অপূর্ব সাহা
এডওয়ার্ড লীয়রের ননসেন্স লিমেরিক কিংবা সুকুমার রায়ের আজগুবি ছড়ায় হামেশাই অদ্ভুত প্রাণীর দেখা মেলে। সুকুমার রায় কল্পনাপ্রবণ শিশুদের সামনে যেমন বকচ্ছপ, হাঁসজারু, হাতিমিদের রেখাচিত্রে হাজির করেছেন, লীয়রও তেমনই কারুর লম্বা দাড়িতে পাখির বাসা বা দীর্ঘ নাকে প্যাঁচ দেওয়া মানুষ দেখিয়েছেন শিশুদের।
পিছনের দিকে তাকালে অতীতেও এর নজির রয়েছে। পুরাণে মকরের রূপ কল্পনা করে তাকে তত্ত্বের মোড়কে, ভক্তির আসনে বসিয়েছেন ধর্মপ্রাণ জনতা। পুরাণ অনুযায়ী, মকর হল গঙ্গা দেবীর বাহন। কুমিরের মতো করাতমুখো, লেজ মাছের মতো আর বাকি শরীরটা যেন বা হাতির।
কোনও কোনও মকর মূর্তিতে মুখের উপরিভাগে হাতির শুঁড়ও কল্পিত হয়েছে। ক্ষুরধার দাঁত আর ভয়ানক পুচ্ছের কারণে মকরকে পশুরাজ সিংহের অনুকরণে জলরাজ বলা হয়ে থাকে। বৈদিক দেবতা বরুণের বাহন রূপেও মকরের উল্লেখ পাওয়া গেছে। মকর আসলে কামশক্তি।
সেকারণে কাম দেবের আর এক নাম মকরধ্বজ। মকরকে তিনি ধ্বজায় তুলে রেখেছেন। অন্যদিকে প্রবল শক্তিসম্পন্ন মকরের অবস্থান গঙ্গার পদতলে। গঙ্গার শরণাগত হলেই মুক্তি বা মোক্ষলাভ সম্ভব। তিনিই মকর বা কামশক্তির প্রশমন ঘটাতে পারেন। কাম হয়ে উঠবে নিষ্কাম।
এ প্রসঙ্গে ‘দেবদেবী ও তাঁদের বাহন’ গ্রন্থে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। মকরকে সেখানে মুমুক্ষু জীব হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। “মকরের আদ্য অক্ষর ম। এই ম-কারই গঙ্গার মকর। কামধেনু তন্ত্রে স্বয়ং ম-কারকে বলা হয়েছে পরমকুণ্ডলী, তরুণাদিত্যসঙ্কাশ, চতুর্বর্গ প্রদায়ক, পঞ্চদেবময় ও পঞ্চপ্রাণময়।” তাই ম-কার তথা মকর এক মহাশক্তি। মুক্তিপিপাসু সাধক যেমন কাম নিয়ন্ত্রণ করে দেবত্ব লাভের আশা করে; বিপুলা গঙ্গার আশ্রয়ে বিলীন হয়ে মকর স্বয়ং সেই শিক্ষা দেয়।
মকর সংক্রান্তি থেকে সূর্যের উত্তরায়ণ আরম্ভ হয়। উত্তরায়ণের পথ চির আলোকজ্জ্বল। সেই পথে আজও হাঁটেন অসংখ্য মুক্তিপথযাত্রী। মকর ভাবনায় যার সূচনা।
অলংকরণ – রাতুল চন্দরায়