(ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র রাসবিহারী বসু। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির প্রতিষ্ঠাতার জীবনের কাহিনী হলিউডি সিনেমাকেও হার মানাবে। আজ রাসবিহারী বসুর জন্মদিনে, ইতিহাসে উপেক্ষিত সেই মানুষটির অসাধারণ জীবনের কিছু অংশকে ফিরে দেখা।) 

হাতির পিঠে হাওদার উপরে বসে এগিয়ে চলেছেন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড চার্লস হার্ডিঞ্জ। দিল্লির চাঁদনী চক এলাকা দিয়ে এগিয়ে চলেছে শোভাযাত্রা। ব্রিটিশ সেনারা অস্ত্র হাতে ভাইসরয়কে ঘিরে রেখেছে। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। অসংখ্য মানুষজন কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে হার্ডিঞ্জের দিকে। আশপাশের মানুষজন ভাবছে, মুঘলদের পর এই শহরটা এবার ইংরেজেরও রাজধানী! ইংরেজরা তো একেবারে মুঘল সম্রাটদের জায়গায় বসতে চলেছে।

ইংরেজ শাসকের মনের ভিতরে ভয়ের চোরাস্রোত। বাংলার ‘বেয়াদপ’ বিপ্লবীদের জন্যই তো কলকাতা ছেড়ে চলে আসতে হল তাঁদের। কিন্তু শোভাযাত্রার আভিজাত্য শাসকের বুকের গভীরে থাকা সেই ভয়কে ছাপিয়ে উঠেছে। সবাই দেখুক, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য সত্যিই অস্ত যায় না।

আচমকা একটি বোমা কোথা থেকে উড়ে এসে পড়ল ভাইসরয়ের উপরে। হাতির পিঠে বসে থাকা অবস্থাতেই রক্তাক্ত হলেন হার্ডিঞ্জ।  বোমার আঘাতে ভাইসরয়ের মাথা, কাঁধ ,পা আর দেহের পিছনের অংশ থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। তাঁর মাথার পিছনে ছাতা ধরে থাকা মানুষটি প্রাণ হারালেন। লেডি হার্ডিঞ্জ, মাহুত এবং হাতিটির অবশ্য তেমন আঘাত লাগেনি। তবে টুকরো টুকরো হয়ে গেল হাতির পিঠে সুসজ্জিত হাওদা। হার্ডিঞ্জকে হাতির পিঠ থেকে নামাতেই বেগ পেতে হল ইংরেজ সৈন্যদের।  তারপর তাঁকে ওই এলাকা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হল। ইংরেজের নতুন রাজধানী প্রবেশের জাঁকজমকে হঠাৎই অন্ধকার নেমে এল।

১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বরের সেই ঘটনার কথা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। সিপাহীদের বিদ্রোহ সে তো বেশ অনেক বছর আগের কথা। তার পরে বাংলার তরুণেরা ইংরেজের উপর কিছু কিছু হামলা করেছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে খোদ ভাইসরয়ের উপর বোমা! দিল্লির ঘটনা লন্ডনের স্নায়ুকে নড়িয়ে দিল। ব্রিটিশ ভেবেছিল, কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী সরিয়ে আনলে বাংলার বিপ্লবীরা এত দূরে এসে নিশানা করতে পারবে না তাঁদের। কিন্তু এভাবে অভ্যর্থনা পেতে হবে, স্বপ্নেও ভাবেনি তারা।

শুরু হল খোঁজ। বাংলা থেকে এত দূরে কারা করল এমন দুঃসাহসিক কাজ? ধাঁধায় পড়ে গেল ইংরেজ। সক্রিয় হয়ে উঠল তাদের চর, গোয়েন্দারা। কেউ যদি খোঁজ দিতে পারে, কেউ যদি ধরিয়ে দিতে পারে…মিলবে ১০ হাজার টাকা। কিন্তু কোথায় কে, শুরুতে খুঁজে পাওয়া গেল না কাউকে। তারপর অবশ্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একে একে ধরা পড়তে থাকলেন বিপ্লবীরা।  আমির চাঁদ, ভাই বালমুকুন্দ, অবোধ বিহারী…।

চাঁদনী চকে পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে বোরখা পরে বোমা ছুড়েছিল যে কিশোর, দু’বছর পর বাংলার নদিয়া থেকে তাঁকে ধরে ফেলল ইংরেজ। বাবার শেষকৃত্যে যোগ দিতে উপস্থিত হয়েছিল সে। বসন্তকুমার বিশ্বাস।  ১৯১৫ সালের ৮ মে দিল্লিতে ফাঁসি হয়ে গেল আমির চাঁদ, বালমুকুন্দ আর অবোধবিহারীর। পরের দিন অম্বালা সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসি হল বসন্তকুমার বিশ্বাসের। তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি।

তবে বোমা কাণ্ডের পিছনে মস্তিষ্ক যাঁর, ২৬ বছর বয়সি সেই যুবক কিন্তু ইংরেজের চোখ এড়িয়ে রাতের ট্রেনে দিব্যি পালিয়ে গিয়েছিলেন দেরাদুনে। সেখানে ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ক্লার্কের চাকরি করতেন। সেখান থেকেই এসেছিলেন দিল্লিতে। বোমা কাণ্ড ঘটানোর পরের দিনই তিনি এমন ভাবে নিজের দফতরে ফিরে এসে কাজে মন দিলেন যেন কিছুই ঘটেনি। আরও মজার ব্যাপার হল, এর বেশ কিছু দিন পরে দেরাদুনের নাগরিকদের নিয়ে হার্ডিঞ্জকে সংবর্ধনাও দিয়ে দিলেন তিনি। ভাইসরয়ের উপর বোমা ছোড়ার সমালোচনাও করল নাগরিক সমাজ। সংবর্ধনা পেয়ে মনের জ্বালা কিছুটা মিটল হার্ডিঞ্জের।  হয়তো ভেবেছিলেন, শুধু বোমায় রক্ত ঝরাতে নয়, এই ভারতে তাঁকে স্বাগত জানানোর মানুষও রয়েছে অনেক!

কিন্তু ইংরেজ শাসককে নিয়ে ‘উচ্ছ্বসিত’ দেরাদুনে কর্মরত যুবকটির আসল চেহারা কিছু দিন পরেই বুঝে ফেললেন ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। হঠাৎ তাঁদের কাছে খবর এসেছিল, ফের দ্বিতীয়বারের জন্য সিপাহী বিদ্রোহের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।  ঠিক হয়েছিল, একটি বিশেষ দিনে হঠাৎই বিদ্রোহ শুরু হবে ইংরেজের সেনা ছাউনিগুলিতে। কিন্তু তার আগেই বিশ্বাসঘাতকের মাধ্যমে খবরটা পৌঁছে গেল ইংরেজ গোয়েন্দাদের কাছে। সব পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেল। ফের শুরু হল ধরপাকড়। তখনই এসবের পিছনে মস্তিষ্ক হিসেবে নাম সামনে এল রাসবিহারী বসুর। সেই যুবক! যে হার্ডিঞ্জকে সংবর্ধনা দিয়েছিল! বেরিয়ে পড়ল আরও তথ্য— ভাইসরয়ের উপর বোমা মারার পিছনেও মূল মাথা ইনিই।

পাগল হয়ে গেলেন ইংরেজ গোয়েন্দারা। রাসবিহারীকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালালেন তাঁরা। কিন্তু কোথায় রাসবিহারী!  সারা জীবনে ইংরেজের পুলিশ তাঁকে ছুঁতে পর্যন্ত পারেনি! ব্রিটিশ শাসককে ঘোল খাইয়ে নাম ভাড়িয়ে ততক্ষণে তিনি দেশের বাইরে। জাপানে পালিয়ে গেলেন রাসবিহারী। ভুল হচ্ছে, জাপানে গিয়েছিলেন যিনি, তাঁর নাম ছিল প্রিয়নাথ ঠাকুর। নিজেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একজন আত্মীয় পরিচয় দিয়ে প্রিয়নাথ ঠাকুরের নামে পাসপোর্ট জোগাড় করে ফেলেন বাংলার চন্দননগরে বড় হয়ে ওঠা, দেরাদুনের সরকারি চাকুরে সেই যুবক। ১৯১৫ সালের জুন মাস জাপানের কোবে বন্দরে নামলেন রাসবিহারী। পৌঁছে গেলেন টোকিও। অর্থের সঙ্কট, এমনকি বন্ধুবান্ধবও নেই। এরই মধ্যে আলাপ হল সেখানকার নেতা মিৎসুরু তোয়ামার সঙ্গে। টোকিওতে লালা লাজপত রায়ের সঙ্গে একটি সভা করেছিলেন রাসবিহারী। খবর পৌঁছেছিল ব্রিটিশের কাছে।  ব্রিটিশের চাপে জাপান মারফত জারি হয়েছিল তাঁকে নির্বাসনের আদেশ। মাস চারেক পর অবশ্য সেই নির্বাসন দণ্ড উঠে যায়। তবে এরই মধ্যে রাসবিহারীকে বাঁচাতে আশ্রয় দিয়েছিলেন বেকারি মালিক আইজো ও কোকা সোমা। এঁদেরই মেয়ে তোশিকোকে পরে বিয়ে করেছিলেন রাসবিহারী।

তার পরেও অবশ্য ধরা পড়ার ভয়ে বারবার বাড়ি বদল। সঙ্গে অর্থসঙ্কট। তবে ১৯২৩ সালে জাপানের নাগরিকত্ব পান রাসবিহারী। সেই বিষয়টি যখন অনেকটা স্বস্তি দিল, তখনই ভূমিকম্পে ভেঙে গিয়েছিল তাঁর বাড়ি। অর্থকষ্টে থাকা রাসবিহারীকে টাকা পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। জাপানে রাসবিহারী-তোশিকার বাড়িতেও গিয়েছিলেন কবি। তোশিকার সঙ্গে রাসবিহারীর দাম্পত্য সম্পর্ক অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিয়ের আট বছর পরেই যক্ষায়, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তোশিকা।

তবে জীবনের এত ঝড় ঝঞ্ঝা, স্ত্রী-র অকালমৃত্যু কিন্তু দমিয়ে দিতে পারেনি ভারতের একজন শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে। পরাধীন জন্মভূমিকে স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে তিনি কাজ করে গিয়েছেন বিদেশে বসেই।

১৯৪২ সালে রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছিল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। নিজেকে আইএনএ-এর পরামর্শদাতা হিসেবে রেখে এর নেতৃত্ব তিনি সঁপে দিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে। সেই আইএনএ-ই ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের। তবে প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি রাসবিহারী বসু। ভারত স্বাধীন হবার দু’বছর আগেই টোকিওতে মৃত্যু হয় তাঁর।