(রোজকার জিনিস কিনতে অনেক মধ্যবিত্তেরই ঠিকানা ছিল বিগবাজার। সবচেয়ে সস্তার প্যাকেজ খুঁজতে ক্রেতারা চোখ রাখতেন বিগবাজারের বিজ্ঞাপনে। এখন অবশ্য অন্য কারণে শিরোনামে বিগবাজার। নেপথ্যের কাহিনী শুনিয়েছেন সঞ্জয় গুপ্ত)

ফিউচার গ্রুপের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলে মামলা করল আমাজন। তবে ভারতের কোনও আদালতে নয়। তারা গেল সিঙ্গাপুরের ইন্টারন্যাশনাল অর্বিট্রেশন সেন্টারে।

অর্বিট্রেশন ব্যাপারটা হচ্ছে, কোর্টের বাইরে সেটেলমেন্ট। এতে খরচ কম,  সিদ্বান্ত পেতেও সময় কম লাগে। সাধারণ ভাবে তাই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গুলি এভাবেই বিবাদ মেটাতে পছন্দ করে। সিঙ্গাপুরের অর্বিট্রেশন সেন্টারের আদেশ আমাজনের পক্ষে গেল। সেই সময় ইন্টারন্যাশনাল অর্বিট্রেশন সেন্টারের  আদেশ অবশ্য ভারতে মান্যতা পেত না।

আমাজন ভারতের সরকারি সংস্থা সেবি এবং কম্পিটিশন কমিশন অফ ইন্ডিয়ার কাছে আবেদন করলো  যাতে রিলায়েন্স আর ফিউচার গ্রুপের চুক্তি মান্যতা না পায়। কিন্তু এই দুটি কোম্পানিই আপত্তি তুলে বলল, সিঙ্গাপুরের আদেশ ভারতে প্রযোজ্য নয়। আমাজান কোর্টে আবেদন দাখিল করলো। ওদিকে সিসিআই, আর সেবি, রিলায়েন্স ও ফিউচার গ্রুপের এই চুক্তিকে মান্যতা দেওয়ার আদেশ দিলো ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর। তার পরের মাসেই, কোর্টের একজন বিচারক, আমাজনের করা আবেদন খারিজ করে দিলেন। কিন্তু আমাজন এর বিরুদ্ধে দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন জানালো।

দিল্লি  হাই কোর্টের একজন বিচারপতি  কিন্তু সিঙ্গাপুর ট্রাইবুনালের দেওয়া আদেশ ন্যায্য বলে মেনে নিলেন। ফিউচার গ্রুপ এই রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করে। সেখানে আবার একজন বিচারপতির দেওয়া আদেশ পাল্টে, ফিউচার আর রিলায়েন্স কোম্পানির চুক্তি ঠিক আছে বলেই আদেশ হলো।  আমাজন এই আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে। ২০২১ সালের অগস্ট  মাসে, সুপ্রিম কোর্টের দু’জন বিচারপতি মেনে নিলেন, ইন্টারন্যাশনাল অর্বিট্রেশন-এর আদেশ ভারতে মান্যতা পাওয়া উচিত।

আমাজন কোম্পানির বিরুদ্ধে কম্পিটিশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া অভিযোগ এনেছে, তারা নাকি তথ্য গোপন করে  ফিউচার গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করেছে। ২০০  কোটি টাকা ফাইনও হয়েছে। ২০১৯ সালের হওয়া চুক্তির মান্যতা নিয়ে প্রশ্ন করে সেটাকে কেন বাতিল করা হবে না, সেই প্রশ্নও তুলেছে। সেটা নিয়েও কোর্ট কাছারি। ওদিকে সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পর, ফিউচার গ্রুপ, কোম্পানির মিটিং ডেকে ব্যাপারটি আলোচনা করতে চায়। এর বিরুদ্ধে আবার আমাজন কোর্টে গেছে। মোটামুটি ভাবে মামলায় মামলায় জেরবার হয়ে একদম ঘেঁটে গেছে ব্যাপারটি।

আইনের কচাকচি দিয়ে লেখাটা আর এগিয়ে  নিয়ে যাচ্ছি না। বরং দেখা যেতে পারে কোন পরিস্থিতিতে ফিউচার গ্রুপ চুক্তি করতে এগিয়ে এসেছিল। আসলে ফিউচার গ্রুপের অর্থনৈতিক অবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, ব্যাঙ্ক অফ বরোদা, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক আর আইডিবিআই ব্যাঙ্ক  প্রায় ৬২৭৮ কোটি টাকা পায় এদের কাছ থেকে। সব মিলিয়ে বাজারে নাকি প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকার দেনা। প্রায় সব স্টোরই ভাড়া নেওয়া। প্রায় দু’বছর ধরে ভাড়া দিতে পারছিল না। রিলায়েন্স এই দোকানগুলির মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে ভাড়া নিয়ে নেয়, তারপর এই স্টোরগুলি আবার ফিউচার গ্রুপকে সাবলিজ করে দিয়েছিল। দোকানে বিক্রি করার জন্যে  মালপত্তরের যোগান দিচ্ছিল। এবছর রিলায়েন্স  ভাড়া না মেটানোর অভিযোগ এনে সাবলিজ খারিজ করার নোটিস পাঠালো ফিউচার গ্রুপকে।  সব মিলিয়ে নোটিস এলো ৮৩৫টি স্টোরের জন্যে। এর মধ্যে ৩৪২ টি হচ্ছে বড় আউটলেটগুলির জন্য ( যেমন বিগবাজার, ফ্যাশন, বিগবাজার এফবিবি)। বাদবাকি ৪৯৩ টি ছোট ছোট স্টোর যেমন ইসি ডে, হেরিটেজ স্টোর। এই সব মিলিয়ে নাকি প্রায় ৫৫  থেকে ৬৫ শতাংশ ব্যবসা ছিল ফিউচার গ্রুপের। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে, রিলায়েন্স বেশ কিছু স্টোরের দখল নিয়েছে। সেখানে কাজ করা কর্মীদের আশ্বাস দিয়েছে, তাঁদের রিলায়েন্স রিটেল-এর আউটলেটগুলিতে কাজ দেওয়া হবে। হয়তো এই আশ্বাসেই তেমন কোথাও কর্মী বিক্ষোভের খবর নেই। অভিযোগ উঠছে, এই সব টানাপোড়েনে ফিউচারের কর্মীদের বেতন নিয়ে অনিশ্চয়তার বাতাররণ সৃষ্টি হয়েছে।

২০২১-এর মার্চ অবধি, রিলায়েন্স রিটেল সারা ভারতে প্রায় ১২৭১১ টি আউটলেট চালাচ্ছিল। সব মিলিয়ে এগুলির জন্য জায়গা ছিল ৩৩ মিলিয়ন স্কোয়ার ফুট। নতুন আউটলেটগুলি  নিলে আরও বাড়বে ব্যবসার পরিধি।

কিন্তু আমাজান এই ব্যাপারে আবার কোর্টে গিয়েছে। কিশোর বিয়ানি কোর্টে জানিয়েছেন, স্টোর গুলো তার সম্মতি নিয়ে নেওয়া হয়নি। রিলায়েন্সের সঙ্গে কথা চলছে।

যুদ্ধটা আসলে বকলমে হচ্ছে দুই বৃহৎ প্লেয়ারের মধ্যে। আমাজন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রিটেলার। ওদিকে রিলায়েন্স রিটেল, ২০০৬ সালে ব্যবসা শুরু করে তারা এখন ভারতের সবচেয়ে বড় রিটেলার, বছরে ব্যবসার পরিমাণ প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার। এই দুয়ের লড়াইয়ে বাকিরা স্যান্ডউইচ হয়ে যাচ্ছে।

বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। গুয়াহাটির মলটি ছিল বিগবাজার এফবিবি-র। আপাতত সাইনবোর্ড ঝুলছে না। বন্ধ। হয়তো একদিন খুলবে। তবে যতদূর মনে হয়, বিগবাজার নামের সাইনবোর্ড দেখা যাবে না সেই স্টোরে।

সমাপ্ত