম জং উনের মতো স্বৈরশাসকেরাও খেলাধুলাকে অগ্রাধিকার দেয়। বোঝা যায়, কী ভাবে খেলাধুলা শান্তির চাবিকাঠি হতে পারে।

১৯১৪ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে! ফ্রান্সের সীমানায় যুযুধান দুই পক্ষ। চারদিক রক্তাক্ত! পরিখার ভিতরে ভেজা, কর্দমাক্ত মেঝেতে সারিবদ্ধ মৃতদেহ। দু’দিনের বিরতি। যারা বেঁচে ছিলেন, তাঁরা খাচ্ছিলেন না। ঘুমোচ্ছিলেন না। ফুটবল খেলছিলেন! হ্যাঁ, দু’পক্ষ মিলিত হয়ে ফুটবল খেলছিল। ফুটবল হিংসার অবসান ঘটিয়েছিল সেদিন। এ কাজ অন্য কেউ পারে না।  ব্যাপারটা ছিল সাময়িক। কিন্তু   বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে ফুটবল ভয়ঙ্কর শত্রুদেরও একত্রিত করেছিল।

সালটা ১৯৬৭। নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। ১৯৬৭ সালের মে মাসে বিয়াফ্রা প্রদেশ নাইজেরিয়া থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেদের স্বাধীন দেশ ঘোষণা করেছে। বিয়াফ্রা হল নাইজেরিয়ার তেলের ভাণ্ডার। আর সেই ঘোষণার পর থেকে শুরু হল নাইজেরিয়া ও বিয়াফ্রার এক ভয়ঙ্কর লড়াই। কেউ কাউকে ছাড়ার পাত্র নয়। প্রায় দু’বছর চলছে সেই লড়াই। সে সময় নাইজেরিয়া সরকারের অনুরোধে ব্রাজিলের বিখ্যাত সান্টোস  ক্লাব এসেছিল প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলতে। সেই দলে ছিলেন পেলে। নাইজেরিয়াবাসীকে পেলে আহ্বান জানালেন, যুদ্ধ থামান। যুদ্ধ মানুষের কোনও উপকার করে না। সত্যি, সেদিন থেমে  গিয়েছিল যুদ্ধ । যতক্ষণ পেলে আর সান্টোস  ক্লাব নাইজেরিয়ায় ছিল, ততক্ষণ  যুদ্ধবিরতি ছিল সে দেশে। ওই খেলায় সান্টোস ২ গোলে হারালো নাইজেরিয়ার ‘সুপার ঈগল’ টিমকে।

২০০৪ সাল আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি আবেদন করেছিল, যে ১৬দিন ধরে অলিম্পিক চলবে সেই সময়ে যুদ্ধ বন্ধ থাক। সেই দিনগুলিতে থেমে গিয়েছিল ইরাক-আমেরিকার যুদ্ধ।

তাই যুদ্ধ থেমে যায়! বার বার। কখন নাইজেরিয়ায় ,কখন গাবোনে আবার কখনও আইভরি কোস্টে।

আমাদের সকলেরই প্রিয় ফুটবলার দিদিয়ের ড্রগবা। আইভরি কোস্টের স্ট্রাইকার ছিলেন তিনি। তবে মানুষ তাঁকে চেনে চেলসিকে প্রথমবার ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ জেতানোর নায়ক হিসাবে। দিদিয়ের দারুণ একটি রেকর্ড রয়েছে। একটানা দশটি ফুটবল ফাইনালে গোল করেছেন তিনি। অনেকে বলেন, তাঁর মতো বড় ম্যাচ প্লেয়ার খুব কমই এসেছে।  ৮ অক্টোবর ২০০৫।  সুদানের সাথে খেলা চলছিল আইভরি কোস্টের। যে সে খেলা নয়,  বিশ্বকাপে যোগ্যতা নির্ণয়ের লড়াই। এদিকে, ২০০২ সাল  থেকে আইভরি কোস্টে চলছিল গৃহযুদ্ধ । খেলা শুরুর আগে দিদিয়ের দেশবাসীর উদ্দেশে আবেদন জানালেন,  ‘‘আজ আমাদের সমর্থন করুন। দেশ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এই ম্যাচ জিতলে আমরা বিশ্বকাপে যাওয়ার ছাড়পত্র পাবো।’’ ব্যাস, দিদিয়ের আহ্বানে তাঁর দেশের  যে যেখানে ছিল, যুদ্ধ  থামিয়ে বসে পড়ল খেলা দেখতে। আইভরি কোস্ট সে দিন ৩-১ গোলে হারিয়েছিল সুদানকে। নায়ক সেই দিদিয়ের ড্রগবা। খেলার শেষে এক টিভি সাক্ষাৎকারে দিদিয়ের আবার আবেদন  জানালেন তাঁর দেশের মানুষকে—অস্ত্র ফেলে দিন, ভোটে লড়ুন! যে দেশে এত সম্পদ, সেখানে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ হবে কেন?

দিদিয়ের ঘরের ছেলে, দেশের মানুষের হিরো। তাঁর কাতর আবেদন দেশের মানুষের মন ছুঁয়ে গেল। না, আর যুদ্ধ নয়। ৮ই অক্টোবর ২০০৫। আইভরি কোস্টের ইতিহাসে রেড লেটার ডে। যুদ্ধ থামিয়ে যুযুধান দুই পক্ষ রাজি হয়েছিল গণতন্ত্রের পথে ফিরে  আসতে।

আজ রাশিয়া-ইউক্রেনের লড়াইয়ের মধ্যে যুদ্ধ থামানোর সেই ইতিহাস প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। সেই ম্যাজিক কি দেখা যাবে আবারও?