(আজকের দিনেই তামিলনাড়ুর শ্রীপেরামবুদুরে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যা করেছিল এলটিটিই-র জঙ্গিরা। তারপর থেকেই এই দিনটি ‘সন্ত্রাসবাদ বিরোধী দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কী ভাবে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে কিংবা প্রতিবেশী দেশ থেকে তাতে মদত দেওয়া হচ্ছে কীভাবে, তা রোজই দেখছি আমরা। তবে আমাদের আজকের আলোচনায় উঠে এসেছে বর্হিবিশ্বে সন্ত্রাসবাদের বিভিন্ন রূপের কথা। গোটা বিশ্বে কোন পথে চলেছে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম— তা নিয়েই এই প্রতিবেদন।)

দু’বছর ধরে গোটা পৃথিবী কোভিড মহামারীতে আক্রান্ত। মানুষ আরও নিঃসঙ্গ হয়েছে, কাজ হারিয়েছে,সর্বোপরি জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশে বেড়ে চলেছে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের আশঙ্কা। ২০১৪ সালের পর থেকে সংখ্যাতত্ত্বে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের প্রবণতা কমছিল। বিগত বছরের (২০২১) নানা দিক থেকে যে সন্ত্রাসী হুমকির উদাহরণ আমাদের সামনে আসছে সেটা অনেক বিস্তৃত, বিচিত্র এবং ভীতিপ্রদ। তাই অনেকের মনেই আশঙ্কা, আগামী দিনের সন্ত্রাসবাদ কি আরও ভীতিপ্রদ, আরও বিচিত্র, আরও তীব্র হবে? 

দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে সন্ত্রাসবাদের যে ধারাগুলি সামনে আসছে, তা অবশ্য খুবই বিচিত্র। অনেক সময়েই দেখা যাচ্ছে, একটি মতাদর্শ অন্যটির বিরোধী। কিন্তু কোনও একটি উদ্দেশ্যে তারা এক হয়ে আঘাত হানছে। সন্ত্রাসবাদীদের কোনও শাখা সহিংস নৈরাজ্যবাদী ও নারী বিদ্বেষী। কেউ কেউ আবার নারীকে যৌনদাসী বানাতে তৎপর। আবার কোনও কোনও জঙ্গি কার্যকলাপে অনেকগুলি মতাদর্শের মিলিত রূপ সামনে আসছে।

সন্ত্রাসবাদের বিচিত্র কয়েকটি রূপ হল,

১। টেকনোফোবিয়া বা নব্য লুদাই — ১৮১১ সালে ইয়র্কশায়ার ও নটিংহামশায়ারে ব্রিটিশ টেক্সটাইলে কর্মরত শ্রমিকদের একটি গ্রুপের কার্যকলাপ। এরা বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি-বিরোধী দর্শনের পক্ষে দাঁড়ায়। এদের বলা হতো লুডিইট। আজকের দিনের নব্য লুদাই মতবাদ এমন একটি দর্শন, যা আধুনিক প্রযুক্তির বিরোধিতা করে।

২।  মিসজিনিস্ট— মিসোজিনি হল নারীদের প্রতি ঘৃণা, অবজ্ঞা বা কুসংস্কার। এটি যৌনতাবাদের একটি রূপ যা পুরুষদের তুলনায় নারীদের নিম্ন সামাজিক অবস্থানে রাখে।

৩। ইনসেল মতাদর্শ—একটি অনলাইন অপসংস্কৃতির সদস্যদল, যারা নিজেদের যৌনসঙ্গী পেতে অক্ষম বিবেচনা করে। তাদের আলোচনায় উঠে আসে ঘৃণা, দুর্ব্যবহার, অসন্তুষ্টি, আত্ম-মমতা এবং আত্ম-ঘৃণা, বর্ণবাদ। নারী ও যৌন সক্রিয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এরা আঘাত করে। ২০১৮ সালে টরেন্টোতে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণে ১০ জন লোক মারা যান। পুলিশের দাবি, এর পিছনে রয়েছে ইনসেল গোষ্ঠীর লোকেরা।

৪। সালাদ বার মতাদর্শ—সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের মিলন।  হয়তো একটি মতাদর্শ অন্যটির বিরোধিতা করছে কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা একটি কমন বিষয়ে একত্রিত হয়ে যাচ্ছে।

অনেকেরই ধারণা, আগামী দিনে প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী হুমকি জিহাদিবাদ এবং অতি-ডান চরমপন্থা থেকে আসার সম্ভাবনা।  বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি তো রয়েইছে। এমনকি, কোভিড মহামারীর সময়েও হিংসাত্মক প্রতিবাদ আমাদের সামনে এসেছে। ইতালিতে অ্যান্টি-ভ্যাক্সাররা (anti-vaxxers- যারা ভ্যাকসিন নিতে চায় না)) অতি ডান চরমপন্থীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে হিংসাত্মক প্রতিবাদকে উস্কে দিয়েছে। সেই আন্দোলন ক্রমশ ইউরোপের গন্ডি ছাড়িয়ে আমেরিকা, কানাড়া ও অস্ট্রেলিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে।

২০২২ -এ গোটা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ কোন দিকে মোড় নিতে পারে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞেরা কিছু ধারনা করেছেন।

শুরু করা যাক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দিয়েই। কবে যুদ্ধ থামবে, তার ইঙ্গিত নেই। মনে করা হচ্ছে, সংঘাতের ফলে এই অঞ্চলে উগ্র ডানপন্থী চরমপন্থীদের আগমন ঘটতে পারে। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য এবং নব্য-নাৎসি মতাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত বিদেশী যোদ্ধারা ইউক্রেনে ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই চরমপন্থীরা যুদ্ধ শেষে এই অঞ্চলগুলিতে নতুন ঘাঁটি করে তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের চেষ্টা করতে পারে।

আফগানিস্তানের দিকে তাকানো যাক। আমেরিকা সেনা সরিয়ে নেওয়ার পর সেখানে ক্ষমতায় রয়েছে তালিবান। কিন্তু আইএসকে-র (ISKP -The Islamic State – Khorasan Province) আক্রমণ বেড়ে গিয়েছে। বিক্ষোভ দমনে তালিবানের কঠোর মানসিকতা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা সঙ্কটকে বাড়িয়ে দিয়েছে।  মনে করা হচ্ছে, আগামী দিনে এই সঙ্কট আফগানিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। যদি তা হয়, বিদেশী যোদ্ধারা আশপাশের অঞ্চল থেকে আইএসকে এবং আল-কায়েদার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে যোগদান করবে। এমনিতেই আল কায়দা ও আইএস আফ্রিকা জুড়ে নিরন্তর তাদের প্রসার ঘটাচ্ছে। আফগানিস্তানে তাদের বিচরণভূমি হয়ে উঠলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব পড়তে পারে। বৃদ্ধি পেতে পারে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ।

আফগানিস্তানে যা ঘটছে, তার দিকে নজর রেখে বলা যায়, পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্র তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে আরও সক্রিয় হবে। আফগানিস্তানে সংখ্যালঘু শিয়া হাজারা গোষ্ঠীকে আইএসকে গোষ্ঠীর হাত থেকে বাঁচাতে সক্রিয়তা দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ইরান প্রশিক্ষিত ও সজ্জিত আফগান শিয়া হাজারা যোদ্ধাদের একটি নেটওয়ার্ক লিওয়া ফাতেমিয়ুন ব্রিগেড মোতায়েন করতে পারে। সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আরও বিস্তৃত ভাবে দেখা যেতে পারে।

মধ্য এশিয়ার দেশ ইরান যদি ইউরেনিয়াম সংগ্রহ ও গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকে এবং পরমাণু অস্ত্র বানাতে পারে, তবে ইজরায়েলের বসে থাকার সম্ভবনা কম। আর ইজরায়েল যদি হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে তবে ইরান লেবানিজ হিজবুল্লাহ-র মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির মাধ্যমে ইজরায়েলের অভ্যন্তরে আক্রমণ শানাতে পারে। লেবানিজ হিজবুল্লাহ এমন একটি গোষ্ঠী, যারা পৃথিবী জুড়ে ইজরায়েলের অনেক লক্ষ্যবস্তুর উপরে নানা সময়ে আঘাত করেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার কিছু দেশ তাদের  বিদ্রোহী গোষ্ঠীর থেকে নতুন দফায় সন্ত্রাসী হামলার সম্মুখীন হতে পারে। ২০২২ সালেও ইসলামিক স্টেট সেন্ট্রাল আফ্রিকা প্রদেশ (ISCAP) এবং ইসলামিক স্টেট খোরাসান (ISK) মারাত্মক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের সহযোগীদের মধ্যে থাকবে। সমগ্র সাব-সাহারান আফ্রিকা জুড়ে, ইসলামিক স্টেটের সাথে যুক্ত জিহাদি গোষ্ঠীগুলিগুলি খুব দ্রুত শক্তি বাড়াচ্ছে। কঙ্গোতে আইএসসিএপির শাখা (ডিআরসি) উগান্ডায় হামলার দায় স্বীকার করেছে। একই সময়ে, মোজাম্বিকের ইসলামিক স্টেট ফ্র্যাঞ্চাইজি (আইএসসিএপি নামেও পরিচিত) তানজানিয়ায় আন্তঃসীমান্ত আক্রমণ করার দায় শিকার করেছে। আফ্রিকান নিরাপত্তা বাহিনী এই ধরনের সন্ত্রাস আটকাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এছাড়া, ইথিওপিয়ায় টাইগ্রিয়ান পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। বামপন্থী মতাদর্শ এবং জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) এবং পিপলস প্রোটেকশন ফোর্সেস (ওয়াইপিজি) তুরস্ক এবং সিরিয়ায় সক্রিয় রয়েছে।

সবশেষে আর একটা কথা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হামলার পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনছে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি। এমনতিতেই তাদের হাতে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্রশস্ত্র। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী দিনে আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে হামলা চালাতে চেষ্টা করবে জঙ্গিরা। ২০২১-এর নভেম্বরে বিস্ফোরক-বোঝাই ড্রোন ইরাকি প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা কাদিমিকে হত্যা  করার চেষ্টা করেছিল। এই হামলা ২০১৮ সালের এপ্রিলে ভেনেজুয়েলার নেতা নিকোলাস মাদুরোকে ড্রোন দিয়ে হত্যা করার চেষ্টার কথা মনে করিয়ে দেয়। ফলে শীর্ষস্থানীয় কোনও নেতার উপর হামলা চালাতে এবছরও সন্ত্রাসবাদীরা ড্রোন-হামলার ছক কষবে না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়?