বাড়ির মালিক মনীশ লারকাকে  পুলিশ ধরে জেলে পুরে দিয়েছে। হরিদ্বারে পালিয়ে গিয়েছিলেন। বেশ কয়েকটা জায়গায় খোঁজাখুঁজি, তল্লাশি অভিযান চালানোর পর, মোবাইল ট্র্যাক করেই হয়তো, হরিদ্বারে পাওয়া গিয়েছে।

মনীশ লারকা হচ্ছেন দিল্লির সেই চারতলা বাড়িটির মালিক, যেখানে ২৭ জন লোক জ্বলে পুড়ে মারা গেলেন, শুক্রবার, ২০২২ সালের  ১৩ মে তারিখে। ঘটনাটি মনে করিয়ে দেয় ‘উপহার’ সিনেমায় আগুন লেগে ৫৯ জন মানুষের মারা যাওয়ার কথা। সেদিনটিও ছিল শুক্রবার। ১৯৯৭ সালের ১৩ জুন।

আগুন লাগার সময় সেই বাড়ির চারতলায় ছিলেন মনীশ এবং তার পরিবার। একটি ক্রেনের সাহায্যে তাদের নামিয়ে নিয়ে আসা হয়। ভিড়ের সুযোগ, কেউ চিনতে পারার অবস্থায় ছিল না। সুতরাং চম্পট দিতে অসুবিধা হয়নি।

বাড়িটি বাণিজ্যিক কারণে ভাড়া দেওয়া ছিল। একটিই কোম্পানি নাকি পুরো বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল। একতলায় সিসিটিভি ক্যামেরা এবং সেই সম্বন্ধীয় জিনিসপত্র বানাবার কারখানা ছিল। সেখানেই একটি এসি থেকে শর্ট সার্কিট, বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ধরে যায় বিল্ডিংয়ে। পুলিশ অবশ্য কোম্পানির মালিক হরিশ গোয়েল আর বিজয় গোয়েলকে সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার করে নিয়েছে।

প্রায় পঞ্চাশ জন আটকে পরা লোককে উদ্ধার করতে পারা গিয়েছিল। এদের কপাল ভাল ছিল। কিন্তু মোটিভেশনেল বক্তা, কৈলাশ জিয়ানী এবং তাঁর ছেলে আমান জিয়ানী বাঁচতে পারেন নি। গুরুগ্রামের বাসিন্দা জিয়ানী, দোতলার ঘরে কর্মীদের মোটিভেট করার জন্য বক্তব্য রাখছিলেন বিকেল চারটের পর থেকে। আগুন লাগে চারটে পঁয়তাল্লিশ নাগাদ। তাঁরা বাইরে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাননি। তাঁদের সঙ্গেই সুযোগ পাননি যাঁরা, তার মধ্যে চব্বিশ জনই মহিলা। অনেকেই মাসে সাত থেকে আট হাজার টাকার রোজগার করতেন ওই কোম্পানিতে কাজ করে।  আগুনে এত ঝলসে গেছে তাঁদের চেহারা, যে চেনাই যাচ্ছে না। ডিএনএ টেস্ট করতে হবে পরিচয় নিশ্চিত করতে।

সরকারের তরফ থেকে যা কিছু করার সব কিন্তু তড়িঘড়ি করে ফেলা হয়েছে।

মানুষদের নাম জানতে না পারলেও, ক্ষতিপূরণের অঙ্ক ঘোষণা হয়ে গিয়েছে।  সরকারি হাসপাতালে ‘মুফতে’  চিকিৎসার ব্যবস্থা  করা, ঘরের মালিক এবং কোম্পানির মালিক— এদের গ্রেফতার করে জেলে রাখা আছে।

না, এদের কারও বিরুদ্ধে জেনে বুঝে মানুষ খুন করার অভিযোগ অবশ্য আনা হয়নি। সেটা উচিতও না। সত্যিই কি তারা জেনে বুঝে ….

আইনজীবীদের কেউ কেউ মনে করছেন, এমন অভিযোগ আনলেও কোর্টে টিঁকত না। সুতরাং কারও মনে হতেই পারে, কিছুদিন, মানে ধরুন মাস খানেকের মধ্যেই হয়তো জেল মুক্তি হয়ে যেতে পারে এদের।  কোম্পানির ব্যবসা বন্ধ করার প্রশ্ন ওঠে না। আশপাশে কোথাও বিল্ডিং একটা দেখে চলে গেলেই হল। কর্মীর আকাল নেই। লাইনে হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়ে আছে। বিল্ডিংয়ের মালিকের অবশ্য এতো চটজলদি হবে না। বাড়িটা বেশ পুড়ে গিয়েছে। ইন্সুরেন্স না থাকলে, বেশ মুশকিল হবে নতুন করে বানানোর জন্য ফান্ড জোগাড় করতে। তবে কমার্শিয়াল এলাকা।  টাকা ব্যবসায়ীরা অগ্রিম হিসেবে দিলে, বিল্ডিংটা হয়তো ফের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে।

এখানে মালিকপক্ষের কাছ থেকে সিভিল ড্যামেজ পাওয়ার আইন খুব একটা বোধহয় কড়া নয়। মাস নয়, বছর নয়, দুই-তিন দশক লেগে যাবে। ‘উপহার’ সিনেমার অগ্নিকাণ্ডে ২৪ বছর লেগেছে ফাইনাল হতে। তারপর ইন্সুরেন্স থাকলে তো কথাই নেই, নেপোয় দেবে ধন। দেখছেন না, গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে তেমন ড্রাইভিং না-জানা লোক, আর তহবিল খালি করে ক্ষতিপূরণ দেয় ইন্সুরেন্স কোম্পানি।

হ্যাঁ, বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম, একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সেটা ধরুন বছর পাঁচেক, কম করেও। আর তদন্তের ফল… সে-ও কী বলতে হয়।

বিল্ডিংটিতে ওঠা নামার জন্য একটিই সরু সিঁড়ি ছিল। অনেক এসি চলছিল। চলতেই হবে, যা গরম দিল্লিতে। তা ইলেকট্রিক কানেকশন একটু দুর্বল ছিল। অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর নিয়মকানুন ঠিক পালন করার সুবিধা ছিল না। বিল্ডিংয়ের ডিজাইন ঠিক ছিল না। এইসব কথা, সেই ‘উপহার’ সিনেমা হলের আগুন লাগার সময় থেকেই জেনে আসা। নতুন কিছু নেই।

কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর পাবারও হয়তো দরকার নেই। যেমন ধরুন, যে ইলেকট্রিক কোম্পানি নিজেদের রোজগার বাড়াবার জন্য রোজ পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দেয়, তারা এইসব কমার্শিয়াল বিল্ডিং একটু কড়া নজরদারিতে রাখে না কেন?  রাখলে, ট্রান্সফরমার বসিয়ে, লোড বাড়িয়ে ক’টা টাকা এক্সট্রা ইনকাম হতে পারতো। কিংবা ধরুন ফায়ার বিগ্রেড। এমনিতে খাকি পোশাক। কিন্তু এই সব বিল্ডিংয়ের লিস্ট পৌরসভা থেকে কালেকশন করে, কখনও কখনও একটু নজরদারি। রোজ তো আর আগুন লাগে না।  টাইম পাস ভি হল, সঙ্গে ফাইনটাইন বাবদ সংস্থার কিছু আমদানিও হল। তাছাড়া ভাবেন তো এমন দৃশ্যের কথা— নামকরা বিল্ডিংয়ের মালিকপক্ষ বিএমডাব্লিউ থেকে নামছেন, ফায়ার বিগ্রেডের দফতরের সদর দরজায়। দৃশ্যটাই তো মনোমুগ্ধকর!

পৌরসভার কথাতেই এলাম যদি, তাহলে  লাইসেন্স ফি নেয় যখন, তখন একবার গিয়ে দেখে এলেও পারে। অনেকে অবশ্য পৌরসভার ধার ধারে না। কিন্তু জিএসটি দেয়। তা সেই দফতরকে রাজ্যের পৌরসভা বা ইলেক্ট্রিসিটি এমনকি ফাযারবিগ্রেড অবধি চিঠি পাঠিয়ে বলতে পারে, রেজিস্ট্রেশন দেবেন না, লোকটি আমাদের কথা শুনছে না। ব্যবসা করতে হলে ব্যাঙ্ক ফাইনান্স দরকার। কিংবা ধরুন ইন্সুরেন্স। সবাই যদি চেপে ধরে, ফায়ার বিগ্রেডের নো অবজেকশন, পৌরসভার অনুমতি পত্র, ইলেকট্রিকের ভেরিফাইড লোড সার্টিফিকেট না দেখালে এখানে ডাল গলবে না, তাহলে বিল্ডিংয়ের মালিকেরা বাধ্য হয় নিয়মকানুন মানতে ।

কিন্তু, যে কোনও ব্যবসায়ীকে, কমার্শিয়াল বিল্ডিংয়ের মালিককে জিজ্ঞেস করে দেখুন— তাঁরা বলবেন, এত সব নিয়মকানুন মানতে হলে, ব্যবসা করবো কখন?

সত্যিই তো।

ব্যবসা, ইজ মোর ইম্পর্টেন্ট।

ফলে নিজের খেয়াল নিজে রাখাই ভাল। এরকম জতুগৃহ কিন্তু আপনার চারপাশে অসংখ্য। বিবাহভবন থেকে শুরু করে হোলসেল মার্কেটের অনেক ব্যবসাবাড়ি। সব শহরেই।

একটু খেয়াল রেখে… সিনেমাহল, বিয়েবাড়ি দরকারে পেট কামড়াচ্ছে বলে জাস্ট অ্যাভয়েড করে ফেলতে পারেন। ব্যবসার জন্য, কেনাকাটা করতে হলে, একটু সাবধানে পা পা করে ভেতরে ঢুকুন। বেরুবার রাস্তাটা খেয়ালে রেখে, যাতে কিছু দেখলেই…

“য পোলায়তি স জিবতি” …

মনে রাখবেন, ‘উপহার’ সিনেমা হলের আগুনে পুড়ে যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের প্রচুর সামাজিক প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও আইনি লড়াই লড়তে বছরের পর বছর লেগেছে।