বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডানাওয়ালা পাখি। অথচ তেমন গুমোর নেই অ্যালবাট্রসের। সাধারণ মধ্যবিত্তের মতো সমুদ্রের মাছ খায় আর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার করে। মনোগ্যামি (Monogamy)র জাত। উইংস্প্যান বা দুই ডানার মাঝের বিস্তার ৪ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। তবু ডানা ঝাপটানি নেই তেমন। ছোকছোক স্বভাবও নেই। ওই যেন — ‘একটি নিয়েই গলদগর্ম। শান্তশিষ্ট, পত্নীনিষ্ঠ। কিন্তু ইদানীং যেন অ্যালবাট্রসদেরও সংসার ভাঙছে। একসঙ্গে হাজার হাজার পাখির ‘ডিভোর্স দেখে ফেলেছেন দূর সমুদ্রগামী নাবিকেরা!
কিন্তু কেন! আপাতত কাউন্সেলিং না-হোক, অ্যালবাট্রসের বিবাহ-বিচ্ছেদের কারণ অনুসন্ধানেই মাথা খারাপ বিজ্ঞানীদের। যত দোষ, তাহলে কি জলবায়ু-বদলেরই? এখনও পর্যন্ত গবেষণায় এটাই উঠে এসেছে। বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, অ্যালবাট্রস প্রজাতির পাখির বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তন (Climate Change)। এই প্রজাতির পাখি সঙ্গী বা সঙ্গীনীর প্রতি দায়বদ্ধ। তবে এখন হাজার হাজার পাখিকে সঙ্গী বা সঙ্গিনী ছাড়াই দেখা যাচ্ছে।
সাধারণত প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরে এই প্রজাতির পাখিদের দেখতে পাওয়া যায়। পক্ষীবিদরা বলেন, এই প্রজাতির পাখিরা মানুষের মতোই নিজেদের সঙ্গী বেছে নেয়। না, ওসব ‘সম্বন্ধ-টম্বন্ধ’ করে নয়, যাকে বলে ‘লিভ টুগেদার’। যেন সনাতনি মতে বিয়েই। সঙ্গী বেছে নিয়ে মোটামুটি তাকে নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেয় । না, সবার অবশ্য হ্যাপি এন্ডিং না। কারও কারও ট্র্যাজিকও! পক্ষীবিদরা বলেন, অ্যালবাট্রসের বিবাহবিচ্ছেদও অনেকটা মানুষের মতোই। বরং আরও অনেকখানি সেন্সিবল। দু’জনের মধ্যে এক জন যদি অন্য সঙ্গী বেছে নেয়, দ্বিতীয় জন তখন নিঃশব্দে সরে যায় সম্পর্ক থেকে। না, ওসব খিস্তি-খেউড়, মান-অভিমানের বালাই নেই। প্রেমের অভিমানে ল্যাং খাওয়া অ্যালবাট্রোস কি তখন একটু বেশিই ডানা ঝাপটায়? জানা নেই!
কিন্তু ইদানীং যেন সব হিসেব ওলোটপালট। রয়্যাল সোস্যাইটি জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহাসাগরের জলে উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্যই অ্যালবাট্রস পাখির জীবনে নানা পরিবর্তন এসেছে। এই যেমন তারা হামেশাই মাছ শিকার করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম! আজ মাছ কই! পাঁচ জন বিজ্ঞানীদের ওই গবেষণাপত্রটি বলছে, মূলত মাছ শিকার নিয়েই সঙ্গী বা সঙ্গীনীর সঙ্গে মনোমালিন্য হচ্ছে এই প্রজাতির পাখিদের। যার ফলেই তারা আলাদা থাকছে। এটা ডিভোর্স নয়!
সঙ্গী বা সঙ্গিনীর প্রতি দায়বদ্ধ থাকাটা কার্যত ট্র্যাডিশনে পরিণত করে ফেলেছিল অ্যালবাট্রস। অকল্যান্ড দ্বীপে এই পাখি দেখা যায় প্রচুর। ২০০৩-এ এখানে প্রায় ১৬ হাজার যুগল অ্যালবাট্রস দেখা গিয়েছিল। এরা মোটামুটি একই বাসা বেঁধে ওই এক সঙ্গীর সঙ্গে প্রায় ২৮০ দিন থেকে যায়। মনের মতো সঙ্গীর সন্ধানে বেশ কয়েক বছর সময় লাগে। তারপর মনের মিল হলে একটি অনন্য চিহ্ন-ভাষা তৈরি করে নেয় যুগলে(Mating process)। এই পাখির একটি খুব সুন্দর সঙ্গমের আচার রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সঙ্গীর পালকে ঠোঁট ডুবিয়ে আদর করা, আদরের ঠেলায় মাথা পিছনে চলে যায় সঙ্গীর। কখনও আবার প্রবল ঝাঁকুনি দেয় প্রেমিক। অনবরত ডানা ঝাপটায়। ঠোঁটে ঠোঁট রাখে ঠিক মানুষের মতো। এখন অবশ্য সবই ভাটা। বেশিরভাগ পাখি একা ঘুরছে, মাছ শিকার করছে।
গবেষকরা বলছেন, একা থাকাটাই এখন অভ্যেস এদের। যার প্রভাব পড়েছে প্রজননেও। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই কমে যাচ্ছে এই পাখির সংখ্যা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনও পাখি প্রজননে অক্ষম হলে তার সঙ্গী তাকে ছেড়ে চলে যায়। তার পরের মরশুমে সেই পাখি নতুন সঙ্গী খুঁজে নেয়। তা না হলে এই প্রজাতির পাখির বিবাহবিচ্ছেদ বিরল। এখন প্রজননে সক্ষম পাখিকেও ছেড়ে যাচ্ছে তার সঙ্গী! পেটের জ্বালা যে আরও বড়!
গবেষকরা জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এবার অ্যালবাট্রস পাখির বিচ্ছেদের হার বেড়েছে আট শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়া আর কোনও কারণ রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছেন বিজ্ঞানীরা। তবে সামনেই প্রজননের মরশুম। আর এখন অকল্যান্ড দ্বীপে বহু পাখিকেই একা থাকতে দেখছেন গবেষকরা। যা চিন্তার ব্যাপার।