প্রেসিডেন্সি কলেজের বাংলা বিভাগ। শিক্ষক-কক্ষের বাইরে এক এক করে ভিড় জমাচ্ছে উনিশ কুড়ির উজ্জ্বল মুখগুলো। আজ রেজাল্ট বেরিয়েছে যে! একটা শ্যামলা মেয়ে ওই ভিড়ের থেকে খানিক দূরে। চোখ মাটিতে। শামুকের মতো খোলসে গুটিয়ে যায় পারলে সংকোচে। তার মন পড়ে নিতে সময় লাগে না জাত শিক্ষকের। ছাত্রীকে সস্নেহে ডেকে নেন কাছে। ‘মার্কসীয়’ (Marks) উদযাপনে মুখর ঘরের মধ্যেই জলদগম্ভীর কণ্ঠে অনেকটা প্রশ্রয় ঢেলে বলেন, “ক’টা নম্বর কম পেয়েছিস বলে তোর জীবনটা ব্যর্থ হয়ে গেল? নাকি, তুই মিথ্যা হয়ে গেলি?” এমন করেও বুঝি ভাবা যায়! ভারী অবাক হয়ে ছিল চোখে চশমা আঁটা একদা সেই ঘোর পড়ুয়া হোস্টেল-কন্যা। চোখের জল শুধু না-পারার গ্লানি ধুয়ে দেয়নি, বরং দিয়েছিল জীবনকে দেখার এক অন্য চোখ। তাই তার পরবর্তী শিক্ষক জীবনেও পাশ-ফেল নিমিত্ত মাত্র।
কি বললে তুমি পরোপকারী? কিংবা বন্ধুবৎসল? ভালো গান গাও? ছবি আঁকো দারুন? মাটি দিয়ে গড়ে ফেলো প্রতিমা? সকালে বাবার সাথে মাঠে যাও বীজ বুনতে? ফুটবলে তুমি অপ্রতিদ্বন্দ্বী? কবিতা লেখ? কী যায় তাহাতে কী আসে! উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারোনি, আবার হায়ার সেকেন্ডারি বানানও জানো না! অতএব…। খবরে প্রকাশ, আত্মহত্যা করেছে উচ্চমাধ্যমিকে অকৃতকার্য এক ছাত্রী। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় খোরাক হয়ে যাওয়া ছাত্রীটি দোর দিয়েছে ঘরে। ‘এ যুগে কেউ ফেল করে না’-র চলতি হাওয়ায় পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়াটা যেন একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ভালো-মন্দ যাই ঘটুক, সত্যিটাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে চলার, ঘুরে দাঁড়ানোর শিক্ষায় ফাঁক থেকে যাচ্ছে বিস্তর। মন ভেঙে যাচ্ছে সহজেই। ভাঙা মনের শুশ্রূষার বদলে চলছে লোক হাসানোর এক কদর্য প্রয়াস। লোকে কী বলবে আর নয় ,লোকে কী বলছে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে জানতে সময় লাগছে না মোটেও। আত্মবিশ্বাস এতটাই টাল খেয়ে যাচ্ছে যে আঠারোর স্পর্ধা তরতাজা প্রাণকে ঠেলে দিচ্ছে চূড়ান্ত নেতিবাচক পরিণতির দিকে।
পরীক্ষায় ফেল করার সঙ্গে জীবনে সফল হওয়ার আসলে যে কোনো সম্পর্ক নেই, এমন উদাহরণ অজস্র আছে। শুধু অভাব সেই সত্যিগুলো গল্পের ছলে ওদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মানুষের। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ জিনিয়াস। নোবেল প্রাইজ জেতা পদার্থবিদ। আপেক্ষিকতাবাদের প্রবক্তা। কোয়ান্টাম থিয়োরির সূত্রধর। লিখতে গেলে সাফল্যের তালিকা কেবল-ই দীর্ঘতর হবে। অথচ এহেন আইনস্টাইন ১৫ বছর বয়সে স্কুল ড্রপ-আউট। শুধু তাই নয় বিখ্যাত ফেডারেল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করতে পারছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করছেন দু’বারের চেষ্টায়।
এটুকু শুনেই কি কান-মাথা ভোঁ ভোঁ করছে ! সবুর করুন। সুইচ বোর্ডের সামনে যান, বাল্বটা জ্বালুন। কোনো নাম মনে পড়ছে? টমাস আলভা এডিসন? সর্বকালের সেরা উদ্ভাবক বলা হয় এডিসনকে। হাজারের বেশি পেটেন্ট তাঁর নামে। যে ক্যামেরা হাতে নিয়ে সারাদিন কায়দা মারি আমি-আপনি কিংবা কৈশোরের কৌতুহল রিল বানাই আগুপিছু না ভেবেই– সেই মোশন পিকচার ক্যামেরাও এডিসনের কীর্তি। শৈশবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে বেশ দেরি করে স্কুলে যাওয়া শুরু করেন এডিশন। শিক্ষকরা তাঁকে হাবাগোবাই ভাবতেন। অথচ সেই লোকটাই গোটা দুনিয়ায় রোশনাই ছড়াচ্ছেন। ব্লুটুথ স্পিকারে ‘ছাম্মাক ছাল্লো’ চালানোর সময় একবার ফনোগ্রাফের উদ্ভাবকের নামটা জেনে নেবেন দয়া করে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন থেকে হালের স্টিভ জোবস, সমাজের চোখে তথাকথিত ফেলুরামদের দলে কে নেই! ১২ বছর বয়সে স্কুলছুট চার্লস ডিকেন্স লিখছেন ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ ‘অলিভার টুইস্ট’ ‘পিকউইক পেপারস’-এর মত কাল্ট হয়ে যাওয়া বইপত্র। বঙ্কিমচন্দ্র নিজে বাংলায় ফেল, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস তাঁকে স্বীকৃতি দিচ্ছে সাহিত্য সম্রাট হিসেবে। ‘কপালকুণ্ডলা’ কিংবা ‘আনন্দমঠ’ পড়তে-পড়তে কেউ কি কোনোদিন ভাবেন, ‘আরে এটা তো সেই লোকটার লেখা, যে কিনা বাংলায় ফেল করেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায়’।
এমনটা হয় না। আর হবেও না কোনদিন। রবীন্দ্রনাথের মোটেও ভালো লাগত না ইস্কুলে পড়তে যেতে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন, এমন দাবি প্রবল রবীন্দ্র-ভক্তও করেন না। মানে সমাজের মাপকাঠিতে তিনি কিন্তু সেই না-পারাদের দলেই। কিন্তু সে জন্য তাঁর রবীন্দ্রনাথ হওয়া আটকায় না। সেকালেও সমাজ পরিবার ছিল। কিন্তু দুয়ো দেওয়ার চেয়ে আগলে রাখার লোক ছিল বেশি। তাই প্রতিভা নিজের স্বভাবে ডালপালা মেলছে। মহীরুহ হয়েছে। বিবেকানন্দও কিন্তু এ ব্যাপারে ধোওয়া তুলসীপাতা নন। তুখোড় মেধাবী ছিলেন। ধর্মকর্মে মন দিয়ে উচ্চশিক্ষা শেষ করেননি। আইনের পরীক্ষায় পাশ না-দিলেও তাঁর যুক্তি-বুদ্ধির ধার ভোঁতা হয়ে যায় নি মোটেও। বরং আরো খোলতাই হয়েছে দিনে দিনে।
এ তো গেল ‘পুরাকালের কথা’। একালেও এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি। আমাদের আশেপাশেই হয়তো আছে। কিন্তু বিখ্যাত না-হওয়া অব্দি আমরা হীরের কদর করি না। ‘কুইক হিল’ অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সুপরিচিত একটা অ্য়ান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্র্যান্ড। প্রতিষ্ঠাতা কৈলাস কাটকর ক্লাস টেনও পাশ করেননি। পারিবারিক কারণে লেখাপড়া ছেড়ে দেন তার আগেই। রেডিও ক্যালকুলেটর সারাইয়ের একটা ছোট দোকানে কাজ জোটান। গেজেট প্রীতি থেকেই কম্পিউটার নিয়ে নাড়াচাড়া– বাকিটা ইতিহাস। জিটিভি-র কর্ণধার সুভাষ চন্দ্র দশম শ্রেণি পাশ, মিডিয়া ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর সাফল্য কিন্তু ঈর্ষণীয়। অক্ষয় কুমার, বীর দাস, সন্দীপ মাহেশ্বরী– গল্পটা কোথাও না কোথাও এক। আমরা ৯৮-এর শারজা কাপ শচীন তেন্ডুলকরের তুখোড় ইনিংসটাই মনে রাখি, মনে রাখব। বোর্ডের পরীক্ষায় তিনি অঙ্কে কত পেয়েছিলেন সেটা নয়। এটাই সত্যি। এটাই বাস্তব। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে এক আইএএস অফিসারের ক্লাস টেনের ফাইনাল মার্কশিট। অনেক বিষয়েই নম্বর তিরিশের কোঠা ছাড়ায়নি, নিজেই সকলকে জানিয়েছেন সে কথা। কিন্তু সেজন্য তাঁর আইএএস হওয়ার অধ্যাবসায়ে ছেদ পড়েনি।
একে এইচএস ফেল,তায় মেয়ে– অপরাধের বোঝা যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আশাপূর্ণা দেবী- অমৃতা প্রীতম, সাবিত্রীবাই ফুলে- বেগম রোকেয়া, মেরি কম- ঝুলন গোস্বামী, সুনিধি চৌহান- শুভমিতা– কোনো উদাহরণই তখন যথেষ্ট বলে মনে হয় না। পাশ-ফেলের সাথে জড়িয়ে যায় জীবন-মরণ। সবাই তো পিয়ালী বসাক হতে পারে না। দাঁতে দাঁত চেপে যাবতীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুঝে পৌঁছে যেতে পারে না এভারেস্টের চূড়ায়। বরং ঘেঁটে যাওয়া জীবনবোধ নিয়ে লাশকাটা ঘরে শুয়ে থাকে কোন এক অষ্টাদশী।
অক্সিজেনের অভাব নয়, ওকে আসলে তিলে তিলে শেষ করেছে এক অসহনীয় দম বন্ধ করা পরিস্থিতি। আগামী দিনে এ বিপদ আমার-আপনার উঠোনে এসে পড়বে না– এমন কোনো নিশ্চয়তা আছে কি? পরীক্ষার নম্বরের সাথে জীবনের ধারাপাতকে গুলিয়ে ফেলার আগে ওদের গল্প শোনানো জরুরি। সেই সব গল্প, যাতে জয়-পরাজয় সমান সত্যি। গ্লানি আর হতাশার চেয়েও ঢের সত্যি ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য জেদ।
Asale ei j 10 r 12 er Mark’s sevabe kothao kaje lage na seta bojhar moto guardian e ba kota ache? Prothomei to mathay dhokano hy “9-10-11-12 valo kore por, life set” . Gondogol to sekhanei start hy. R counseling to ei somaj e aj o taboo.
R hyan, child psychology r kotha bolle je somaj er 99% hasahasi kore, sekhane eirokom outcome e expected.
Bah..
Yes.
Bah
Yes
Bah
Yes….
খুব ভালো লেখা। সময়োপযোগী লেখা।
Excellent writing… have to read for earn information, knowledge and inspiration. Waiting for next article.
“স্কুলে ডাহা ফেল, জীবনে সফল” পড়ে অনেক কিছুই জানলাম যাহা অজানা ছিল। সত্যি পরীক্ষায় ফেল করেও জীবনে সফল হয়ে সাফল্যের তালিকায় অনেকেরই নাম এবং তাঁদের সৃষ্টি সম্পর্কে অবগত হোলাম। আশীর্বাদ করি আর ও ভাল হোক।
চমৎকার লেখনী। সাহিত্যের দিক থেকে তথ্যের দিক থেকে। সাবলীল। আরো লেখা আশা রাখি।
Extremely insightful writing on an equally relevant societal concern! Our yardstick for measuring success and failure are getting limited and constrained by the day. It is imperative that we adopt a healthier perspective on it for the benefit and relief of our next generation. Articles like these are helpful in taking that important step in the right direction! Kudos to Arita, Thank you!
খুব সুন্দর লিখেছিস❤️
আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ এই সমস্ত উদাহরণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে তুলে ধরা।
এই positivity টাই তো ছড়িয়ে পড়া দরকার। একটা পরীক্ষায় পাস না করতে পারা বা একটা বানান না পারা মানেই যে সব হারিয়ে ফেলা নয় এটুকু ছড়িয়ে পড়ুক। খুব informative লেখা। ভালো লাগলো।
Very motivating. Our children are suffering the worst of the marketised modernity. We have taken away the fullness of life from them and we are also not allowing them to bloom the way they should naturally.
Keep up the good work.