গত ৩০ মিনিট ধরে গুগল ম্যাপের দাক্ষিণ্যে ভুল জায়গায় ঘোরাঘুরি করে রাস্তার পাশের একটা বটগাছের নিচে এসে বসলাম। পাশেই ধান ক্ষেতে কাজ করছিলেন মাঝবয়েসি এক ভদ্রলোক। আমাকে এতক্ষণ যাবৎ ঘোরাঘুরি করতে দেখছিলেন বোধহয়। জমি থেকে উঠে এসে বললেন, ‘কুত্তি যাইবেন?’ বললাম, ‘খান চৌধুরী আমানতউল্লা আহমদের বাড়ি।’ হাত তুলে তিনি যে দিকটা দেখালেন তা গুগল ম্যাপের দেখানো জায়গার সম্পূর্ণ উল্টো দিকে। ‘জোড়া পুকুর পার করি উল্টাপাকে যেই রাস্তাখান ডাইনে চলি গেইছে সেইটা দিয়া যাও। মসজিদের উল্টাপাকে দেখা পাইবেন খাঁ সাহেবের ভাঙা বাড়ি।’ তাঁর নির্দেশিত পথেই সাইকেল চালালাম। একদম ঠিক। খুঁজে পেলাম খাঁ সাহেবের পৈতৃক ভিটে।
খান চৌধুরী আমানতউল্লা আহমদ ছিলেন কোচবিহার রাজ্যের শেষ রাজস্বমন্ত্রী। এক্ষেত্রে স্বাধীন কোচবিহার রাজ্য বলা যাবে না কারণ, ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ই এপ্রিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে একটি সন্ধি হয় কোচবিহার রাজার। সেই সন্ধি অনুযায়ী কোচবিহার রাজ্য তার সার্বভৌমত্ব হারিয়ে কোম্পানির একটি করদ মিত্র রাজ্যে পরিণত হয়। আমানতউল্লা আহমদ মন্ত্রী হিসেবে নন, তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ যা এই জেলার ইতিহাস চর্চার একটি অসামান্য দলিল, তার লেখক হিসেবে।

মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণের সময় থেকে আমানতউল্লা সাহেব কোচবিহারের ইতিহাস লেখার কাজটি শুরু করেন। যদিও বিশ শতকের প্রথম দিকে কোচ রাজাদের আনুকূল্যে বেশ কয়েকটি ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থ রচিত হয়। কিন্তু সেগুলির ঐতিহাসিক ভিত্তি ছিল নিতান্তই দুর্বল। ১৯০৩-এ প্রকাশিত হয় হরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর ‘কোচবিহার স্টেট অ্যান্ড ইটস ল্যান্ড রেভিনিউ সেটেলমেন্ট।’ বিভিন্ন নথি পত্রের ভিত্তিতে গ্রন্থিত এটিই ছিল কোচবিহার রাজ্যের প্রথম প্রমাণিত ইতিহাস। পরে মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণের উৎসাহে আমানতউল্লা বাংলায় বিস্তারিত ইতিহাস লেখার কাজ শুরু করেন। প্রচুর অধ্যবসায় নিয়ে বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করে এই কঠিন কাজটির অনেকটাই শেষ করেন তিনি। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে শেষ রাজা জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণের সময় আমানতউল্লা সাহেবের ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ নামক বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। ১৫১৫-১৭৮৩ পর্যন্ত সময়ের বিবরণ পাওয়া যায় সেই বইটিতে। শুধু রাজপরিবারের ইতিহাস নয়, বইটি সমকালীন ও ফেলে আসা সময়ের একটি জীবন্ত দলিল। কোচবিহার রাজ্যের বিভিন্ন জনপদ আর তার সঙ্গে জুড়ে থাকা আঞ্চলিক ইতিহাস। স্থাননামে মিশে থাকা আঞ্চলিক লোককথা ও ইতিহাসের উপস্থিতি বইটিকে করে তুলেছে অমূল্য। আজও যারা কোচবিহারের ইতিহাস বা প্রাচীন উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন তাদের জন্য আকর গ্রন্থ এটি।

কোচবিহারের শিতলকুচি ব্লকের বড়মরিচা গ্রামে এই রকম একজন গুণী মানুষের পৈতৃক ভিটের সামনে দাঁড়িয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়িটি ঢেকে গিয়েছে আগাছায়। রক্ষণাবেক্ষণের কোনও রকম প্রয়াস নেই। এলাকার পুরনো কিছু মানুষজন ছাড়া খান চৌধুরী আমানতউল্লা আহমদের নাম বিশেষ কেউ জানেও না। প্রাচীন লালবাজার পরগণার একটি অংশ হল এই বড়মরিচা। এর ইতিহাস বহু পুরনো। আজ থেকে প্রায় ১১০০ বছর আগেও এই অঞ্চলের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের পাশেই অবস্থিত আদাবাড়ি অঞ্চল থেকে মাঝে মাঝে চাষের জমিতে পাওয়া যায় পাল ও খেন রাজার আমলের নিদর্শন হিসেবে অনেক জিনিসপত্র। তবে এই প্রাচীন অঞ্চলে সেরকম কোনও পুরনো বাড়িঘরের নিদর্শন পাওয়া যায় না। সেই দিক থেকে আমানতউল্লা আহমদের এই বাড়িটির গুরুত্ব অনেক। এর রক্ষণাবেক্ষণের আশু প্রয়োজন। বড় বড় ইঁট ও চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত ১৮-কক্ষ বিশিষ্ট বাড়িটি এখন এলাকার গবাদিপশু রাখার জায়গা। বাড়িটির সামনে একটি কুয়ো আছে যা এখন জঞ্জালের স্তূপ।

তৎকালীন সময়ে রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবেও যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল আমানতউল্লা আহমদের। কোচবিহার হিতসাধনী সভা ও অঞ্জুমান ইসলামিয়া নামে দুটি সংগঠনের সভাপতি ছিলেন তিনি। স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তী– এই দুই পর্বের মাঝখানে একটি অন্তর্বর্তী পর্ব আছে যাকে কোচবিহারের ট্রানজিশন বা উত্তরণের স্তরের পূর্ববর্তী ধাপ বলে চিহ্নিত করা যায়। এই সময় কোচবিহার রাজ্যে কিছুটা অস্থির অবস্থা তৈরি হয়। ওই সময় পদস্থ চাকরিতে বহিরাগত বা অভিবাসী বাঙালি ও অবাঙালিদের আধিপত্যের ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল। এই ব্যাপারে হিতসাধনী সভা খুব সরব ছিল। এই সভার প্রতিষ্ঠা হয় ১৮ই মে, ১৯৪৭। এর সভাপতি ছিলেন খান চৌধুরী আমানতউল্লা। কোচবিহার থেকে বহিরাগতদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না দেখে সভার কিছু সদস্য আন্দোলনের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেয়।

সভার মুসলিম সদস্যরা কোচবিহারকে পাকিস্থানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। কিছু কিছু গবেষকদের মতে সেই আন্দোলনের মুখ ছিলেন খান চৌধুরী আমানতউল্লা আহমদ। হয়ত এ কারণেই ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ লেখার পরেও তিনি থেকে গিয়েছেন খলনায়ক। তাই তাঁর পৈতৃক ভিটের উপর কোন নজরই দেবার প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ।
ইতিহাস বড় নির্মম। বিভিন্ন পরিস্থিতি থেকে সৃষ্টি হওয়া ঘটনাপ্রবাহকে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে বিচার করা কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, খান চৌধুরী আমানতউল্লা আহমদের অবদান কোচবিহারের ইতিহাসে লেখা থাকবে একজন সুদক্ষ ইতিহাস-প্রণেতা হিসেবে, যেখানে রাজনৈতিক চাওয়া-পাওয়ার কোন স্থান নেই।