আঞ্চলিকতার রূপ-রস-গন্ধ রক্ষিত থাকে লোকসংস্কৃতির উপর। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘লোকসংস্কৃতির চর্চা কেবলমাত্র ভদ্রলোকের অবসর বিনোদন বা নিছক অতীত অনুশীলন নয়, এর মধ্যে নিহিত রয়েছে সমাজ ও সভ্যতার মূল্যবান সব উপকরণ।’
গ্রাম্যসাহিত্য বা লোকসংস্কৃতি যা-ই বলা হোক না কেন, উত্তরবঙ্গ এই ক্ষেত্রে বরাবরই উচ্চতার শিখরে। লোকসংস্কৃতির মানচিত্রে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার লোকনাটকগুলি এখনও অনেক বেশি মৌলিক। কোচবিহার জেলার প্রান্তিক একটি জনপদে বেড়ে ওঠার ফলে গ্রাম্য, অনাড়ম্বর, পল্লিকেন্দ্রিক বহমান এই লোকসংস্কৃতির সাক্ষী হতে পেরেছিলাম সেই ছোটবেলাতে। শীতকালে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে হাট-ফিরতি লোকের ভিড়ে মিশে গিয়ে বসে পড়তাম ‘কুশান পালা’ দেখতে। ধর্ম ও পৌরাণিক কাহিনী নির্ভর সেই পালা’র একটি অংশে দেখেছিলাম ‘মিড-ডে মিলে’র প্রচার— বিদ্যার আলোতে এলে মেটে পেটের খিদে। স্কুল জীবন শেষ করার বারো বছর ফিরে এসে গ্রামের আশপাশের হাটগুলিতে গিয়েছিলাম অনেকবার। কিন্তু দেখা পাইনি ‘কুশান পালা’-র।

উত্তরবঙ্গের লোকাচার ও সামাজিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভাবে বুঝতে হলে এই লুপ্তপ্রায় লোকনাটকগুলির ভিডিওগ্রাফি, সুপরিকল্পিত বিশ্লেষণ আরও আধুনিক ভাবে করার প্রয়োজন। সীমিত রসবোধে নির্মিত এই লোকনাটকগুলি’তে একদিকে যেমন সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষায় জোর দেওয়া হয়, অন্যদিকে লোক-সাংবাদিকতার (Folk Journalism) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতো পালাগুলি। কোন রেশন ডিলার কেমন চাল দিচ্ছে, আশপাশের গ্রামে কোনও অসুখ ছড়িয়েছে কি না, কোন রাজনৈতিক নেতা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত— এইসব কিছু গানের সুরে মিলিয়ে পরিবেশন করা হয়।
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় লোকনাটকগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত। কোচবিহারে এর নাম ‘পালা’। জলপাইগুড়িতে ‘ধামগান বা পালাটিয়া’। উত্তর দিনাজপুরে ‘খনগান’, মালদায় ‘পালা বা খেল’, দার্জিলিংয়ের সমতল ভূমিতে এর নাম ‘নটুয়া।’
কোচবিহারের ‘কুশান পালা’য় গ্রাম্য আঞ্চলিকতার স্বাতন্ত্র অনেক বেশী লক্ষণীয়। ‘কুশান পালা’র মূল গায়ক ‘গিদাল’— তার হাতে থাকে ‘দোতারা।’ ‘গিদালে’র সঙ্গে থাকেন ‘দোয়ারী।’ এই ‘পালার’ আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ‘ছোকরা’। প্রথম দিকে কিশোর বয়সী পুরুষরাই মহিলা সেজে বৃত্তাকারে নেচে-নেচে গান করতেন। পরবর্তী সময়ে মেয়েরাই ওই ভূমিকায় নামতে শুরু করলে দর্শকদের আকর্ষণ আরও বেড়ে যায়। মূল গায়ক ‘গিদাল’ পালাটি গেয়ে যায়, ‘দোয়ারী’ অভিনয় করে। ‘ছোকরা’রা হাসায়-কাঁদায়। গিদালের তৈরি করা গানে অনেক সময়ই জনপ্রিয় সিনেমা বা আধুনিক গানের সুর প্রয়োগ করা হতো। যেমন একটি পালায় দেখেছি ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা’— এই বিখ্যাত আধুনিক গানটির সুরে ‘আই অ্যাম ভেরি সরি, তাইতে ভেবে মরি, এখন আমি কী করি হায়…’ এই গানটি গিদালের সঙ্গে সমস্বরে গেয়ে গেয়ে ছোকরারা নেচে উঠছে।

মূলত পৌরাণিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করে রচিত হয় পালাগুলি তবে এখন অনেক জায়গায় স্বরচিত কাহিনীও উপস্থাপিত হচ্ছে। কুশান গানের উল্লেখযোগ্য পালাগুলি হল, লক্ষ্মণের শক্তিশেল, দানবীর হরিশ্চন্দ্র, বেহুলার ভাসান প্রভৃতি। পালাগুলি মূলত শীতকালে গ্রামের খোলা মাঠে বা হাট শেষের পড়ন্ত বিকেলে বাজারের এক কোণে কিছুটা খোলা জায়গায় পরিবেশিত হয়। দর্শকরা বৃত্তাকার হয়ে বসে উপভোগ করেন গ্রাম্য ভাষায় রচিত কুশান পালাগুলি।
মালদার ‘গম্ভীরা’ লোকনাটকে শিবের বন্দনা করা হয়। শিব এখানে কৃষক বা গ্রামের মোড়ল রূপে গ্রামবাসীদের কথা শোনেন। ‘গম্ভীরা’ গানের শেষ অংশকে বলা হয়-সালতামামি। সারা বছর ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয় দর্শকদের সামনে। তাই প্রতিবছর ‘গম্ভীরা’র বিষয়বস্তুও ভিন্ন হয়ে থাকে।
লোকনাটকগুলি শুধু লোকসাহিত্যের একটি অংশ নয় এগুলি এক একটি সম্পদ। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে ‘ইনট্যানজিবল রিসোর্স।’ লোকনাটকগুলি লুপ্ত হয়ে গেলে শুধু গ্রাম্যসাহিত্য বা লোকসংস্কৃতির ক্ষতি নয়, ক্ষতি গ্রামীণ সম্পদের।

ছবি indian culture.nic.in এর সৌজন্যে