(মানুষ নাকি জগতের শ্রেষ্ঠ জীব। এই গর্ব ভাঙতেই একদিন লন্ডনের চিড়িয়াখানায় খাঁচায় রাখা হয়েছিল মানব প্রজাতিকে। লিখেছেন চণ্ডিকাপ্রসাদ ঘোষাল।)

বেকারত্বের জ্বালা বুকে নিয়ে শিক্ষিত বাঙালি যুবকের উপার্জনের আশায় চিড়িয়াখানার খাঁচায় দ্রষ্টব্য হয়ে ঢুকে পড়ার কৌতুককর গল্প আমরা অনেক শুনেছি। তেমনি আবার পড়েছি বারট্রাম শ্যাণ্ডলারের ‘দ্য কেজ’ নামে সেই কাহিনী যেখানে ঘটনাচক্রে অন্য এক গ্রহে পৌঁছে জনাকয়েক নরনারী সেখানকার প্রাণীদের হাতে খাঁচাবন্দি হয়ে ছটফটায়। তারা অবাক হয়ে ভাবে, মানুষের মতো বুদ্ধিমান জীবকেও তাহলে খাঁচায় বন্দি করে রাখা যায়? এই গ্রহের প্রাণীরা তবে কতো বুদ্ধিমান!

হ্যাঁ, মানুষকেও খাঁচায় পুরে ফেলা যায়। এবং তা ঘটেছে অন্য কোনও গ্রহে নয়, এই পৃথিবীতেই। লন্ডন শহরের চিড়িয়াখানায়। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের অগাস্টের শেষাশেষি। আচমকাই এক সকালে লন্ডন জু-র একটি খাঁচার ভেতরে পাথুরে ঘেরাটোপের মধ্যে দেখা গেল আট জন স্বল্পবাস নরনারীকে। তিনজন পুরুষ এবং পাঁচজন নারী। পরণে তাদের স্নানপোষাক ও ডুমুর পাতার আবরণ। আর খাঁচার ঠিক বাইরে একটি সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা ‘সতর্কতা: মানুষ এখানে তাদের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশে’। এই খাঁচাবাসী মানব-মানবীরা রোদে বসে হাত নাড়ছে, পরস্পর কথাবার্তা বলাবলি করছে। সাইন বোর্ডে অন্যান্য খাঁচার মতোই আরও লেখা রয়েছে তাদের খাদ্যাভ্যাস, বাসস্থান, বিশ্বব্যাপী তাদের অবস্থান, বিপন্নতা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য। অন্য প্রাণীদের খাঁচার সঙ্গে এদের খাঁচার ব্যবধান শুধুই একটি বৈদ্যুতিক তারের পাঁচিল।

এর একশো বছর আগে, ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ওটা বেঙ্গা নামে পিগমি উপজাতির এক ২৩ বছর বয়সী যুবককে নিউ ইয়র্কের বৃহত্তম চিড়িয়াখানায় বাঁদরের খাঁচায় পুরে প্রদর্শন করা হয়েছিল। আরও বেশি সংখ্যক দর্শক টানার জন্য তাকে একটি বড় খাঁচায় সরিয়ে একটি ওরাংওটাংয়ের সঙ্গে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সে ঘটনা বর্ণবিদ্বেষের চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে রয়েছে। বিশ্বজুড়ে যা নিন্দার ঝড় তুলে দিয়েছিল।

লন্ডনের চিড়িয়াখানার ঘটনা তার পুনরাবৃত্তি নয়। এখানে আগত দর্শনার্থীরা দেখছে, দাঁড়িয়ে পড়ছে, মজা পাচ্ছে, খিলখিলিয়ে হাসছে আর বিস্ময়ের সুরে পরস্পরকে জিজ্ঞেস করছে, ‘এই মানুষগুলো ওখানে কেন’? উৎসাহে উদ্বেল চিড়িয়াখানার কর্মকর্তারা গদগদ কন্ঠে জানান, ‘আমরা তো এই প্রশ্নটারই উত্তর দিতে মুখিয়ে রয়েছি’। কী সে উত্তর? তাঁরা বলেন, ভিন্ন পরিবেশে, অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে থাকার ব্যাপারটা মানুষকে তার বারফট্টাই থেকে মুক্ত করে এটা বুঝতে শেখায় যে তারাও নিছকই একটি প্রজাতি। তারাও খাঁচার বাইরে থাকা মানুষদের হাঁ করে তাকিয়ে থাকার সুযোগ দেয়।

এখন প্রশ্ন হল এই খাঁচাবন্দি মানব-মানবীদের নিশ্চয়ই রাস্তা থেকে তুলে এনে পিঞ্জরে ভরে দেওযা হয়নি। তাহলে তারা এসে জুটলো কোত্থেকে? প্রথমত, একটি অনলাইন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখান থেকে ৩০ জনকে পছন্দ করা হয়। মনোনীত এই প্রার্থীদের মধ্যে থেকে চূড়ান্ত বাছাই করা হয় ৮ জনকে। পেশাগত ভাবে তাদের মধ্যে কেউ কেমিস্ট, কেউ অভিনেতা, কেউ বা মডেল, আবার কেউ ফিটনেস বিশেষজ্ঞ। কেমিস্ট যিনি, তাঁর নেশা মানুষকে বাঁদরদের সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। তাঁর মতে, অনেকে মনে করে মানুষ অন্যান্য সব প্রজাতির চেয়ে উচ্চতর শ্রেণির। এখানে যখন সবাই আমাদের অন্যান্য জীবদের পাশাপাশি দেখতে পাবে, তখন তাদের এই চেতনা আসবে যে মানবজাতি ততটা আলাদা বা বিশিষ্ট কোনও প্রজাতি নয়। তারা প্রায় আর পাঁচটা জীবেরই মতো।

এই মানব-প্রদর্শরা যাতে পিঞ্জর-জীবনে একঘেয়েমির শিকার হয়ে না পড়ে সেজন্য নানান রকম খেলাধুলোর ব্যবস্থা ছিল তাদের জন্য। তবে অন্যান্য প্রাণীদের মতো খাঁচার জীবনকে তাদের বিধিলিপি বলে শিরোধার্য করতে হয় নি। চিড়িয়াখানা বন্ধ হয়ে গেলে তারা রাতে বাড়ি ফিরতে পারতো। আর জানিযে রাখা জরুরি, এই প্রদর্শ-পিঞ্জরটি আর পাঁচটা খাঁচার মতো স্থায়ী পাকাপোক্ত ব্যবস্থা হিসেবে গৃহীত হয়নি। এটি ছিল মাত্র চারদিনের প্রতীকি চমক, ২৬ থেকে ২৯ , ২০০৫ পর্যন্ত স্থায়ী। মানব সমাজের কাছে নির্ধারিত একটি সদর্থক বার্তাটি পাঠানোর স্বার্থে।