সৈয়দ রেজাউল করিম  

প্রসিকিউশনের উকিলবাবু আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিলেন। তারপর ডিফেন্সের উকিল উঠলেন আমাকে প্রশ্ন করতে। সে তো আর প্রশ্ন নয়, যেন একেকটা গোলা। আগুন ছিটকে বার হচ্ছে তা থেকে। সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় গলায় বেনারসি শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে সুস্মিতা আত্মহত্যা করেছে, একথা মেনে নিলেও সুস্মিতার লেখা চিঠিটি তাঁর নয়, অন্য কারও লেখা বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন তিনি। অনেক বুঝে শুনে উত্তর দিলাম আমি। একসময় উকিলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন— ওটা যে সুস্মিতাদেবীর লেখা চিঠি, তা আপনি কিসের উপর ভিত্তি করে বলছেন?

কেসটা তদন্ত করার সময় সুস্মিতার বাপের বাড়ি থেকে তার হাতের লেখা খাতাপত্তর নমুনা হিসেবে সিজ করে সিআইডি-র, কিউ.ডি.ই.বি-র ডায়রেক্টরের কাছে পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছিলাম, দুটি হাতের লেখা এক কি না? চিঠি ও খাতাপত্তর পরীক্ষা করে উত্তর দিয়েছিল, লেখাগুলি একই ব্যক্তির হাতের লেখা। স্বভাবতই সে ভাবে উত্তর দিলাম উকিলবাবুকে। একসময় সাক্ষী দেওয়ার কাজ শেষ হল আমার। প্রসিকিউশনের উকিলবাবুর মুখে শুনলাম, অন্যরাও ভালো সাক্ষী দিয়েছে। উনি বললেন, এ কেসে প্রকাশের কম করে পাঁচ-ছ’ বছরের সাজা হবে। কোর্ট ভারডিক্ট দিলে তার কপি আপনাকে পাঠিয়ে দেবো।

আমি মনে মনে ভাবলাম, আর কী হবে ওসব দিয়ে? চাকরি থেকে অবসর নেবার পর, ভালো কাজের জন্য কে আর রিওয়ার্ড দিতে আসবে আমাকে? চাকরি জীবনে মানুষের যে ভালোবাসা, যে সম্মান, যে প্রশংসা পেয়েছি তা হাজারটা রিওয়ার্ডের থেকে অনেক বেশি মূল্যবান। অনেক বেশি দামী—অমূল্য।

কোর্ট থেকে বার হবার মুখে দেখা হল ডি কে সারকির সঙ্গে। ডি কে হলো দিলকিশোর সারকি। আমার সেকেন্ড অফিসার হিসেবে দু’বছর ধূপগুড়ি থানায় ছিল। আমাকে দেখে সোৎসাহে বলে উঠলো —স্যার ! আপনি এখানে?

— সাক্ষী দিতে এসেছিলাম।

— আমার থানায় চলুন স্যার! অনেকদিন আপনার সঙ্গে কথা হয়নি।

— এখনই যেতে পারব না। সুচরিতাদি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। তা তুমি কি এখন বালুরঘাট থানার আইসি?

— হ্যাঁ স্যার! কাল সকালে অবশ্যই আসবেন স্যার!

—     ঠিক আছে।

একথা বলে সুচরিতাদির কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ল কথাটা। সারকিকে ডেকে বললাম— তুমি একটা কাজ করে দিতে পারবে?

— কী যে বলেন স্যার! আপনি শুধু বলুন না, কী কাজ। আপনার জন্য কিছু করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব।

আমি সংক্ষেপে মধুমতীর পরিচয় দিয়ে বললাম— এখন তিনি মালদা স্টেশনে লোকজনের কাছে হাত পেতে পেট চালান। অথচ তার পিসি তাঁকে পাঁচ বিঘে সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেছেন। ওই ভদ্রমহিলার চকভৃগুতে নিজস্ব বাড়ি আছে। সেই  বাড়িতে ফিরে যাতে র্নিবিঘ্নে বসবাস করতে পারেন, তার একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

সারকি বলল— আপনি একদম চিন্তা করবেন না স্যার! আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।

একথা বলে সারকি চলে গেল থানার দিকে। আর আমি ফিরে এলাম সুচরিতাদির কোয়ার্টারে। সুচরিতাদি আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। দুজনে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করলাম। কথায় কথায় জানতে চাইলাম– মিনি, চিনি গেল কোথায়?

— ওরা চলে গেছে।

— ওকে কবে বিয়ে দিলে আমাকে তো জানাওনি।

—  আর বলিস না। ও তো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। মন মেজাজ ঠিক ছিল না আমার। ও যে এরকম একটা কাজ করে বসবে, ভাবতেই পারিনি।

— ভেবে কোন লাভ নেই সুচরিতাদি। এটা বয়সের ধর্ম। কেউ মেনে চলে, কেউ তা পারে না। অলীক স্বপ্নে ডুব দেয়। তা জামাই কি করে?

— কি আর করবে? হোমগার্ডের চাকরি করে।

একথা বলে গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুচরিতাদি। মুখটা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে উঠল। বুঝতে পারলাম সুচরিতাদি এখনও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি মিনির বিয়ে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। একসময় আক্ষেপ করে সুচরিতাদি বলল— ভালোবেসে মেয়েটাকে পড়াশোনা করালাম। মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করল। ভাবলাম নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কিন্তু রাজা ওর মাথাটা খেয়ে নিল। অনেকদিন পরে মিনি সেটা বুঝতে পারল। এখন এসে কন্নাকাটি করে। ভুল করেছে বলে আক্ষেপ করে। রাজার নামে অভিযোগ করে। তার প্রতি অবিচার, অত্যাচারের অনেক কথা বলে। কিন্তু সবকিছু ছেড়ে চলে আসতে পারে না। এটাই বোধহয় সাতপাকের বাঁধন। মেয়েদের প্রধান দুর্বলতা। এ থেকে রেহাই নেই তাদের।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। রাজাকে আমি চিনি। ওর বাবা সন্তোষ মণ্ডলের আকস্মিক মৃত্যুতে ডুবতে বসেছিল ওদের সংসার। তখন আইসি যোগেশ দত্ত সাহেব বড়সাহেবকে ধরেকরে রাজার চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ভাবতে খারাপ লাগে, সেই ছেলেটা কুসঙ্গদোষে এতটা অমানুষে পরিণত হয়েছে। প্রসঙ্গ পাল্টাতে আমি বললাম— ওদের কথা ছাড়ো। খিদে পেয়েছে, ভাত দাও।

সুচরিতাদি চুপচাপ কিচেন রুমে গেল। আমাদের দুজনের জন্যে ভাত বেড়ে নিয়ে এল। আমরা একসঙ্গে বসে খেলাম। আমি হাতটাত ধুয়ে একটা রুমে গিয়ে ঢুকলাম। যেখানে ব্যাগপত্তর রেখে গিয়েছিলাম। সুচরিতাদি বাসন-কোসন ধুয়ে আমার রুমে চলে এল। আমি ব্যাগ থেকে দুটো বাক্স বার করলাম।

সুচরিতাদি বলল— এগুলো কি বার করছিস?

আমি বললাম, প্রেজেন্টেশন। বিয়ে খেতে এলাম, উপহার দিতে হবে না?

— তা দুটো বাক্স কেন?

—     একটা সন্ধ্যার মেয়ের জন্য। আর একটা আমার প্রিয়জনের জন্য।

একথা বলতে বলতে বাক্স দুটো খুললাম। দুটি বাক্সের ভিতরে দুটো ভারি সোনার হার। একটা খুব দামি  হার। সেই হারটা দেখে সুচরিতাদি চমকে উঠে বলল— এ তো দেখছি মনিহার। এত দামি হার কার জন্য নিয়ে এলি ?

আমি রসিকতা করে বললাম— এ হারটা আমার ভালোবাসার পাত্রীর জন্য নিয়ে এসেছি।

— সেই ভালোবাসার পাত্রীটি কে, সেটাই তো তোর কাছে জানতে চাইছি…

—     আমি তার নাম বলব না। তবে এটা বলতে পারি, তুমি তাকে ভালো করে চেনো।

তার নাম বলছি না দেখে সুচরিতাদি কিছুটা রুষ্ট হয়েছে বলে মনে হল। চোখে মুখে সেই আভাস ফুটে উঠেছিল। সুচরিতা অভিমান করছে ভেবে আমি হার সমেত বাক্সটা দ্রুত তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম— আমার স্নেহ ভালোবাসার একমাত্র পাত্রী হলে তুমি। তাই এই হারটা তোমার।

সুচরিতাদি চোখ কপালে তুলে বলল— আমার মানে? তুই কি পাগল হয়েছিস নাকি? কেন তুই আমাকে হার দিবি? আমার কি একটা হার কেনার মতো ক্ষমতা নেই? তোর দেওয়া হার আমি কেন নিতে যাব? তুই আমার কে? আমাকে কি পেয়েছিস তুই?

—     ব্যাস, অনেক হয়েছে সুচরিতাদি। সত্যিই তো আমি তোমার কে? এখন তো আমাকে ভাবতেই হয়, কেন আমি তোমার এখানে এসে উঠেছি…।

ক্ষোভ, অভিমানের ভান করে একগাদা কথা শুনিয়ে দিলাম সুচরিতাদিকে। এমনকি আমি এখান থেকে চলে যাব বলে হুমকিও দিলাম। সুচরিতাদি আমাকে মানাবার চেষ্টা করল। কাতর কন্ঠে বলল— এতদিন একসাথে কাজকর্ম করেছি। তোর সাথে কোনওদিন মনোমালিন্য পর্যন্ত হয়নি। আজ কি তুই মনে মনে ঠিক করে এসেছিস, আমার সাথে ঝগড়া করবি!

আমি বললাম— সুচরিতাদি! এই চাকরি জীবনে তোমাকে কোনওদিন কোনওকিছু দিইনি। শুধু খেয়েছি, নিয়েছি, প্রতিদানে কিছুই করিনি। সাধনবাবুর মেয়ের জন্য গয়না কিনতে গিয়ে তোমার মুখটা মনে পড়ল। তাই ওটা কিনে নিয়ে এলাম। আর তুমি…।

— হ্যারে! তুই আমাকে বলতো, এখন কি সোনার গয়না পরার বয়স আছে?

— ওকথা একদম বলবে না সুচরিতাদি। কী এমন বয়স হয়েছে তোমার? গয়না পরার কোনও বয়স আছে নাকি? আর একটা কথা। দয়া করে ভালোবেসে হারটা কাউকে দান করো না। তোমার মেয়ের জন্য না হয় পরে একটা হার আমি কিনে এনে দেবো।

— ঠিক আছে বাবা! হারটা আমি কাউকে দেব না। কিন্তু ওই হারটা কি এখন সাধনবাবুর মেয়েকে দিতে যাবি? নাকি ওদের ডেকে নেব এখানে?

আমি বললাম— এখানেই ডেকে নাও সুচরিতাদি! ওদের কোয়ার্টারে গেলে কিছু না খাইয়ে ছাড়বে না। তবে ওদের ডাকতে যাবার আগে তোমার হারটা তুলে রেখো।

সুচরিতাদি হারটা আলমারিতে রেখে দেবার সময় আমাকে বলল— একটা সত্যি কথা বল তো। জীবনে তুই কখনও কাউকে এত দামী মনিহার উপহার দিয়েছিস?

সুচরিতাদি কী কারণে কথাটা জিজ্ঞেস করল, তা না বুঝেই আমি বললাম— হ্যাঁ, একজনকে দিয়েছিলাম, সে গল্প তোমাকে পরে বলব। তার আগে তুমি একবার সাধনবাবুর কোয়ার্টারে গিয়ে কাউকে ডেকে নিয়ে এসো।

সুচরিতাদি  চলে গেল সাধনবাবুর কোয়ার্টারে। কিছুক্ষণ পরে সুচরিতাদির সঙ্গে সাধনবাবু ও তাঁর স্ত্রী, কন্যা এল। নমস্কার করে আমার কুশল সংবাদ নিল। বিয়ের উপহার হিসেবে হারটা তুলে দিলাম মেয়ের মায়ের হাতে। সন্ধ্যা অভিযোগের সুরে বলল— দাদা! এসব আবার আনতে গেলেন কেন?

আমি বললাম— বিয়ের সময় এটা দিতে হয়।

সুচরিতাদি বেনারসি শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ কিনে রেখেছিল, তা বার করে সন্ধ্যার হাতে তুলে দিল। জিনিসপত্রগুলো নিয়ে মেয়েটা নিজেদের কোয়ার্টারে রেখে আসতে গেলে সাধনবাবুকে আমি বললাম—আমাকে ক্ষমা করে দেবেন সাধনবাবু! আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারিনি তখন। আপনি অনেক বড় হৃদয়ের মানুষ।

সাধনবাবু প্রতিবাদ করে বলল— এসব কী কথা বলছেন স্যার! আপনারা হলেন আমার পথিকৃত। আমার সহায় সম্বল। উপকারী বন্ধু। আপনাদের পাশে না পেলে এতদিনে আমি শেষ হয়ে যেতাম।

কথায় কথায় উঠে এলো যোগেশবাবুর কথা। সাধনবাবু বলল— মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে আইসি সাহেবকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। কাল সকালবেলা আসবেন বলেছেন। কিন্তু সমস্যায় পড়ে গেছি। হোটেল বুক করে রেখেছিলাম। হোটেলের ম্যানেজার জানাল, কাল নাকি সব ভি.আই.পি-রা আসছ‌ে। তাই সব রুমগুলো জোর করে বুক করে নিয়েছে প্রশাসনের লোকজন।

সুচরিতাদি বলল— অত চিন্তা করবেন না সাধনবাবু! হোটেল পাওয়া না গেলে স্যার আমার এখানে এসে থাকতে পারেন। আপনি একটু জিজ্ঞেস করে নেবেন। তাহলে আর অসুবিধা হবে না।

 

( ক্রমশ)

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়