(আলফ্রেড নোবেলের রেখে যাওয়া অর্থ থেকেই আসে নোবেল পুরস্কারের টাকা। কিন্তু বসে খেলে তো কুবেরের ধনও শেষ হয়। এত বছর ধরে এই বিপুল পরিমাণে ধনরাশি নোবেল কমিটি পাচ্ছে কোথা থেকে? কোথায় খাটানো হয় নোবেলের রেখে যাওয়া অর্থ? লিখেছেন সঞ্জয় গুপ্ত।)

১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর, ৬৩ বছর বয়সে  আলফ্রেড নোবেল মারা গেলেন, ইতালিতে।  ১৮৬৭ সালে, ডিনামাইটের আবিষ্কারক এই ভদ্রলোক, ইচ্ছাপত্র লিখে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য যে সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন, তার মূল্য সেই সময়ে ছিল ৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার। ভারতের হিসাবে আজকের দিনে ২৩.৯৪ কোটি টাকা। ভুল লিখছি, টাকাটা রাখা হয়েছিল ১৮৯৬ সালে। সেই হিসাবে ধরলে আজকের মূল্যে দাঁড়ায় ১৭০২ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার। অর্থাৎ, প্রায় ১৩১৮.৩৬  কোটি টাকা।

আলফ্রেডের উইল অনুযায়ী নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কথা, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ফিজিওলজি বা মেডিসিন, সাহিত্য এবং শান্তিতে। এখন ছয়টি বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়। সুইডেনের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক, ১৯৬৮ সাল থেকে  ইকনমিক্সে পুরস্কার দেয়ার অর্থ যোগান দেয়। বাছাই করেন অবশ্য নোবেল কমিটির সদস্যরা। পুরস্কার হিসাবে দেওয়া হয় একটি সোনার মেডেল, প্রশস্তিপত্র এবং অর্থরাশি। প্রাপককে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ভাষণও দিতে হয়।

বসে খেলে তো কুবেরের ধনও ক্ষয় হয়। তাহলে নোবেল কমিটি এতদিন ধরে পুরস্কার দিয়ে যাচ্ছে কী করে?  ২০১৯ সালের পুরস্কার মূল্য প্রতিটি বিভাগে ছিল নয় মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার। টাকার হিসাবে প্রায় সাত কোটি বাইশ লাখ টাকা। পরের বছর থেকে অর্থমূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে  ১০ মিলিয়ন মানে প্রায় ৭.৭২ কোটি টাকা। আসলে নোবেল পুরস্কারের টাকাপয়সা জোগাড় হয় আলফ্রেডের রেখে যাওয়া অর্থকে খাটিয়ে। যা ডিভিডেন্ট আসে, সেটাই ভাগ করে দেওয়া হয় প্রাপকদের। অর্থ খাটানো হয় ইকুইটি , ফিক্সড ফান্ড, সম্পত্তি এবং Hedge ফান্ডে। মোটামুটি ৫৫ শতাংশ শেয়ার বাজারের ইকুইটি ফান্ডে, ১০ শতাংশ ফিক্সড ফান্ডে, সম্পত্তিতে ১০ শতাংশ বাকি ২৫ শতাংশ অন্য ধরনের ফান্ডে। গোটা বিষয়টি পরিচালনা করেন চিফ ইনভেস্টমেন্ট অফিসার। ২০১২ সাল থেকেই ইনভেস্টমেন্টের ক্ষেত্রে জোর দেয়া হচ্ছে শেয়ার বাজারের ইকুইটি হোল্ডিং-এর উপর। আলফ্রেড তাঁর উইলে বলে গিয়েছিলেন, টাকাটা যেন “সেফ সিকিউরিটিজ”-এ বিনিয়োগ করা হয়। আলফ্রেডের রেখে যাওয়া টাকা তাই খুব ঝুঁকিপূর্ণ  কোনও কিছুতে খাটানো হয় না। মোটামুটি ৩.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা মেনে চলা হয়। এই ভাবে চলার ফলে, ফান্ডের মূল্য ২০১২ সালের ৩.৬ বিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার থেকে বেড়ে ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে ৪.৬ বিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার।

তবে, পুরস্কারের ক্ষেত্রে একটি সিদ্বান্ত নেওয়া হয়েছিল ২০১২ সালে। উইল অনুযায়ী,  যা বছরে রোজগার হবে, সেটাই ভাগ করে দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু ২০১২ থেকে  নিয়ম করা হয়েছে, কুড়ি শতাংশ রেখে দেওয়া হবে মূল ফান্ডের সঙ্গে। যাতে শেয়ার বা ইনভেস্টমেন্টের ওঠা নামায় পুরস্কারের অর্থমূল্য কমাতে না হয়।

পুরস্কার যদি যুগ্ম ভাবে দেওয়া হয়, তাহলে অর্থরাশি প্রাপকদের মধ্যে সমান ভাগ করে দেওয়া হয়। তবে প্রাইজ পেলেই যে সবাই নিয়ে নেন, তা নয়। কেউ কেউ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে নিতে আস্বীকার করতেই পারেন। তবুও তাঁদের নাম নোবেল প্রাপক হিসাবে লেখা হয়, সঙ্গে মন্তব্য থাকে— নিতে অস্বীকার করেছেন। সে ক্ষেত্রে কিংবা যে বছর কোনও বিশেষ বিষয়ে যোগ্য কাউকে পাওয়া যায়নি, তখন টাকাটা মূল ফান্ডে জমা করিয়ে দেওয়া হয়।  অনেক ক্ষেত্রে আবার সরকারি বাধায় পুরস্কার নেওয়া সম্ভব হয় না। যেমন, ১৯৩৭ সালে হিটলার জার্মানদের এই পুরস্কার নিতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। কারণ, তার দু’বছর আগে নোবেল শান্তি পুরস্কার নাজী বিরোধী সাংবাদিক Carl von Ossietzky কে দেওয়া হয়েছিল, যাঁকে হিটলার জেলে পুরেছিলেন। এইসব ক্ষেত্রে, পরে মেডেল ও প্রশস্তিপত্র প্রাপককে দেওয়া হয়। কিন্তু অর্থ নয়। সেই অর্থ মূল ফান্ডে জমা করিয়ে দেওয়া হয়।

এভাবেই প্রায় ১২২ বছর ধরে নোবেলের রেখে যাওয়া অর্থরাশি থেকে পুরস্কার দেওয়া চলছে।