উড়াল দিলো গানের পাখি। তার তো আর দেশকালের বালাই নেই। সে উড়তে উড়তে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে পৌঁছে গেল ভিনদেশে। তার ভাষারও কোনো ছুতমার্গ নেই। সে আপন করে নিলো নতুন ভাষা, নতুন সংস্কৃতি। পৌঁছে গেল ঘরে ঘরে। জায়গা করে নিলো হৃদয়ে হৃদয়ে। তারপর? তারপর ভালবাসার অমৃত পান করে সে অমর হয়ে বেঁচে রইলো যুগ যুগান্তর ধরে।

১৯২২ সাল। ইতালি। তৈরী হল “Ramona” – একটি গান।  তৎকালীন প্রসিদ্ধ সংগীতশিল্পী Saint Granier, Henry Garet, Gracy Fields  কে না গেয়েছেন সে গান! সে গানের সুর খুব উচ্চকিত নয়। ভ্রমরের গুণগুণ গুঞ্জনের মতো। আপনমনে গেয়ে ওঠার মতো।

তারপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে।  সুরসাগর হিমাংশু দত্ত তখন পাকাপাকি ভাবে কলকাতায়। তৈরি হচ্ছে একের পর এক যুগান্তকারী গান। চলছে ভারতীয় ও বিদেশী সুর নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এমনই এক মাহেন্দ্রক্ষণে সেই ১৯২৮ সালে রেকর্ড হওয়া Ramonaর সাথে সুরসাগর হিমাংশু দত্তর সমুদ্রপ্রমান সংগীত-প্রজ্ঞার সঙ্গম ঘটলো। ১৯৩৯ সাল। শৈলেন রায় এর কথায় ও হিমাংশু দত্তর সুরে প্রকাশ পেল সেই গান –

তোমারই পথ পানে চাহি

আমারই পাখি গান গায়

শিশিরনীরে অবগাহি

কাননপথ ফুলে ছায়…।

গাইলেন মাধুরী সেনগুপ্ত। অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করলো গানটি খুব স্বাভাবিক কারণেই।

১৯৪০ সাল। “স্বামী স্ত্রী” ছবির সুরারোপ এর দায়িত্ব নিলেন হিমাংশু দত্ত। ছবির প্রোডিউসার, ডিরেক্টর সবাই লোকের মুখে মুখে ফেরা সেই সুরটিকেই ফিল্মে ব্যবহার করতে চাইলেন। আসলে কাজে লাগাতে চাইলেন সুরটির তুমুল জনপ্রিয়তাকেই।অগত্যা একই সুরে নতুন কথা বসালেন শৈলেন রায়। ( এক্ষেত্রে অবশ্য একটি মতান্তর আছে। কারও কারও মতে এই গানটির গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য।) একই সুরে সিনেমায় প্রকাশ পেল নতুন গান-

‘বনের কুহুকেকা সনে মনের বেণুবীণা গায়

দখিনা মধু সমীরণে অধরা ধরা দিতে চায়

সহসা এলে যে গো ভুলে কানন ছেয়ে গেল ফুলে

মুকুল মৃদু আঁখি তুলে জাগিল সুখ বেদনায়।।’

গানটি ছিল দ্বৈতকণ্ঠে। গেয়েছিলেন শৈল দেবী ও বেচু দত্ত। বলা বাহুল্য এক্ষেত্রেও গানটি জনপ্রিয়তার শিখর স্পর্শ করল।মজা হল এরপর। একটি সুরের জনপ্রিয়তা কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে তার খানিক আভাস এখান থেকে আমরা পেতে পারি —

শৈল দেবী ও বেচু দত্তর গাওয়া গানটি রেকর্ড হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন পাইওনিয়ার রেকর্ড কোম্পানি। গানটির আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে কিছুদিনের মধ্যেই মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি গানটির পুনঃপ্রকাশ করেন। এবার কিন্তু একই কথা ও সুরে গানটি প্রকাশ পায় ছায়া দেবী ও সতীপ্রসাদ রায় এর কণ্ঠে। এবং এই গানটিও প্রত্যাশা মতোই লোকপ্রিয় হয়।

১৯৪৪ সালে সুরসাগর হিমাংশু দত্ত প্রয়াত হন। তার বেশকিছু বছর পর ১৯৫৬ সালে। হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি এই গানটির পুনঃপ্রকাশের উদ্যোগ নেন। সংগীত পরিচালনা করবেন প্রবাদপ্রতিম রাইচাঁদ বড়াল। কিন্তু গোল বাধলো অন্য জায়গায়। এ গানের গীতিকার শৈলেন রায় হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানির অনুমোদিত গীতিকার নন। তাহলে উপায়? অগত্যা আবার একই সুরে বসলো নতুন কথা। লিখলেন মনোজ ভট্টাচার্য। এবার সাবিত্রী ঘোষ এর অসামান্য কন্ঠে বেজে উঠলো নতুন গান-

‘তোমারি মুখ পানে চাহি, আমারি আঁখি মুরছায়

আপন মনে তরীখানি বাহিয়া বেলা বয়ে যায়।

সহসা এলে কীগো ভুলে

কানন ছেয়ে গেল ফুলে

তোমারি অধরের কূলে কামনা ব্যাকুলিয়া যায়।’

এরপর ১৯৬৬ সালে HMV হিমাংশু দত্ত স্মরণে একটি এল পি প্রকাশ করে। ছয়জন শিল্পী প্রত্যেকে গাইলেন দুটি করে হিমাংশু দত্তর গান। তার মধ্যে একটি অবধারিত ভাবেই সেই ১৯৩৯ সালে মাধুরী দাশগুপ্তর গাওয়া সেই প্রথম ভার্সনটি। এবার সে গান এক অন্য গায়কীতে, অন্য চপলতায় কন্ঠে ধারণ করলেন শ্যামল মিত্র। যার জনপ্রিয়তার প্রমাণ হয়তো কোন অরসিকও চাইবেন না।

গানের পাখি মনেই করতে পারেনা, সুদূর ইতালি থেকে এসে নিজের অজান্তেই কবে সে বাংলার, বাঙালির আপন হয়ে গেল। এখনও তার অবাধ যাতায়াত বাংলার ঘরে ঘরে… হৃদয়ে হৃদয়ে…। আজও সে বাঙালির মনের ভিতরঘরে বসে দানাপানি খায়, কথা বলে আর অলক্ষ্যে বসে হয়তো তৃপ্তির হাসি হেসে ওঠেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত।

https://youtu.be/Y8DdR8SdJIw

https://youtu.be/DjHNzTJTbY4

1 COMMENT

  1. রাতুল চন্দ রায় অশোকনগরের একজন প্রথিতযশা গায়ক,সুরকার এবং কবি। দীর্ঘদিনের অধ্যাবসা, সঙ্গীতে জ্ঞান অর্জন। গান নিয়ে এমন আলোচনা এবং তার ভেতরকার গল্প আমাদের সত্যিই অজানা। আরো জানতে চাই। আরো এমন লেখা পড়ে সমৃদ্ধ হতে চাই।

Comments are closed.