শ্রীশ্রী করুণাময়ী মাতা ঠাকুরাণীর মঠ স্থাপন করেছিলেন বাদশা আকবরের সেনাপতি মানসিংহ। মন্দিরটি সংস্কার করেছিলেন নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বাহাদুর।
কোন মন্দিরের কথা বলা হচ্ছে, হয়তো স্পষ্ট বোঝা গেল না! কিন্তু, আমডাঙা কালীমন্দির বললে কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বারাসত থেকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আওয়ালসিদ্ধি মোড়ের আগে আমডাঙ্গা ব্লকে এই মন্দির অবস্থিত। আমডাঙ্গা কালীমন্দিরের নেপথ্যে রয়েছে প্রায় সাড়ে চারশো বছরের ইতিহাস।
সম্রাট আকবর দিল্লির মসনদে আসীন হওয়ার পর নজর পড়লো সুজলা সুফলা বাংলার উপর। শাসন তখন বারভূঁইয়ার হাতে। আকবর যুবরাজ সেলিমকে পাঠালেন বাংলা অভিযানে। কিন্তু বাগে আনতে পারলেন না যশোরের প্রতাপাদিত্যকে। যুবরাজ পরাজিত হলেন। বিশাল মুঘল ফৌজ কী কারণে বাংলার সামান্য জমিদারের কাছে পরাজিত হলেন, তার কারণ বিশ্লেষণ করার দায়িত্ব দেওয়া হলো অম্বর রাজ সেনাপতি মান সিংহকে। এই প্রসঙ্গে বলা যায়, বাংলার যাদুবিদ্যা ও অলৌকিক কাহিনী তখন জনশ্রুতি হিসেবে সারা দেশে প্রচলিত।
মান সিংহ তদন্তে নামলেন। জানতে পারলেন, প্রতাপাদিত্যের শক্তির উৎস, ‘মা যশোরেশ্বরী’। মাকে পুজো দিয়ে তিনি যুদ্ধে যান এবং মানসিক শক্তি পান।
পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত হলেন। বাংলার মসনদ দখল করলেন মীরজাফর। মীরজাফরকে ইংরেজদের দ্বারা পদচ্যুত করে বাংলার মসনদ দখল করলেন মীরকাশিম। মীরকাশিমের এর সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ার, মহারাজার কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়। সেই সময় কৃষ্ণচন্দ্র পালিয়ে আসেন আমডাঙায়। বলা হয়, সেখানে মঠের প্রধান মোহান্ত পঞ্চমুন্ডি আসনে বসে মাতা করুণাময়ীর আরাধনা করে মহারাজকে বিপদমুক্ত করেন।
কৃতজ্ঞ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ৩৬৫ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেন। মন্দিরের দ্বিতল নির্মাণ করে দেন। মন্দিরের সেবাইত নারায়ণ গিরিকে ‘ব্রহ্মপরায়ণ’ উপাধিত ভূষিত করেন। পূর্ণরূপ পায় আজকের আমডাঙা মন্দির।
করুণাময়ী মূর্তিটি কষ্টিপাথরে নির্মিত। মূর্তি সম্মুখের চন্দন কাঠের দরজাটি প্রায় ৪৫০ বছরের পুরনো। মন্দির ঘিরে যে শিবমন্দির গুলি দেখা যায়, সেগুলি আসলে মাঠে ব্রহ্মলীন হওয়া ১৪ জন মোহান্ত মহারাজের সমাধি ক্ষেত্র। মোহান্তদের মধ্যে শুভানন্দ গিরি মঠে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। তাই তাঁর সমাধিস্থলের উপর নির্মিত শিব মন্দিরটি আজও আচ্ছাদনহীন অবস্থায় রয়েছে।
মাতা যশোরেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন রামানন্দ গিরি গোস্বামী। যাঁর সহায়তায় মানসিংহ মাতা যশোরেশ্বরীর মূর্তি নিজের শিবিরে নিয়ে এলেন। পরবর্তী সময়ে এই মূর্তি মানসিংহ নিয়ে গিয়েছিলেন অম্বরে। আজও সেই বিগ্রহ স্বমহিমায় রাজস্থানের অম্বর ফোর্টে অবস্থান করছে।
মা যশোরেশ্বরীর অন্তর্ধানে প্রতাপাদিত্য শোকে বিহ্বল হয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লেন। তীব্র ভর্ৎসনা করলেন রামানন্দ গিরিকে। সৎ ব্রাহ্মণ রামানন্দ গিরি অপমানিত হয়ে বিবেকের দংশনে যশোর ত্যাগ করলেন। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত প্রতাপাদিত্য এবার সহজেই পরাজিত হলেন। মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারলেন না। বন্দি হলেন।
রামানন্দ গিরি প্রায় উন্মাদ অবস্থায় আশ্রয় নিলেন জঙ্গলে। ইতিমধ্যে মানসিংহ রাজস্থানে ফিরে দেবীর স্বপ্নাদেশ পান— রামানন্দ গিরিকে দিয়ে যশোরেশ্বরীর বিকল্প হিসেবে করুণাময়ী মাতৃমূর্তি স্থাপন করতে হবে। মানসিংহ মা’র স্বপ্নাদেশ পালন করতে পুনরায় বাংলায় এলেন। খুঁজে বের করলেন রামানন্দ গিরিকে। রামানন্দ গিরির হাতে প্রতিষ্ঠিত হল আজকের মা করুণাময়ী। আর মন্দির অঞ্চলের নাম হল, রামানন্দ গিরির নাম অনুসারে— রামডাঙ্গা। সেই রামডাঙ্গা লোকমুখে ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে হল, আজকের ‘আমডাঙা’।
এরপর পেরিয়ে গেল দু’শ বছর। সাল ১৭৫৭। বাংলার নবাব তখন সিরাজদৌলা। তিনি ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য ঘাঁটি গেড়েছিলেন কলকাতার লাগগোয়া এই আমডাঙায়। সঙ্গে ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। কথিত আছে, কৃষ্ণচন্দ্র তখন এই অঞ্চলে দর্শন পান মা করুণাময়ীর মূর্তির। মন্দিরের জীর্ণ দশা দেখে তিনি যারপরনাই পীড়িত হয়েছিলেন।