সমুদ্রের ধারে নারকেল গাছের সারিতে ঘেরা একটি চার্চ। আর একটি সাধারণ বাইসাইকেল। ভারতের প্রথম রকেট লঞ্চের অবাক করা ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে তাদের গল্প ।

ভারত মহাসাগরের তীরে কেরলের তিরুঅনন্তপুরম জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম, থুম্বা। মৎস্যজীবীদের বসবাস। চারদিকে  নারকেল গাছ দিয়ে ঘেরা শান্ত গ্রামটি একদিন  ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছিল ।  ১৯৬৩-র ২১ নভেম্বর। আজ থেকে ৫৯ বছর আগে, সেখান থেকেই ছোট একটি রকেট যাত্রা শুরু করেছিল। তা থেকেই সূচনা হয়েছিল ভারতের আধুনিক মহাকাশ যাত্রার। আর কয়েকজন উৎসাহী তরুণ বিজ্ঞানীকে সঙ্গে নিয়ে সে দিনের কর্মকাণ্ডকে সফল করে তুলেছিলেন ভারতের মহাকাশ কর্মসূচির জনক ডক্টর বিক্রম সারাভাই।

অনেক দিন থেকেই সারাভাইয়ের শয়নে স্বপনে একটাই চিন্তা, মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানো যাবে কী ভাবে।  কিন্তু সবার আগে তো একটা সাউন্ডিং রকেট পাঠাতে হবে। সেটা কী ভাবে সম্ভব, কোথা থেকে রকেট লঞ্চ হবে, তা নিয়ে অঙ্ক কষে যাচ্ছিলেন তিনি। গভীর চিন্তার মধ্যে দিয়ে আর অঙ্ক কষে সারাভাই পছন্দ করলেন ভারত মহাসাগরের তীরের একটি জায়গা। কিন্তু যেখান থেকে রকেট লঞ্চ করবেন ভেবেছেন, থুম্বা গ্রামের সেই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি গির্জা।  ধর্মস্থান বাধ সাধবে না তো বিজ্ঞান গবেষণায়— চিন্তায় পড়লেন সারাভাই। একদিন অবশ্য এপিজে আব্দুল কালামের মতো সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেলেন থুম্বায়। সেন্ট মেরি ম্যাগডালেন্স চার্চের পাশেই  ত্রিবান্দ্রমের তৎকালীন বিশপ রেভারেন্ড পিটার বার্নাডের বাড়ি। বিশপের সঙ্গে দেখা করে সারাভাই চেয়ে বসলেন গির্জা ও আশপাশের সব জমি।

বিশপকে বললেন, এই গির্জাই সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। এখান থেকেই রকেট উৎক্ষেপণ করতে চাই আমরা। সব শুনে বার্নাড বললেন, কথা দিতে পারছি না। তবে পরের রবিবার একটা সভার আয়োজন করব গির্জায়। আপনারা আসুন। দেখা যাক, কী হয়! রবিবারের সভায় ঠিক কী হয়েছিল, কালাম তার সুন্দর  বর্ণনা  করেছেন ‘ইগনিটেড মাইন্ডস: আনলিশিং দ্য পাওয়ার উইদিন ইন্ডিয়া’ বইয়ে।  কালাম লিখেছেন, ‘‘বিশপ সেদিন সবাইকে বলেছিলেন— আজ আমার সঙ্গে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী রয়েছেন। তিনি মহাকাশ গবেষণার জন্য আমাদের গির্জাটি চাইছেন। আমি যেখানে থাকি, সেই এলাকাটাও। দেখো, বিজ্ঞান সত্যকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করে। উন্নত করে তোলে মানুষের জীবনকে। আর ধর্মের উচ্চস্তরে থাকে আধ্যাত্মিক ভাবনা। মানুষের মনে শান্তি নিয়ে আসতে ধর্মপ্রচারকেরা ঈশ্বরের সহযোগিতা চান। সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিক্রম যা করছেন আর আমি যা করছি, তার মধ্যে কোনও ফারাক নেই।  দেহ মনে মানুষের উন্নতির কথা ভেবে আমরা দু’পক্ষই ঈশ্বরের আশীর্বাদ চাইছি। তাই জানতে চাইছি, ঈশ্বরের আবাসকে আপনারা বিজ্ঞানের কাজে সপে দিতে রাজি আছেন?’’ কালাম লিখেছেন, মুহূর্তের নীরবতা। তারপরেই  সভা থেকে আওয়াজ উঠল, আমেন…। তবে তা-ই হোক।

চার্চ অনত্র  সরে গেল। সারাভাই আর তাঁর দলের তরুণ বিজ্ঞানীরা বিশপের বাড়িটিকে অফিসে রূপান্তরিত করলেন। গির্জাকে ওয়ার্কশপে পরিণত করা হল। গবাদি পশুর থাকার জায়গাগুলিতে গুদামঘর আর পরীক্ষাগার বানানো হল।  টাকাপয়সা খুবই সামান্য। একটা মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা মেটানোর মতো সুযোগও নেই। কিন্তু বিচলিত হলেন না বিজ্ঞানীরা। দিনরাত এক করে তাঁদের প্রথম রকেট তৈরি করতে শুরু করে দিলেন।

 মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান সারাভাই বেছে বেছে কয়েকজন বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারকে পাঠালেন নাসায়। সাউন্ডিং রকেট তৈরির প্রশিক্ষণ নেওয়ার  জন্য। সেই দলে ছিলেন এপিজে আব্দুল কালাম, প্রবীণ বিজ্ঞানী আর আরাভামুদান। 

প্রাথমিক পর্যায়ে থুম্বায় কোনও ক্যান্টিন ছিল না। বিজ্ঞানীরা সকাল ও রাতের খাবারের জন্য প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে ত্রিবান্দাম স্টেশনে যেতেন। ব্রেকফাস্ট করার সময়েই দুপুরের খাবার প্যাক করে নিয়ে আসতেন। থুম্বায় বিজ্ঞানীদের নানা জায়গায় যেতে হতো হয় হেঁটে নতুবা সাইকেলে। কারণ, একটাই মাত্র জিপ। আর সেটা সারাদিন ব্যস্ত থাকতো অন্য কোনও কাজে। ছুটির দিনগুলিতে  বিজ্ঞানীদের একমাত্র যাওয়ার জায়গা সিনেমা হল। এ ভাবেই প্রায় ছ’মাস ধরে চলল রকেট তৈরির কাজ।

অবশেষে এল সেই দিন । ২১ নভেম্বর ১৯৬৩।  ভারত তার প্রথম রকেট উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত ।  গির্জার পাশে সমুদ্র সৈকতে উপস্থিত অনেক গ্রামের মানুষ। সঙ্গে স্কুলের ছাত্রছাত্রী। উপস্থিত ভারতের পারমাণু কর্মসূচির জনক ডঃ হোমি ভাবা।  এসেছেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটিওরোলজির প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক ডঃ পি আর পিরশোটি। ঘটনার সাক্ষী হতে এসেছেন সেই বিশপ, জেলা কালেক্টর আর কেরলের রাজ্যপাল।

আজ ভাবতে অবাক লাগে, সে দিন রকেটটি লঞ্চ প্যাডে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সাইকেলের কেরিয়ারে বসিয়ে। কিন্তু উত্তোলনের আগে কিছু গোলমাল হয়ে গেল। লঞ্চারে রকেট স্থাপন করার জন্য যে হাইড্রোলিক ক্রেনটি ছিল, সেটি ফুটো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু উপস্থিত বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়াররা দমলেন না। তারা সেটিকে ম্যানুয়ালি ওখানে বসালেন। এর পরে দেখা গেল, লঞ্চারের দূরবর্তী সিস্টেমটি খারাপ হয়ে গিয়েছে। সেটিকেও ঠিক করা হল। এবার উৎক্ষেপণ হবে রকেট। অ্যালার্ম বেজে উঠল। দমবন্ধ হয়ে আসছে সমস্ত বিজ্ঞানীদের। কী হয়, কী হয় ?

সন্ধে ৬টা ২৫ মিনিট। সারা বিশ্ব দেখল, ভারত তার প্রথম রকেট সফল ভাবে উৎক্ষেপণ করেছে।  রকেটটি উড়ে চলেছে আকাশের দিকে। আর  আকাশে সোডিয়াম বাষ্পের মেঘ জমা হয়েছে। অস্তগামী সূর্যের কমলা রঙের আভায় দূর থেকে তা দেখা যাচ্ছে । উচ্ছ্বসিত ডঃ সারাভাই বাড়িতে টেলিগ্রাম পাঠালেন। কালাম জানিয়েছেন, পরের দিন সারাভাই কী ভাবে খুশিতে গোটা দলকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। মহাকাশে ভারতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ যানের স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তারপর থেকে বছর বছর ধরে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো ওই স্বপ্নদর্শী বিজ্ঞানীর স্বপ্নই শুধু পূরণ করেনি, আজ ভারতের মহাকাশ কর্মসূচিকে বিশ্বের ঈর্ষার বিষয় করে তুলেছে ।

এরপর ১৯৭৫ সালের ১৯ এপ্রিল  ভারত তার প্রথম স্যাটেলাইট, আর্যভট্ট  মহাকাশে উৎক্ষেপণ করল। স্বপ্ন পূরণ হল বিক্রম সারাভাইয়ের। কিন্তু তিনি তখন বেঁচে নেই।  ১৯৭১ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর।  তবে তাঁর বেছে নেওয়া মৎস্যজীবীদের সেই গ্রাম থুম্বাতেই আজ গড়ে উঠেছে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার। যা হয়ে উঠেছে ভারতীয় মহাকাশ কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দু।