(আজ থেকে বেশ কয়েক দশক আগে কেমন ছিল উদ্বাস্তু-অধ্যুষিত অশোকনগরের আড্ডা? হারিয়ে যাওয়া সেই সব ঠেকের সোনালি দিনগুলির কথা শুনিয়েছেন সাংবাদিক সুকুমার মিত্র।)

বাঙালির চায়ের দোকানে আড্ডা অনেকটাই জিনঘটিত। সেই আড্ডায় রাজনীতি থেকে ঘরোয়া কেচ্ছা— সব ধরনের বিষয়ে তর্কের তুফান। আর এর অণুঘটক হল চায়ের কাপ। শেয়ারে বিড়ি, সিগারেটে টান। পেটে টান ধরলে মুড়ি, সিঙাড়া ও তেলেভাজা। কলকাতা, মফস্বল শহরের জীবনে তো বটেই, গ্রাম বাংলায় চায়ের দোকানের ঠেক সাধারণত নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের নিত্য জীবনের নানা সমস্যা জর্জরিত অবস্থার মাঝে কিছুটা স্বস্তি এনে দিত। তবে এর চেয়ে ঢের গুরুত্বপূর্ণ হল এই সব ঠেকের তর্কবিতর্ক থেকে গল্প, উপন্যাস, কবিতা রচনার রসদ, ছবি আঁকার বিষয় সমঝদারেরা দু’হাতে কুড়িয়েছেন। চুটিয়ে আড্ডার মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন, গ্রুপ থিয়েটার, সাংস্কৃতিক সংস্থা, সিনে ক্লাব, বিজ্ঞান সংস্থা থেকে ফুটবল, ভলিবল, ক্যারাম, দাবা, অকশন ব্রিজ প্রতিযোগিতা। আড্ডার কুশীলবেদের অনেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে গভীর মনস্কও ছিলেন। রম্য-রসিকতার ছলে অনেক সমকালীন বিষয় নিয়ে একজন একটু উস্কে দিয়ে চুপ। বাকিরা সেই বিষয় নিয়ে তুলছেন বির্তকের তুফান। আড্ডা শেষে সিদ্ধান্ত— এই বিষয় নিয়ে একটা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করতে হবে। অথবা একজন বিশেষজ্ঞ বক্তা এনে আলোচনা সভার আয়োজন। সিদ্ধান্ত কার্যকরী না হওয়া পর্যন্ত ঠেক তখন অনেকটাই সিরিয়াস হয়ে উঠেছে। এটাই তো ছিল বাঙালির আড্ডা জীবনের রোজনামচা।
উত্তর চব্বিশ পরগণার উদ্বাস্তু নগরী অশোকনগরের গত সাড়ে সাত দশকের আড্ডার ঠেকগুলি থেকেই বহু কর্মকাণ্ড সফল ভাবে ঘটেছে। তবে শুধু চায়ের দোকান বা বইয়ের দোকান নয়, মিষ্টির দোকান, ঘুঘনির দোকান, বিড়ির দোকান থেকে শুরু করে ক্লাব চত্বর, ক্লাব লাইব্রেরি, স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের দফতর থেকে পোল্ট্রি অ্যাসোশিয়েশনের দফতরে কৈশোর, যৌবনে দেখা আড্ডার মানুষগুলির মুখ স্মৃতিপটে এখনও জ্বলজ্বল করে। ধীরে ধীরে বাজার অর্থনীতির থাবায় কি না জানি না তবে টেলিভিশনে নানা চ্যানেলের বাড়বাড়ন্ত আর মোবাইল চ্যাট— বাঙালির আড্ডা জীবনের বড় সর্বনাশ করেছে, আমার পর্যবেক্ষণ অন্তত সেরকমই। ঘুরে আসা যাক ষাট-সত্তর-আশির দশকে অশোকনগরের আড্ডার সেই সোনালি দিনগুলিতে—

চৌরঙ্গীর নানা ঠেক

চৌরঙ্গীতে অনিল দে’র মিষ্টির দোকান ‘অমৃতায়ন’অশোকনগরে আড্ডার সবচেয়ে বড় ঠেক। মিষ্টির দোকান হলেও মূলত চায়ের জন্য খ্যাত ছিল এই দোকানটি। দোকানটির সুর্বণজয়ন্তী বর্ষে সবচেয়ে সর্বনাশা কাজটি করেছেন মালিক। সিদ্ধান্ত নিয়ে চা বিক্রি বন্ধ করে দিলেন। উঠে গেল আড্ডার সবচেয়ে বড় ঠেকটি। দোকানের সামনে সারি সারি কাঠের বেঞ্চগুলি তুলে দেওয়া হল। অথচ ওই একেকটা বেঞ্চে এক এক দল যুবক, প্রৌঢ় ও প্রবীণদের পর্যায়ক্রমিক আড্ডা। তোলপাড় আড্ডা থেকে নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আড্ডাবাজ মানুষগুলো। টানা ৫০ বছর এই চায়ের দোকানে দিনে কতবার চা খেতে ছুটে আসতেন কবি সত্য গুহ, তার কোনও হিসেব নেই। চা বিক্রি বন্ধ করায় ওই দোকানের মালিকের উপর ক্ষোভ উগরে সত্যদা বলতেন— সর্বনাশ করে দিল অনিল দে। সত্যদা ওই দোকানের বিপরীতে জামাই (রমেশ)-এর চায়ের দোকান ও পরে রায় ফার্মেসির সামনে কালভার্টকে ঘিরে একটা ভ্যান রিক্সার ওপর চায়ের দোকানে আশ্রয় নিলেন। সত্যদার নিত্য আড্ডার সঙ্গী ছিলেন অবনী ধর ও জীবন সাহা। তবে অমৃতায়নে চায়ের দোকানে আড্ডায় যোগ দিতে পুর-এলাকার নানা প্রান্ত থেকে তো বটেই পার্শ্ববর্তী গ্রামের রসিকজনেরা এসে ভিড়তেন। তেমনি হাবড়ার আড্ডাবাজ কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরাও অশোকনগর চৌরঙ্গী মোড়ের আড্ডার ঠেকে ছুটে আসতেন। সকালে যে বেঞ্চগুলিতে একদল যুবক চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে ঘরে ফিরেছেন বিকেলে তারই দখল নিয়েছেন প্রৌঢ় ও প্রবীণ আড্ডাবাজেরা। এক বেঞ্চে কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুগামীরা তো পাশের বেঞ্চে বিপরীত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর খোলামেলা আড্ডা। কোনও বেঞ্চে হাংরি জেনারেশনের আড্ডা। কেউ কারও আড্ডায় নাক গলাচ্ছেন না। তবে মাঝে মাঝে টিকা-টিপ্পনি চলতো সৌজন্য ও শালীনতা বজায় রেখেই।

চৌরঙ্গী ও অমৃতায়ন

সত্তরের দশকের উত্তাল দিনগুলিকে বাদ দিলে স্বাধীনতার পর থেকে নব্বই-এর দশক পর্যন্ত অনিল দে’র মিষ্টির দোকানের আড্ডা ছিল বাহারি ও বহরে বড়। দুপুরের স্কুল টিফিনের সময় অমৃতায়নে সিপিআই-এর অনুগামী শিক্ষকরা চা খেতে এসে ছোট্ট একটা দ্বিপ্রাহরিক আড্ডা দিয়ে ক্লাসে যোগ দিতেন। উল্টোদিকে ছাত্র সংঘ ক্লাবের সদস্যদের কয়েকজনকে নিয়ে অবনী ধর ছিলেন আড্ডার মধ্যমণি। তবে সেই আড্ডা ছিল মূলত তাস খেলাকে ঘিরে। পরে অবনী ধর, বাসুদেব দাশগুপ্তদের আড্ডায় হাংরি জেনারেশন।
চৌরঙ্গী মোড়ে এখন যেখানে ননী করের পূর্ণাবয়ব মূর্তি, সেখানে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সুভাষদা(বসু), মেনাদা, সুর্দশনদাদের দল পর্যায়ক্রমে আড্ডা দিতে ছুটে আসতেন। এঁদের নির্দিষ্ট কোনও দোকানের ঠেক ছিল না।
চৌরঙ্গী মোড়ে নান্টুদার (প্রবোধ ব্যানার্জি) বইয়ের দোকান পরিবেশ-কে ঘিরে বিদগ্ধজনদের আড্ডা ছিল। সেই আড্ডায় সত্য গুহ, অজিত দুবে, বীরেন্দ্রনাথ নিয়োগী, জীবন সাহা, স্বদেশ রায়, সমরেন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দাস, ডাঃ সাধন সেন, দুলু চন্দ, সুব্রত সাহা, সুবোধ দাস, অনিল দে- সহ অনেকেই যোগ দিতেন।
চৌরঙ্গীতে মলয় ভট্টাচার্যের ডেকরেটর্সের দোকানের মধ্যেই বেশ কিছু দিন চলেছিল সাংস্কৃতিক সংস্থার অফিস। সেই অফিসকে ঘিরে আড্ডায় দুলু চন্দ, সুব্রত সাহা, দয়াল দাশগুপ্ত, বোটন রায়, মলয় ব্যানার্জি, মন্টু সাহাদের ঘিরে আড্ডায় আসতেন একদল সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্পী, সাহিত্যিক, কবিরা। পরে পরেশ রায়ের দোকানে স্থানান্তরিত হয় সাংস্কৃতিক সংস্থার দপ্তর। সাংস্কৃতিক সংস্থার রমরমা কয়েক বছর থাকলেও পরেশ রায়ের দোকানের দফতরটি কিন্তু তার আগেই ছেড়ে দিতে হয়। ফলে সারা বছর ধরে আড্ডার ওই ঠেকটা উঠে যায়। চৌরঙ্গীতে রেমিডি ওষুধের দোকানে স্বদেশ রায়, সুকুমার মৈত্র, অনিল মৈত্র, বীরেন্দ্র নিয়োগী, জীতেন সান্যালদের আড্ডা ছিল। সেই সময় ডাঃ সাধন সেন বিকেলে চৌরঙ্গীর রেমিডিতে চেম্বার করতেন।
চৌরঙ্গী মোড়ে নাগরিক সমিতির অফিসের আড্ডায় কানু রায়, গোবিন্দ কুণ্ডু, প্রমোদ ঘোষ, স্বদেশ রায়, সুবোধ দাস, পবিত্র ঘোষ দস্তিদার, অমর দাশ শর্মা, বিজন সেন, অসীম চ্যাটার্জি সহ বহু মানুষ নিয়মিত ভিড়তেন। এছাড়া, চৌরঙ্গী মোড়ে ভেটারেন্স ক্লাবে তুষার দাস, দেবুদা-সহ অনেকেই আড্ডা দিতেন। সবার নাম এখন স্মরণ করতেও পারছি না। তবে ওই আড্ডা উঠে যায়, উঠে যায় ভেটারেন্স ক্লাবও। আড্ডা বলতে তাস খেলাকে ঘিরে যতটুকু।
অশোকনগরে তখন ঘরে ঘরে পোল্ট্রির কারবার। গড়ে উঠেছিল পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন। চৌরঙ্গীতে পোল্ট্রির কারবারের পাশপাশি পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের রমরমা আড্ডা ছিল বিজনদাকে ঘিরে। ৮ নম্বরের অরুণ দাসের পর বিজনদার চার চাকা গাড়ি ছিল। কলকাতায় রোগী নিয়ে যাওয়ার জন্য বিজনদার গাড়ি খুব কাজে লাগত। পরে পোল্ট্রি ব্যবসা ক্রমশ উঠে যায়। কার্যকারিতা হারায় অ্যাসোসিয়েশন। আড্ডার ঠেকও উঠে যায়।
চৌরঙ্গী মোড়ে বাসু ভট্টাচার্যের চশমার দোকান— ভট্টাচার্য অপটিক্যালের সামনে সবুজ ঘাসে বসে চুটিয়ে আড্ডা দিতেন শ্যামল কুণ্ডু, সন্তুদা, শেখর মৌলিক, সুনীল ধর, দুলু দাশগুপ্ত, চিন্ময় চক্রবর্তী, প্রদীপ দাস, নানুদা, মহারাজদারা। তাঁরা এখন কে, কোথায় কে জানে!
অশোকনগরে সিনে ক্লাবকে ঘিরে আড্ডা দিতেন অশোক দত্ত, শ্যামল ভট্টাচার্য, মলয় ব্যানার্জী, তপন গুপ্ত, সুভাষ ভদ্র, পিনাক বিশ্বাস। তাঁরা চৌরঙ্গী মোড়ে চশমার দোকানের সামনের মাঠে ও কচুয়া মোড়েও আড্ডা জমাতেন। সকালে চৌরঙ্গী মোড়ে আড্ডা হলে বিকেলে কচুয়া মোড়ে। সময়টা আশির দশক।
চৌরঙ্গী মোড়ে এ.এস.এ (অশোকনগর স্পোর্টস অ্যাসোশিয়েশন) অফিসে জমজমাট আড্ডা বসতো। ফুটবল মরসুমে তিনটি মাঠে খেলা পরিচালনা করা নিয়ে নানা সমস্যার মধ্যেও আড্ডা সেখানে হারিয়ে যায়নি। অশোকনগরে তখন নেই নেই করে দুটো ফুটবল লিগ, দুটো শিল্ড, ক্রিকেট লিগ, ভলিবল লিগ, ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করত এ.এস.এ। পাশাপাশি, অশোকনগরে এক দল প্রশিক্ষিত রেফারি ছিলেন। যাঁরা তিনটি মাঠে একই সময় লিগ ও শিল্ডের খেলা পরিচালনা করেছেন। এই রেফারি গঠনের কারিগর ছিলেন সন্তোষ সেনশর্মা।
গোলবাজারে দুরন্ত মেজাজে
আপ্যায়ন- মিষ্টির দোকানে সবচেয়ে বড় আড্ডা। সকাল সাতটা থেকে বেলা দশটা, আর বিকেলে পাঁচটা থেকে রাত দশটা গড়িয়ে যেত আড্ডায়। রবিবার তো আরও জমজমাট। সেখানে কেশব গাঙ্গুলি, সত্য রায়, কল্যাণ তালুকদার, কুমুদ সরকার, সুশীল দাশগুপ্ত ছিলেন নিয়মিত আড্ডাবাজ। আড্ডার অন্যান্য সদস্য ছিলেন প্রভাত সান্যাল, কানু দাশগুপ্ত, সুশীল দাশগুপ্ত, অরুণ দাস, কালি সিংহ, অমল ভট্টাচার্য, মেদিনীমোহন চৌধুরী, তুলসী রায়চৌধুরী, নীহার দাস, নিখিল দাস, টুলু বসু, বুলু বসু, সত্য রায়, অনিল কর। তবে এঁদের পাশাপাশি অমিয় দেওয়ান, সঞ্জীব রায়চৌধুরীরাও কিছুক্ষণের জন্য পাশের টেবিলে বসে আড্ডা দিয়ে যেতেন। আপ্যায়নে কংগ্রেসিদের আড্ডায় মাঝে মাঝে আলোচ্য হয়ে উঠতেন সিপিএমের একনিষ্ট কর্মী আপেল পাল। বাংলা কংগ্রেসকে সামনে রেখে বামেরা দ্বিতীয়বার রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করেছে। সালটা ১৯৬৯। বামেদের তখন রমরমা। সিপিএমের আপেল পাল তখন সেই সুবাদে বেশ গরম। আপ্যায়নে কংগ্রেস কর্মীদের আড্ডায় বসা মানুষগুলি অনেকটাই ম্রিয়মান। আপেল পাল এসে বললেন, ‘আমাকে যদি কংগ্রেস ভারতের রাষ্ট্রপতি করতে চায় তাইলেও আমি কংগ্রেস করুম না’। সেই কথা শুনে নিখিল দাস ফোড়ন কাটলেন, ‘ও আপেল কস কি, তুই অতো ছোট একটা পদের কেন দায়িত্ব নিবি?’

গোলবাজারের আপ্যায়ন

গোলবাজারে ২ নম্বর গেটে মধু মালঞ্চ-চায়ের দোকানে ছিল একটা আড্ডা। মূলত সিপিএম অনুগামীরা ওই দোকানে আড্ডায় ভিড় দিতেন। ওই চায়ের দোকানে রাত ন’টার পর বাণী অপেরার যাত্রার মহড়া হতো। আড্ডা ও যাত্রার মহড়া মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত।
গোলবাজারে কালীতারা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে একটা আড্ডার ঠেক ছিল। এলাকার নকশাল নেতা ঠাকুর দাস সহ মূলতঃ নকশালপন্থীদের আড্ডার ঠেক ছিল সেটা। পরে সেই দোকান বন্ধ হয়ে যায়। অনেক বছর পরে রকমারি সুইটস হিসেবে ফের চালু হয়। সেখানেও জনা দশেকের জমজমাট আড্ডা বসত। তবে সেই দোকানও বন্ধ হয়ে যায়, আড্ডারও ইতি সেখানে।
কচুয়া মোডে ভরপুর আড্ডা
সিপিআই-এর পার্টি অফিস পরে বৈদ্যনাথদার বিড়ির দোকান ঘিরে মূলত সিপিআই অনুগামীদের একটা ভাল আড্ডার ঠেক ছিল। সেখানে বৈদ্যনাথদা ছাড়াও প্রশান্ত সরকার, বিশ্বনাথ দাস, জয়দেব কর্মকার, শ্যামলেন্দু দে, স্বপন গুপ্ত, রতন চক্রবর্তী, চয়ন দত্ত, কমল ভট্টাচার্য, মণীষী নন্দীরা যোগ দিতেন। সিপিআই অফিস হলেও এখানে মূলতঃ আড্ডাই হতো। রাজনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি চলতো নানা বিষয়ে হাসিমস্করা।
৮ নম্বর কালীবাড়ি মোড়ে
মিহির পালের দোকানে অমিয় দেওয়ান, তুষার দাস, মিহির পাল, শ্যামল কুণ্ডুরা আড্ডা দিতেন। মূলত এ.এস.এ-র সঙ্গে যুক্ত ব্যাক্তিদের আড্ডায় জমে উঠত ওষুধের দোকান। মিহির পাল নিজেও একজন ভাল ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। যুক্ত ছিলেন এ.এস.এ-র সঙ্গে।

আট নম্বর মোড় আর মিহিরদার ওষুধের দোকান

শেরপুর মোড়ে আড্ডা
সাধন ঘোষ, বদ্যি, ভুপাল, আত্মজিৎ, কানু-এই ‘পঞ্চ পাণ্ডবে’র আড্ডা ষাটের দশকের শেষের বছর পাঁচেক ছিল রমরমা। এঁদেরকে ঘিরে বৃত্তটা ছিল অনেক বড়। তারপর ‘পঞ্চ পাণ্ডবে’র দলের রমরমার দিন স্থায়ী হল না। কিন্তু আত্মজিৎ চৌধুরী পরবর্তী কালে শেরপুরে আড্ডার ঠেক থেকে গড়ে তুললেন ‘জনযুগ সাংস্কৃতিক সংস্থা’। জনযুগকে ঘিরে একদল যুবক-যুবতীদের বছরভর কর্মকাণ্ড থাকত। জনযুগের সেই স্বর্ণযুগ এখন আর নেই। কিন্তু জনযুগ থেকে বেরিয়ে তাপস ব্যানার্জি গড়ে তুললেন হেমাঙ্গ সাংস্কৃতিক সংস্থা।
৩ নম্বর স্কিম গণেশ ভাণ্ডারে
আজকের স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকায় নকশালপন্থীদের একটা আড্ডার ঠেক ছিল। সেই আড্ডায় সব সময় বিপ্লবী আলোচনায় মগ্ন থাকতেন তাঁরা। একবার সেই আড্ডার ঠেকের উল্টোদিকের দেওয়ালে লেনিনের উক্তির উধৃতি দিয়ে সিপিআই একটা দেওয়াল লেখে- ‘অতি বিপ্লবী বুলি ক্রমাগত উচ্চারণ করা একটা চুলকানি রোগ–ভি.আই. লেনিন।’ আগুণে ঘৃতাহুতির মতো হল। গণেশ ভাণ্ডারের আড্ডাবাজরা ধরেই নিলেন তাঁদের উদ্দেশ্যে এটা লেখা হয়েছে। মজার বিষয় হল, কমরেড লেনিনের উক্তি হলে কি হবে, ওই দেওয়াল মুছে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। কিছুটা কাজও হয়েছিল। জোরে জোরে বিপ্লবী কথা বলার অভ্যাসটা তাঁরা পাল্টানোর চেষ্টা করেছিলেন।

গনেশ ভান্ডার মোড় বাঁদিকে সেই গনেশ ভান্ডার (অন্য নামে )

বিল্ডিং মোড়ে হইচই
নটরাজ সিনেমা হলের (আগের নাম চিত্রালি) রাস্তায় ঢুকতে ডান হাতে তিমির চক্রবর্তী চায়ের দোকান ও সাইকেল গ্যারেজে হাবড়া শ্রী চৈতন্য কলেজ ও কমার্স কলেজের ছাত্রদের আড্ডা হতো। আশির দশকের প্রথমে তিমির চক্রবর্তী কমার্স কলেজের ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি। ফলে চায়ের দোকান কার্যত ছাত্র সংসদের অফিস হয়ে উঠেছিল। তবে সেই আড্ডায় মূলত ছাত্র পরিষদের একটা গোষ্ঠীর সদস্যরা সামিল হতেন। অন্য ছাত্র রাজনীতি করলেও আমার উপস্থিতি তাঁদের কাছে একান্ত জরুরি ছিল।
তিমিরদার চায়ের দোকানের ঠেক থেকে আমি আর টিংকু (অসীম ব্যানার্জি) অধ্যাপক তারেন্দ্রচরণ ভট্টাচার্যকে সভাপতি করে গঠন করলাম স্টুডেন্টস্ ওয়েলফেয়ার কমিটি। আমরা দু’জনে যুগ্ম সম্পাদক। একদল ছাত্র যোগ দিল আমাদের কমিটিতে। টানা চার বছর অশোকনগর-কল্যাণগড় পুর এলাকার ১৮০-২০০ জন অতি দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের সমস্ত নতুন পাঠ্য পুস্তক বছরের শুরুতে শেরপুর মাঠে অনুষ্ঠান করে তুলে দেওয়া হতো। পরে আমরা ফ্রি কোচিং চালু করি। এই কর্মকাণ্ডকে ঘিরে তিমিরদার চায়ের দোকানে আড্ডা আরও জমে উঠল। তবে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বি.টি. কলেজ মোড়ে মেজদার চায়ের দোকানকে ঘিরে আমাদের আড্ডা ছিল। সেই আড্ডায় বাসুদেব গুহ ঢুকে আমাদের নিয়ে গেলেন ৫ নম্বর স্কিমে ফ্রি কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেওয়ার জন্য। বাসুদা তখন হিন্দু স্কুলের শিক্ষক, পরে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। আড্ডা থেকে ফ্রি কোচিং সেন্টার বাসুদার অনুপস্থিতিতে আর বেশিদিন চলল না। বংশী দে বহুদিন সেটা চালানোর চেষ্টা করেছেন। কর্মব্যস্ততায় আমরা বিভিন্ন জায়গায় চলে যাওয়ায় আড্ডার ঠেকও গেল উঠে। সিনেমা হল লাগোয়া চায়ের দোকানে আড্ডা হলেও আমাদের সেই সময় সিনেমা দেখার তাগিদ ছিল না।
মধ্যমণি ‘কাকু’
অশোকনগরে কংগ্রেস নেতা কেশবচন্দ্র ভট্টাচার্যের ( কাকু বলেই আমজনতার কাছে পরিচিত) বাড়িতে আড্ডায় বহু মানুষ ভিড় করতেন। সেই আড্ডার ঠেকে কেশববাবুর মজার মজার কথা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন অনুগামীরা। সব সময় যে রাজনৈতিক আলোচনা হতো এমনটা নয়। নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলতেন কাকু। কংগ্রেস কর্মীরা কাকুর কথায় মজা পেতেন, ক্রমে মুখে মুখে তা ছড়িয়ে পড়ত গোটা অঞ্চলের অন্য আড্ডাগুলিতেও। কাকুর একেকটি রসিকতা আজও এই এলাকায় মিথ হয়ে গিয়েছে।
পাশাপাশি, অশোকনগরে পাঁচের দশক থেকে ডাঃ সাধন সেন ও প্রতিমা চক্রবর্তীর বাড়িতে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির অনুগামীদের আড্ডা ছিল। পরবর্তীকালে বহু বছর সেই আড্ডার ধারা বজায় ছিল। সুবোধ দাসের স্মরণসভায় সিপিএম নেতা লক্ষী মুখার্জির স্মৃতিচারণায় একথা শুনেছি।
চলমান আড্ডা
অশোকনগর গোলবাজারের বহু ব্যবসায়ীর বাড়ি হল ২ নম্বর স্কিমে। এঁরা বিকেলে যখন দোকান খুলতে আসতেন তখন নিজেরা জড়ো হয়ে দল বেধে বাজারে আসতেন। আর এই দোকানিদের দল চলতে চলতে চুটিয়ে আড্ডা দিতেন। ব্যবসার চাপে বৈঠকী আড্ডার সময় কোথায়? চলমান আড্ডায় সুখ-দুঃখের নানা কথা, হাসি-ঠাট্টা-রম্য-রসিকতা চলতো। সেই চলমান আড্ডা এখন আর হয় কি না জানি না!