‘‘আমি এক আগ্নেয় পাহাড়।

শান্তির ছায়া-নিবিড় গুহায় নিদ্রিত সিংহের মতো

চোখে আমার বহু দিনের তন্দ্রা।’’

সুকান্ত ভট্টাচার্য হয়তো আমাদের আন্দামান সাগরের ব্যারন দ্বীপে ১৫০ বছর অন্তর জেগে ওঠা আগ্নেয়গিরি কথা ভেবেছিলেন। নজরুল লিখেছেন ,“হাঁকিছে প্রলয়, কাঁপিছে ধরণী, উদ্‌গারে গিরি অগ্নি-ধূম।’’

GOES-17 স্যাটেলাইট থেকে তোলা বিস্ফোরণের মুহূর্ত

তবে এরা যেন একটু নিরীহ। ফেলুদাও আগ্নেয়গিরিতে যাননি। হিন্দি সিনেমাতেও নেই। ভারতীয় সাহিত্যে আগ্নেয়গিরির উপস্থিতি বেশ কম। তবে আমাদের সাহিত্যে ভয়াল আগ্নেয়গিরির উপস্থিতি না থাকলে কী হবে, এই দুনিয়ায় একেকটি আগ্নেয়গিরি মাঝেমধ্যেই তাদের উপস্থিতি বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। যেমন টোঙ্গা দ্বীপের আগ্নেয়গিরির কথাই ধরা যাক না কেন।

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ টোঙ্গা। তার দু’টি ছোট জনমানবহীন আগ্নেয়গিরি দ্বীপ—  একটি হুঙ্গা টোঙ্গা, অন্যটি হুঙ্গা হাপাই।

জলোচ্ছাস

গত ১৫ই জানুয়ারি, এই টোঙ্গার আগ্নেয়গিরিতেই বিস্ফোরণ একেবারে প্রলয়ঙ্কারী ঘটনা। সমুদ্রের নীচে অবস্থিত হুঙ্গা টোঙ্গা ও হুঙ্গা হাপাই-এর অগ্নুৎপাত ১০০টা হিরোশিমা বিস্ফোরণের সমান বলে জানিয়েছে নাসা।‌ অগ্নুৎপাতের ফলে উৎপন্ন শক্তি প্রায় ৩০ মিলিয়ন টন TNTর বিস্ফোরণের তুল্য। ছাইয়ের চাদরে ঢেকে গিয়েছিল গোটা দ্বীপপুঞ্জ।

আগ্নেয়গিরির ছাই দ্বীপজুড়ে

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিগত ১০০ বছরের মধ্যে আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের এত জোরালো শব্দ কোনওদিন শোনা যায়নি। ১০০০ কিলোমিটার দুরে, আলাস্কা থেকেও এর আওয়াজ পাওয়া গিয়েছে। এর আগের রেকর্ড ছিল ১৯৮৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার ক্রাকাতাওয়ে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণকে নিয়ে। কিন্তু  হুঙ্গা টোঙ্গা, হুঙ্গা হাপাই-এর এই বিস্ফোরণ সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে ।‌ সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, এতকিছুর পরেও অক্ষত রয়েছে টোঙ্গা আগ্নেয়গিরি।

এই টোঙ্গা, ক্রাকাতাওয়ে-সহ পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ আগ্নেয়গিরি যুক্ত রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় মেখলা বা আগ্নেয় বলয়ের মধ্যে। যেখানে ক্রমাগত অগ্নুৎপাত হয়েই চলছে। বিজ্ঞানীরা কারণ ব্যাখ্যা করেছেন টেকটনিক প্লেট থিয়োরির সাহায্যে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট এবং পশ্চিম দিকে ইউরেশীয় প্লেট ও পূর্ব দিকে আমেরিকান প্লেট— প্রত্যেকে পরস্পর অভিসারী। ফলে অপেক্ষাকৃত ভারী প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটটি হাল্কা ইউরেশীয় প্লেট ও আমেরিকান প্লেটের নীচে ঢুকে গিয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটটির নীচের অংশ প্রচন্ড তাপে গলে ম্যাগমায় পরিণত হয় এবং দূর্বল অংশ দিয়ে বাইরে নির্গত হয় আগ্নেয়গিরির লাভা।

সুনামির ধাক্কা

টোঙ্গায় এই অভিঘাতের ফলে অনিবার্য ভাবে সুনামির সৃষ্টি হয়েছিল। প্রশান্ত মহাসাগরে ১৫ মিটার উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়েছিল টোঙ্গার উপকূলে। যার জেরে বিপর্যস্ত হয় দ্বীপরাষ্ট্রের জনজীবন-সহ একাধিক পরিকাঠামো। বিশেষত সমুদ্রের নীচের ইন্টারনেট কেবল— টোঙ্গা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে গোটা বিশ্ব থেকে। এমন পরিস্থিতিতে অবশ্য  সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। ত্রাণ পাঠিয়ে এখনও টোঙ্গার মানুষজনকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে।