আজকের প্রজন্মের কাছে ‘ফাটাকেষ্ট’ নামটি উচ্চারণ করলে চোখের সামনে ভেসে উঠবে মিঠুন চক্রবর্তীর মুখ। কারণ, এই নাম ব্যবহার করে টলিউডে বাজার মাতিয়েছে একাধিক ছবি যাদের গল্পের সঙ্গে অরিজিনাল ফাটাকেষ্টর কোনও মিল নেই। তবুও মানতে হবে এই সব ছবির নির্মাণের পিছনে কাজ করেছে ‘ফাটাকেষ্ট’ নামে একটি মিথ, যা কলকাতা শহরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে গত শতাব্দী থেকে। সে এক অন্য কলকাতার ভিন্ন আখ্যান।
সে কলকাতা ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ের। ঘনঘন খুন-রক্তপাত-বোমা আর পুলিশি টহলদারি। নকশাল আন্দোলনের অভিঘাতে শহর-গ্রাম উত্তাল। সেই অশান্ত সময়কে বাগে আনতে প্রশাসনের প্রয়োজন ছিল জনাকয়েক বাহুবলীর। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার জন্য। সত্তর-একাত্তরের সেই আগুন-ঝরা দিনরাতে মধ্যবিত্ত গৃহস্থপাড়ার নিরাপত্তাহীনতা জন্ম দিয়েছিল এক আশ্চর্য চরিত্রের। সে মাস্তান না মসিহা— সে রায় আপনাদের হাতে। মধ্য কলকাতার বাতাসে ভেসে বেড়ানো সেই মিথে সত্যি-মিথ্যের অনুপাত মাপা মুশকিল। তবে সময় এক পানওয়ালার ছেলের জীবন কিভাবে বদলে দিয়েছিল— এ তারই কাহিনী।

কালীপুজো দেখতে উপস্থিত অমিতাভ বচ্চন

কলেজ স্ট্রিট মোড়ে বাবার পানের দোকানে বসে কেষ্ট, ভাল নাম কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত। ছোটবেলা থেকে কালীভক্ত সে। শনি-মঙ্গলবারে ঠায় দাঁড়িয়ে ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির সামনে আরতি দেখে। শরীরচর্চার খুব শখ। বেঁটেখাটো চেহারা আর মুখে বসন্তের দাগ নিয়ে ছেলেটা যখন মনোহর আইচের আখড়ায় ডাম্বেল আর মুগুর ভেজে ফেরে, হাতে তার শস্তার পাউরুটি আর পাঠার গুর্দা। আমহার্স্ট স্ট্রিটের নীলকণ্ঠ কেবিনে সেদ্ধ করে গোগ্রাসে ভক্ষণ। যেদিন না জোটে, সেদিন দুধে কাঁচা ডিম দিয়ে চুমুক। শরীরটাকে মন্দিরের মতো করে গড়তে চাইত কেষ্ট। পাড়ার আড্ডায় কখনো হাতের, কখনো কাঁধের পেশি ফুলিয়ে দেখাতো সে। কেউ উপহাস করত, কেউ বা ভক্ত হতে লাগল। দোকানের ফাঁকে প্রায়ই সে লোকাল নেতা হরেনদার সঙ্গে কংগ্রেসের মিছিলে যেত। হরেনদা বুঝিয়েছিল, নকশালদের আতঙ্কে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন। মাঝে মাঝে সে গুলে পচাদের সাথে যেত নীলাম দেখতে- কোথাও পুরনো আসবাব, পুরনো বাড়ি-ভাঙা লোহা, অথবা সম্পত্তির নীলাম, ধারে ভারে কেটে তাদের গোষ্ঠী যেদিন বিড উইন করত, ১০-১৫ টাকা হাতেও পেত কেষ্ট। বাবার পানের দোকানে মন টিকছিলো না আর, লেখাপড়াও কোনওদিনই ভাল লাগতো না। তাই স্কুল-কলেজও তার সঙ্গ ছেড়েছিল। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কাঁপা হাতে বাংলায় চেক সই করত। লড়াকু চরিত্র হওয়ায় সাগরেদের পাশাপাশি শত্রুও তৈরি হয়েছিল অনেক। তাদের কল্যাণেই জীবনটা ঘুরে যায় অন্য পথে…।

প্রতি বছরেই প্যান্ডেলে হাজির হতেন উত্তমকুমার

সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট লাগোয়া নরসিংহ দত্ত লেনে তার বাড়ির কাছেই ওত পেতে ছিলো পাড়ারই এক নাম্বার দুশমন নকুল, সঙ্গে বরানগরের কুখ্যাত মাস্তান নিলু আর তার সুকৌশলে ধরা ছুরিটা। হার মানেনি কেষ্ট। ছুরিতে ক্ষতবিক্ষত হয়েও ক্ষিপ্র বাঘের মত লড়ে যায় সে, ছিটকে দেয় দুই প্রতিপক্ষকে। কয়েকটা ছুরির কোপই শুধু তাকে আঘাত করেছিল তা নয়, আঘাত করেছিল তার নামটাকেও। তাই মেডিকেল কলেজ থেকে বেরিয়ে এলে তার নাম হয় ‘ফাটাকেষ্ট’।

নকশাল দমন, নীলামের কারবার, লোকাল দুষ্কৃতীদের মোকাবিলা— একের পর এক ‘সাফল্যের পালক’ তার মুকুটে জুড়তে লাগলো। নকশালদের বাড়ি ঢুকে তুলে আনা, জালকাঠি, বারুদ, গন্ধক সহযোগে বানানো কেষ্টর ওয়ার্কশপের পেটোর শব্দ বিরোধীদের কানে আর বুকে একসাথে বাজতে থাকে। গৌরীবাড়ি, চালতাবাগান, হৃষিকেশ পার্কে প্রায়ই চলতো সংঘর্ষ। এভাবেই একদিন প্রধান সাগরেদ হিসেবে জুটে যায় গোয়াবাগানের “চীনে বাগ্গা”। মুঙ্গের থেকে আনা সিক্স-শটার আর দেশি পাইপগান দিয়ে চীনে কেষ্ট-বাহিনীর দাপট বাড়িয়ে তোলে। রোজগারের ধান্দা শুরু হতে মনে পড়ে যায় অকশনের কথা। সেই নীলাম মানে হাওড়া লিলুয়ায় রেলের মধ্য-উত্তর কলকাতার যা কিছু সরকারি অথবা ব্যাঙ্কের নীলাম হবে, সেখানে ফাটাকেষ্ট আর তার দলের থেকে নীচে কেউ বিড করতে পারবে না। যদি করে আর জিতেও যায় তার কানের গোড়ায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তুলে আনা হবে অথবা ছেলেমেয়ের স্কুলের সামনে লোক পৌঁছে যাবে, কিছু কেসে আগেই মেশিন দেখিয়ে ঢুকতেই দেওয়া হবে না। যেখানে মধু থাকে সেখানেই মৌমাছির ভিড়। তাই ওখানে আরও বাহুবলীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে কেষ্ট। আগরপাড়া-সোদপুর থেকে যোগ দিয়েছিল ইনু মিত্র, আসতো রাম চ্যাটার্জি। তবে সবসময় খুব সহজ হতো না, কোথাও কোথাও থামতে হতো তাকে। পটলডাঙ্গার ঋষি যেখানেই যেত, কেষ্টকে বিড করতে দিত না। দুজনের মধ্যে প্রবল লড়াই। পরে পুলিশ অফিসার রুনু গুহনিয়োগীর হাতে এনকাউন্টারে মারা পড়ে ঋষি। পরবর্তীকালে ঝামেলা এড়াতে বিডাররা চুক্তি করে— ফাটাকেষ্টর টিম আর কোনও অকশনে যাবে না। পরিবর্তে পৌঁছে যাবে তার হিস্যার তিন পার্সেন্ট। শুধু ব্যবসার সুবিধা নয়, সাথে অন্য সমাজবিরোধী যারা নীলামের সময় দাদাগিরি করে তাদের হাত থেকেও বাঁচাবে কেষ্ট। বাগমারীতে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার জন্য তিনটি ছেলেকে মানিকতলা থেকে দৌড় করিয়ে রাজাবাজারের খোলা রাস্তায় চপার মারে কেষ্ট, দলবল নিয়ে। রাইটার্স থেকে ফোন আসে লোকাল কংগ্রেস নেতার কাছে। লালবাজার থেকে আরেকটা ফোন যায় থানায়— ‘কেষ্টকে চাই’। ওকে সামনে রেখেই চলুক পুলিশি অপারেশন। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

ফাটাকেষ্ট-র বিখ্যাত কালীপুজো

গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে ১৯৫৫ সালে যে কালীপুজো শুরু করে সে, মনোমালিন্যে তা সরিয়ে আনে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে। এক-দেড় দশকেই কালীভক্ত ফাটাকেষ্টর পুজো পৌঁছে যায় অন্য উচ্চতায়। বিশাল মূর্তি, ভক্তিতে গদগদ ভক্ত, রুপোর বাসন, ভারী সোনার অলংকার, মেলার জাঁকজমক, সৌন্দর্য ও অলৌকিকতার এক অব্যর্থ ককটেল তৈরি করে ফাটাকেষ্ট। কলেজ স্ট্রিট বাটা থেকে আমহার্স্ট স্ট্রিট অবধি গোটা কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিট আলোয় মুড়ে ফেলা হতো, ঝাড়বাতি আর পাখা মাথার উপর। কাকে দিয়ে কোন কাজটা হবে এটা খুব ভাল বুঝতো কেষ্ট। অন্নকূটের পুরো দায়িত্ব তার নিজের। পুজো কমিটির অজিত ঘোষরা ছিল তৎকালীন মন্ত্রী অজিত পাঁজার সহচর। তাই পূজোর উজ্জ্বলতাও বাড়ছিলো। কর্পোরেট স্পন্সর ছাড়াই এই পুজোর ‘ব্র্যান্ড ফাটাকেষ্ট’ হবার কারণ ছিলো। কেষ্টর বাহুবলী-কাম-রক্ষাকর্তা— দু’টো ইমেজই জনমানসে প্রভাব ফেলেছিল প্রবল। যে ফাটাকেষ্ট বোমা-গুলি আর কব্জির জোরে লড়ে সে-ই আবার নাইট-শো ফেরত পাড়ার মেয়ে-বৌদের নিরাপত্তার খেয়াল রাখে। কেষ্টদার কড়া নির্দেশ, বীনা-জহর-পূরবী-অরুণায় নাইট-শো ভাঙা অব্দি ছেলেরা পাহারায় থাকবে। সেরকমই এক রাতে পূরবীতে সিনেমা দেখে ফিরছিলো মিত্তির বাড়ির দুই বৌমা, সেজ মেয়ে নন্দিনী আর ছোট ছেলে তপন। ওই বাড়িরই ছেলে খোকা আবার কেষ্টর সহচর, যদিও ওই নারীদের মধ্যে কেষ্ট সম্পর্কে অশ্রদ্ধাই ছিল। পার্কের সামনে আলোটা কম। সেখানেই রিপন কলেজ হস্টেলের কয়েকটি ছেলে নন্দিনীকে টিজ করে। তপন প্রতিবাদ করে ‘তোমরা এক্ষুনি চলে যাও, কেষ্টদা জানতে পারলে কিন্তু খুব খারাপ হবে’। চারজনের একজন বলে ওঠে ‘কে তোদের নাটা কেষ্ট, আসুক না, আমরাও হস্টেলের ছেলে’। বিরক্ত নন্দিনী বলে, ‘কয়েকটা লোফারকে আটকাতে কোনও গুণ্ডার প্রয়োজন নেই’। ছেলেগুলো এসে অসভ্যতা করতে গেলে তপন চিৎকার করে কেষ্টর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে যায়। একটা সাদা অ্যাম্বাসেডর এসে দাঁড়ায় হ্যারিসন রোড ক্রসিংয়ে। দু’জন পালিয়ে যায়, বাকি দু’জন খালি গায়ে রিক্সা টানে। রিক্সায় বসে ফাটার ছেলেরা বলতে থাকে ‘মেয়েরা মায়ের জাত, সম্মান না করলে মা কালী পাপ দেবে’। পরের দিন নন্দিনীর সাথে দেখা হলে ফাটাকেষ্ট বলে, আমি গুণ্ডা হতে পারি, ভিলেন নই।

১৯৭৫ সালে মণ্ডপের প্রবেশদ্বার

হিরোর মত বচন হলেও বরফ কিন্তু সহজে গলেনি। রাস্তাঘাটে দু’জনে দু’জনকে দেখেও না-দেখার ভান করে আকর্ষণটা বাড়িয়ে তুলেছিলো। টিজ করা বা প্রণয় প্রস্তাব তো দূর, এলাকার যুবকেরা নন্দিনীকে এড়িয়ে চলত কেষ্টর ভয়ে। ভালবাসার কথা জানাতে বিশ্বকর্মা পুজোকে বেছে নিল কেষ্ট। মিত্তির বাড়ির ছাদ থেকে পেটকাটা কাঁটা ঘুড়িটা ভোকাট্টা না হয়ে যখন গাঁত খেয়ে নন্দিনীদের ছাদে পড়লো তাতে তুঁতের আঠায় জুড়ে ছিল বন্ধুকে দিয়ে লেখানো চার লাইনের প্রেমপত্র।

এহেন কঠিন মানুষ কিন্তু পাড়ার তরুণীদের কাছে মুখচোরা। তবু তার জীবনেও প্রেম এনেছিল নন্দিনী।
আর প্রথা মতো মাস্তান পাত্রে বাড়ির আপত্তি থাকায় পাত্রীকে নিয়ে পলায়ন এবং বন্ধুর থিয়েটার রোডের আস্তানায় বিয়ে। খাবার এসেছিল চাংওয়া থেকে। পরে অনুষ্ঠান হয়। মহানায়ক উত্তমকুমার সোনার দুল দিয়ে বৌমাকে আশীর্বাদ করেন।
উত্তমকুমারের সাথে ফাটাকেষ্ট’র ঘনিষ্ঠতার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। প্রায় প্রতিদিনই ভোরে ফ্রিহ্যান্ড আর জগিং করতে ময়দানে যেতেন উত্তমকুমার। ১৯৭১-এর ৫ আগস্ট ময়দানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন নকশাল নেতা সরোজ দত্ত। সম্ভবত দৃশ্যটি দেখে ফেলেন উত্তম। পরে কোনও পার্টিতে মদ্যপ অবস্থায় ঘটনার বিবরণ দেন এবং সেখান থেকে শুরু হয় বিপত্তি। কলকাতা পুলিশের হয়রানি, ছেলে গৌতমের ওষুধের দোকানে বোমাবাজি। এককথায় রাজরোষে পড়েন উত্তমকুমার। তাঁর ঢাল হয়ে দাঁড়ায় ফাটাকেষ্ট। গৌতমের দোকানের নিরাপত্তা এবং পুলিশের ইনফর্মার হিসাবে ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে বিরাট ভূমিকা ছিল তার। তাই শুটিং থাকলে আগে না থাকলে কালীপুজোর দিন উত্তম আসতেন তার পুজোয়।

পুজোয় উপস্থিত অজিত পাঁজা

শুরুর দিকে যুব কংগ্রেস কর্মী সোমেন মিত্র আর তার দুই সহযোগী দীপক দাস পল্টু আর জীবন চক্রবর্তীর সঙ্গে এলাকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করলেও পরে দু’জনের পথ বেঁকে যায় দু’দিকে। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেস(ই) গঠন করলে সোমেন-পন্থীরা ইন্দিরা কংগ্রেসে যোগ দেবার জন্য মিটিং করার সময় ফাটাকেষ্টর দলবল বোমাবাজি করে। ততদিনে কলকাতা ময়দানের রাজনীতিতে প্লেয়ার-ক্যাচার হিসেবে পসার জমিয়ে ফেলা জীবন পল্টু জুটি দু-নলা বন্দুক হয়ে উঠেছে। অটোমেটিক রিভলবার, কেমিক্যাল বোমা, অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা আর সোমেনের নেতৃত্ব কেষ্টকে অনেক পেছনে ফেলে দেয়। জীবন, পল্টু শেষ দিন পর্যন্ত ফাটাকেষ্টকে প্রতিহত করে এলাকা দখলে রেখেছিল।
আপাত অশিক্ষিত হলেও কেষ্টর জানা ছিল কোন দক্ষতায় অ্যাকশন প্ল্যান করতে হয় আর কিভাবে জনসংযোগ। বিড়লা হাউজে রবিশঙ্করের সেতার শুনতে যাওয়ার পাশাপাশি রামা-বাসু-চন্দন-ফ্যানটাদের দিয়ে এলাকায় শক্তি-সাম্য বজায় রাখতেও জানত। নকশাল আমলে সাফল্যের পুঁজির সুদ কেষ্ট আজীবন ভাঙিয়েছে বুদ্ধিবলে। কংগ্রেস আমলে যে সরকারি ডেয়ারিতে সে চাকরি পেয়েছিল, বাম আমলেও তা বহাল ছিলো। অফিসে না গিয়েও মাইনে ঘরে চলে আসতো।
আরেকটা ফাটকা রোজগারের সিন্ডিকেট খুলেছিল তারা। তার মধ্যে ছিল তাবড় তাবড় নেতা ও শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকরা। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষার সময়ে সিটি কলেজ, বিদ্যাসাগর কলেজ, চিত্তরঞ্জন কলেজের পরীক্ষার্থীদের সিক সার্টিফিকেট জমা দিয়ে তা এক্সামিনেশন কন্ট্রোলারের ছাড়পত্র-সহ প্রশ্নপত্র বাইরে এনে যথেচ্ছ টুকে উত্তরপত্র জমা দিয়ে ছাত্রদের পাশ করানো হতো। সেই সময় একে “খাতা খাসি” বলা হতো। প্রতি পেপার সে যুগে ১০০০ টাকা।

সঙ্ঘের মঞ্চে বালক ব্রহ্মচারী ও ফাটাকেষ্ট

মিল্ক কলোনির যে ডেয়ারিতে কেষ্ট চাকরি করত, সেখানে মাইনের দিনগুলোতে তার লোকেরা যেত শ্রমিকদের থেকে তোলা আদায় করতে। একবার এক শ্রমিক নেতার নেতৃত্বে সবাই ঘিরে ফেলে কেদার আর তার টেনিয়াদের। তাদের চাবকানো হয় বেল্ট দিয়ে। প্রতিহিংসায় তিনদিন বাদে দমদম থেকে সেই শ্রমিক নেতাকে তুলে এনে কোমরের হাড় ভেঙে দেয় কেষ্ট।
নভেম্বর, ১৯৭২-এর এক রাতে পুলিশের সঙ্গে কাশীপুর বরানগরে ঘর থেকে বার করে করে গুলি করে হত্যা করে অসংখ্য নকশালকে। এলাকার নকশাল নেতা স্বপন দত্তর সঙ্গে কেষ্টর গণ্ডগোল লেগে থাকত। কেষ্ট সন্ধ্যাবেলায় আড্ডা দিত পেট্রোল পাম্পের পাশে, নয়তো নরেন সেন স্কোয়ারে সেন্ট্রাল বোর্ডিংয়ের পাশের খাটালে। হত্যাকাণ্ডের বদলা নেওয়ার সময় এসে পড়ে। তৈরি হয় কেষ্ট-বধের নীলনকশা। একদল বোমা নিয়ে গেল পটুয়াটোলা লেন দিয়ে, আরেক দল রাজা লেনে সাইকেলের চেন নিয়ে, আর পটলডাঙ্গার দিক দিয়ে ৫-৬জনের একটি দল। ওলট-পালট হয়ে যায় আড্ডার আসর বোমার আওয়াজ আর সাদা ধোঁয়ায়। বেঁচে যায় কেষ্ট, খাটালে ঢুকে গরুর পিছনে লুকিয়ে।

শক্তিসাধকের এই উল্লাসের ঘোর কাটার সময় এসে পড়ে। কালীপূজা বাবদ কলেজ স্ট্রিট ‘বাটা’র দোকান থেকে ১0000 টাকা চাঁদা চাইলে তারা দিতে অস্বীকার করে। দোকানে শুরু হয় কেষ্টর ছেলেদের হুজ্জোতি। কলকাতা পুলিশের সাহায্য না পেয়ে বাটা কোম্পানি দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে যোগাযোগ করে অভিযোগ জানায়। দিল্লি থেকে নির্দেশ আসে, গ্রেপ্তার করতে হবে ফাটাকেষ্টকে। পুলিশ রিমান্ডে নারকীয় নির্যাতন চলে তার ওপর। কেষ্ট বোঝে, থামার সময় এসেছে। স্ত্রী নন্দিনী ইতিমধ্যে একটি ফুটফুটে কন্যার জন্ম দিয়েছেন।
জীবনের ঝুঁকি এসেছে এরপরেও। সূর্য সেন স্ট্রিটের ‘গণ্ডার’ তাকে পেটো মারে। সেটি না ফাটায় সেই বোমা তুলে কেষ্ট চার্জ করে গণ্ডারকে।

কালীপুজোয় উপস্থিত দেশ-বিদেশের অনেকেই

সাদা সাফারি স্যুট পরনে, সারা মুখে বসন্তের দাগ নিয়ে বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা লোকটাকে ফেরাতে পারতেন না অমিতাভ বচ্চনও। পরিচালক দুলাল গুহের ‘দো অনজানে’-র শুটিংয়ে অমিতাভ কলকাতা এলে গ্র্যান্ড হোটেলে ফাটাকেষ্টর সঙ্গে পরিচয় হয়। ওই পুজোর সাথে বচ্চনের যোগ ছিলো বহুদিন। প্রতিমার জন্য বম্বে থেকে হীরের নাকছাবিও পাঠান।
ব্যক্তিগত জীবনকে কেষ্ট চেষ্টা করতো সাধারণের থেকে দূরে রাখতে। ঘনিষ্ঠ পরিসরে সীমিত পরিমাণ মদ্যপান করতো। এক প্রিয় নারীকে নিয়ে রেখেছিল বাগুইহাটির ফ্ল্যাটে। এই সময় কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় সুদে টাকা খাটানোর ব্যবসা শুরু করে সে।
নরেন সেন স্কোয়ারে ফাটাকেষ্টর ক্লাব নবযুবক সঙ্ঘ আজও রয়েছে। উত্তম-সুচিত্রা, অমিতাভ, রাজেশ খান্না, বিনোদ খান্না, মালা সিনহা, আর ডি বর্মন, আশা— কে আসেননি তার পুজোয়? এমনকি, রাশিয়ান ফুটবলার লেভ ইয়াসিনও ১৯৭৩-এ অতিথি হয়ে আসেন। কাশী থেকে সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুর এলে এক অদ্ভুত কাণ্ড করে কেষ্ট। ভিড় থাকায় জটাধারী সাধুকে ঘাড়ে নিয়ে মঞ্চে ওঠে। তার রমরমার সময়ও তার নামে পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল মধ্য কলকাতা, যাতে লেখা ছিল— ‘ফাটাকেষ্টর মুণ্ডু চাই’। একবার নকশালদের প্রতিরোধে কালীপুজোই বন্ধ হতে চলেছিল। ঠাকুর আনা ও বিসর্জন নিয়ে কৌশল করতে হয়েছিল তাকে। বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল পুজোর নাম। পুজোকে কেন্দ্র করে অন্নকূট ও দুঃস্থ মানুষদের শীতবস্ত্র দান ছাড়াও অভাবি পরিবারের মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা ও ঘরবাড়ি করে দিত কেষ্ট। এমনকি, এক গর্ভবতী ছাত্রীর তবলার মাস্টারকে তুলে এনে বিয়েও দিয়েছিল কেষ্টদা। অনেকে আসতো কেষ্টর কাছে নানান আবদার নিয়ে। এফসিআই-তে, ডেয়ারীতে, এমন কি ব্যাঙ্কের চাকরিতেও ঢুকিয়েছে বহু ছেলেকে, রাজনৈতিক স্বার্থ না দেখে। একবার বাদুড়বাগানের ছাপাখানায় দু’টি ছেলে একটি মেয়েকে রেপ করে। রাজাবাজার থেকে তাদের তুলে এনে পুলিশের হাতে তুলে দেয় কেষ্ট।
বোমাগুলির লড়াই থেকে বহুদূরে সরে এসে ১৯৯২ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে চলে যায় কলকাতার রবিনহুড, মাস্তান ফাটাকেষ্ট। সমাজের নিচুতলা থেকে উঠে আসা বেপরোয়া ছেলেটাকে ক্ষমতা বদলাতে পারেনি। তার বাহুবলের ঘরানাই ছিল আলাদা।

ছবি : প্রবন্ধ দাসের সৌজন্যে