ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এক নতুন আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে।
উর্বর মাটি ও বিস্তীর্ণ ক্ষেত—ইউক্রেনকে বলা হয়ে থাকে ইউরোপের রুটির ঝুড়ি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত কৃষি উৎপাদনের প্রায় ২৫ শতাংশ উৎপাদিত হতো এই ইউক্রেনে। আর এখন বিশ্বের গম ও বার্লি রফতানির প্রায় এক তৃতীয়াংশ হয়ে থাকে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে।
তবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ এই পরিস্থিতিকে একেবারেই বদলে দিয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের এক কর্তার কথায়, ‘‘করোনা মহামারীর পরেই ইউক্রেন ও রাশিয়ার যদ্ধকে ঘিরে যে সঙ্কট, তা বিশ্বজুড়ে খাদ্য সরবরাহ সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, রাশিয়া ও ইউক্রেন খাদ্যশস্য, সার এবং শক্তি সরবারহের প্রধান দুটি দেশ। পরিস্তিতি খুবই সঙ্কটজনক হয়ে উঠছে।’’
‘প্রোটেকট দ্য হারভেস্ট’ পোর্টালটির একটি প্ৰতিবেদন বলা হয়েছে, বর্তমানে, প্রতি ৮ জনে ১ জন মানুষ বা গোটা দুনিয়ার ৮৪ কোটি ২ লক্ষ মানুষ প্রতিনিয়ত ক্ষিদের সঙ্গে লড়াই করে। আর দুনিয়ার প্রায় ১০০ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীন। তাঁদের যথেষ্ট পরিমাণে সাশ্রয়ী মূল্যে পুষ্টিকর খাবারের অভাব রয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির প্রধান গ্যাব্রিয়েল ফেরেরো ডি লোমা-ওসোরিও বলেছেন, ‘‘মহামারীর আগেও আমরা ভাল ছিলাম না, ক্ষুধাসূচক (Hunger Index) ধীরে ধীরে বাড়ছিল। তারপর করোনা আঘাত হানলো। তবে এখন যা পরিস্থিতি, তাতে মহামারীর আগের তুলনায় অনেক বেশি মানুষ ক্ষুধার্ত। সংখ্যাটা ১৬ কোটির থেকেও বেশি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ খাদ্যের সরবারহ ও এর দামের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।…বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার উপর এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব দেখতে পাচ্ছি।’’
গ্যাব্রিয়েলের মতে, দেশগুলোকে তাদের খাদ্য নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে, খাদ্য সঞ্চয় বাড়াতে হবে। যেমন, বাংলাদেশ তার প্রায় অর্ধেক গম ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে আমদানি করে। যদিও গমের সরবরাহে এখনও বিশ্বব্যাপী কোনো প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয় নি কিন্তু রাশিয়ার আক্রমণের পর দাম বেড়ে গিয়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। গম, বার্লি ছাড়াও ইউক্রেন ভুট্টার একটি প্রধান সরবরাহকারী দেশ। তারা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত সূর্যমুখী তেলের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশ। যুদ্ধের ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এই সব খাদ্য সরবরাহ হ্রাস পাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বেবিফুড, পাউরুটি এমনকি পশুখাদ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়তে চলেছে।
কিন্তু এই সঙ্কট থেকে বাঁচার উপায় কোথায়? বিশেষজ্ঞরা বলছেন—বাঁচার রাস্তা একটাই। ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা মেটাতে কৃষিকে আরও বিকশিত করতে হবে। বিশ্বব্যাপী পুষ্টি চাহিদা মেটাতে কৃষকদের খাদ্য উৎপাদন ৭০-১০০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ গম সরবরাহ করে থাকে। যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী গম সরবরাহে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। এটি অবশ্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে ভারতের, বিশেষ করে পাঞ্জাবের সামনে। পাঞ্জাবের গমের গুণগত মান বরাবরই ভাল। উচ্চমানের মানের ফসল হলেও পাঞ্জাব থেকে গম শুধুমাত্র শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশেই রফতানি হয়। এমনকি,ভারতের অভ্যন্তরে বড় কিছু সংস্থা ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে গম আমদানি করে। যুদ্ধের জেরে এখন ভারত থেকে গমের চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। পঞ্জাবের খান্নার গম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হরবংশ সিং রোশা সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘যুদ্ধের ফলে আমাদের সামনে একটি সুযোগ উপস্থিত হয়েছে। পাঞ্জাবের গম বরাবরই উচ্চমানের। বর্তমানে আমাদের গোডাউনগুলিতে ৪০ লক্ষ টন গম মজুত রয়েছে। আশা করছি, এপ্রিলে ফসল কাটার পর গোডাউনে আসবে প্রায় ২০০ লক্ষ টন গম। সেই গম দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারব।