(বাংলা সাহিত্যে সাহেব বিবি গোলাম, কড়ি দিয়ে কিনলাম-এর মতো বইগুলি বিমল মিত্রকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে, এক সন্ধেয় কলকাতার চেতলায় নিজের বাড়িতে বসে লেখক শুনিয়েছিলেন তাঁর জীবনের অনেক অজানা কথা। এমনকি, নিজের গ্রামের বাড়ির গাছের আম নিয়েও জানিয়েছিলেন এক আশ্চর্য তথ্য। আমের এই ভরা মরসুমে বাজারমুখী পাঠককে যা নতুন দিশা দেখাবে।)

১৯৭৭ সালের গোড়ার দিক। সাহিত্যিক বিমল মিত্র সরকারি অতিথি হিসেবে মরিশাসে গিয়েছেন এবং সেই ভ্রমণ কাহিনী ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘চলতে চলতে’ শিরোনামে ধারাবাহিক ভাবে লিখে চলেছেন।  লেখাটি আমি মনোযোগ সহকারে পড়ছিলাম। তুলসীদাসের ‘রামচরিত মানস’ যে মরিশাসবাসীর মনে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে, তা নিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা উঠে এসেছিল সেই লেখায়।

বিমল মিত্রের লেখায় মরিশাসে রামায়ণ প্রসঙ্গটি আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছিল। এই বিষয়ে কিছু কথা বলার অভিপ্রায়ে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে একটা চিঠি লিখি। কিন্তু বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করেও চিঠির উত্তর না আসায় একদিন টেলিফোন করি।

লেখককে লেখা বিমল মিত্রের চিঠি

বিমল মিত্র নিজেই টেলিফোনটা ধরেছিলেন। আমি পরিচয় দিয়ে চিঠির প্রসঙ্গ তুলতেই বলে উঠলেন, ‘‘হ্যাঁ, আপনার চিঠি পেয়েছি। কিন্তু কী জানেন, উত্তর দিতে ভুলে গিয়েছি। অপরাধ নেবেন না। ’’ তারপরেই বললেন, ‘‘কবে আসতে পারবেন? চলে আসুন।’’

২৬ মে, ১৯৭৭, সন্ধে ছ’টা। তাঁর চেতলার বাড়িতে পৌঁছে দোতলায় উঠে ডোর বেল বাজাতেই বিমল মিত্রই দরজা খুলে দাঁড়িয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মাধববাবু?’ আমি মাথা নাড়ি। ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। তিনিও বসলেন মুখোমুখি।

আগেই টেলিফোনে বলেছিলেন, ‘চলতে চলতে’-র কিস্তি লিখতে গিয়ে চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে হাঁটুতে চোট পেয়েছেন। সেকথা জিজ্ঞাসা করাতে ডানপায়ের হাঁটুর কাপড় সরিয়ে দেখালেন। ‘‘এই দেখুন, এখনও কেমন ফুলে আছে। মাঝে মাঝে যন্ত্রনা হয়।

— কোথায় পড়ে গিয়েছিলেন? এ বাড়িতে?

— নানা, মাজদিয়া ফতেপুরে। সেদিন বলেছিলুম না মাঝদিয়ার কথা। আমাদের গ্রামের বাড়ি। আপনাদের জেলাতেই তো। ওখানে গিয়েছিলাম। লিখছিলাম, চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে হঠাৎই পড়ে গেলাম। ব্যস, পা-টা ভাঙল।

—মাঝদিয়াতে কি আপনার দেশের বাড়ি?

— হ্যাঁ, অনেক দিনের বাস। পুরনো বাড়ি। শরিকরা থাকেন। মাঝেমধ্যে যাই আর কি। আমার জন্ম এখানেই। এই যে বাড়িটা, যেখানে বসে আছি, এখান থেকে কয়েকটা বাড়ি ছাড়িয়ে গলির দিকে একটি এগোলেই একটা বাড়িতে আমরা থাকতুম, ওই বাড়িতেই আমার জন্ম। এই বাড়িটা পরে কেনা হয়েছে। বুঝলেন, শহরে থাকি ঠিকই, তবে শহর আমার ভাল লাগে না। গ্রামই ভাল। গ্রাম আমাকে খুব টানে।  আমরা শহুরে মানুষগুলো অনেকটা পরগাছা। আসল মানুষের বাস গ্রামে। সময় পেলেই গ্রামের দিকে চলে যাই। ঘুরে আসি

গ্রাম-শহর নিয়ে আমাদের কথা হচ্ছিল। সে কথায় ছেদ পড়ল এক ভদ্রলোকের আগমনে। রোগা-পাতলা বেটে খাঁটো চেহারার ভদ্রলোক দরজা ঠেলে ঢুকে এলেন। বিমলবাবু ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘সনৎ এসেছো? বোসো।’’

ভদ্রলোক আমার পাশেই একটা চেয়ারে বসলেন। বিমল মিত্র পরিচয় করিয়ে দিলেন, ইনি সনৎ গুপ্ত। তথ্য সরবরাহক। লেখকদের প্রয়োজনমতো  তথ্য সরবরাহ করে থাকেন। কী নেই তাঁর ঝুলিতে? সাহিত্য-বিজ্ঞান-ইতিহাস-রাজনীতি। যে বিষয়ে যাঁর দরকার, তার প্রামাণ্য তথ্য জুগিয়ে দেন সনৎবাবু— যেন জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া।

সনৎবাবু প্রয়োজনীয় দু-চার কথা বলে এবং দু’টো বই রেখে দিয়ে চলে গেলেন।

আমরা আবার আমাদের কথায় ফিরে এলাম। ব্যক্তিগত দু-চার কথার পর বিমল মিত্র বললেন, ‘‘মরিশাসে না গেলে ‘রামচরিত মানস’ সম্পর্কে আমি এমন ভাবে জানতে পারতাম না। একটা কাব্য একটা দেশকে স্বাধীন করে দিয়েছে। সে দেশে ধনী থেকে দরিদ্র— তুলসী শ্লোক পাঠ করে দিন শুরু করেন।’’ রামায়ণ নিয়ে আলোচনা করতে করতেই ফাদার বুলকের কথা উঠল— রাঁচির সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক। আমাকে বললেন, ‘‘যান না, ওঁর কাছে ঘুরে আসুন। খুব ভাল মানুষ। আমার সঙ্গে অনেকদিনের বন্ধুত্ব। বুলকে একজন বুলগেরিয়ান। দীর্ঘদিন ধরে রাঁচিতে আছেন। ‘রামচরিত মানস’ অনুবাদ করছেন তাঁর মাতৃভাষায়।’’

বিমল মিত্র আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই প্রশ্ন করলেন, ‘‘আপনি এপথে এলেন কী ভাবে? লেখালিখিই কি আপনার প্রফেশন?’’

বললাম, ‘‘না, এটা আমার প্রফেশন নয়। আসলে এটা ভাললাগার জায়গা বলতে পারেন। পেশার জীবনের অতৃপ্তি থেকে কিছু সময়ের জন্য ভিন্ন পথে হাঁটা আর কি।’’

বিমল মিত্র বললেন, ‘‘আমি কেন এসেছি জানেন? আমার দ্বারা সমাজের অন্য আর কোনও কাজ হল না বলে।’’ পরক্ষণেই বললেন, ‘‘জানেন, লেখক হওয়া সহজ। কিন্তু মানুষ হওয়া বড় কঠিন।’’

মাথা নিচু করে তাঁর এই কথা ক’টি ভাবছি আর মনে করছি ছোট এই কথা ক’টির মধ্যে কতবড় দর্শনই না লুকিয়ে রয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, রাত সোয়া আটটা। উঠতে হবে। নইলে রাতের শেষ ট্রেনটাও পাবো না।

বিমলবাবু বললেন, ‘‘একটু বসুন’’। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক প্লেট আম নিয়ে এসে আমার সামনের টেবিলে রাখলেন বাড়ির পরিচারিকা।

বিমলবাবু বললেন, ‘‘খান, আমার দেশের বাড়ির গাছের আম। গিয়েছিলাম না? ওখান থেকেই আনা। গাছপাকা আম। খেয়ে দেখুন। খুব মিষ্টি।’’

মুখে দিতেই বোঝা গেল, সত্যিই যেমন রসালো তেমনই মিষ্টি। বিমল মিত্র বলে চলেছেন, ‘‘জানেন কি, আমের স্ত্রী-পুরুষ আছে?  স্ত্রী আম, পুরুষ আম থেকে অপেক্ষাকৃত মিষ্টি বেশি হয়।’’ আম রেখে আমি বিস্মিত হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে শুনছি।  আমের স্ত্রী-পুরুষ! বিমল মিত্র বললেন, কি বিশ্বাস হচ্ছে না— বলে নিজেই উঠে গিয়ে পাশের ঘর থেকে দু’টি আম হাতে করে এনে আমাকে দেখিয়ে দিলেন, কোনটা স্ত্রী আর কোনটা পুরুষ আম। স্ত্রী আমের চামড়া মসৃণ। নীচের দিকটা বেঁকে উপরের দিকে উঠেছে। নাভিটা বেশ বড়। আর একই গাছের পুরুষ আমের শরীর একটু খসখসে, চামড়া মোটা, নাভি ততটা লক্ষনীয় নয়। স্ত্রী আম, পুরুষ আমের থেকে রসালো ও মিষ্টি— 

চিনিয়ে দিয়ে আমাকে বললেন, ‘‘এরপর বাজার থেকে যখন আম কিনবেন, বেছে বেছে স্ত্রী আম কিনবেন’’।

শুধু মহাকাব্যের রসই নয়, অমৃতফলের রসাস্বাদন করতে গিয়ে সেদিন শিখে এসেছিলাম তাদের জন্মবৃত্তান্ত।

(বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৌশিক ব্রহ্মচারী জানিয়েছেন, আম গাছ তিন রকমের হয়। পুরুষ, স্ত্রী এবং উভলিঙ্গ। যে গাছে পুরুষ এবং স্ত্রী— দু’রকমের মুকুল আসে, তাতে উভলিঙ্গ ফল ধরে। স্ত্রী বা পুরুষ আম চেহারার ভিত্তিতে আলাদা করে চেনা সম্ভব। যে গাছে স্ত্রী মুকুল আসে, সেই গাছের আম অনেক বেশি সুস্বাদু। আবার যে গাছে পুরুষ মুকুল, সেই আম তুলনামূলক ভাবে কম সুস্বাদু।

উত্তর ২৪ পরগনার কাঁকিনাড়ার আমচাষি নিরঞ্জন সরকারের  বাগানে এবার ৫৮ হাজার স্ত্রী আম ফলেছে। তিনি জানিয়েছেন, এই গাছ থেকে কলম করা হলে তার ফলন অনেক বেশি।)

1 COMMENT

Comments are closed.