সুখেন্দু হীরা
(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (নিরাপত্তা)। প্রতারণার নানা কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তিনি তুলে ধরছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)
গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিকে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা পশ্চিমবঙ্গবাসীকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ঘটনাটি ছিল, ভেজাল তেলে খেয়ে বেহালা অঞ্চলে অনেক লোক চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের অগস্ট মাসের এক রাতে ভেজাল রেপসিড তেলে তৈরি রান্না খেয়ে বেহালার বুড়োশিবতলা এলাকার ৩০০ মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল অন্ধকার। কেউ খেয়েছিলেন সেই তেলে ভাজা লুচি, কেউ তালের বড়া, কেউ চপ, কেউ তরকারি। খেয়েই শুরু হয় বমি। চিকিৎসার পরেও কোমরের নীচ থেকে হয়ে যায় অসার। এই তেল সবাই কিনেছিল ‘গরিব ভাণ্ডার’ নামে এক রেশন দোকান থেকে। পরে তদন্ত করে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ভেজাল কারবারিকে। তিনি ছিলেন এক বঙ্গপুঙ্গব।
তিনি হলেন আমার স্মৃতিতে থাকা অন্যতম সেরা প্রতারক। মুনাফার লোভে তিনি কত লোককে সারা জীবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করলেন। কত বিশ্বাস করে সাধারণ মানুষ গণবন্টনকারী বিক্রয় কেন্দ্র থেকে মাল কেনেন। সরকারি ব্যবস্থাপনার রেশন দোকান থেকে জনসাধারণ ওজনে মাল কম পাবে ধরেই নেয়, কিন্তু ভেজাল মাল পাবে মানুষ ভাবতেও পারে না। মানুষ দুধে জল, গোল মরিচে পেঁপের বীজ, পোস্ততে ভুট্টা গুড়ো, বনস্পতির নামে ডালডাতে প্রাণীজ চর্বি, গাজায় তামাক পাতা পেতে অভ্যস্ত। কিন্তু ভোজ্য তেলে বিষাক্ত পদার্থ বিপজ্জনক। যদিও সরষের তেলে রাইসব্রান অয়েল, ঝাঁজ বাড়াতে শেয়ালকাঁটার বীজ তেল দেওয়া হয়। আবার শেয়ালকাঁটার তেলের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলেই বিপদ।
এমনিতেই বর্তমান যুগের মানুষ একটু আধটু ভেজাল খেতে অভ্যস্ত। অনেকে রসিকতা করে বলেন, বরঞ্চ খাঁটি জিনিস খেলেই শরীর খারাপ করবে। যেমন কথায় বলে, ‘কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় না’।
খাদ্যদ্রব্যকে লোভনীয় করতে নানা অননুমোদিত রং মেশানো হয়। এই রং যুক্ত খাবার মানুষের নানা রকম রোগ ডেকে আনে। যেমন হলুদ বা হলুদ রঙের খাবারে লেড ক্রোমেট। লাড্ডু, মিহিদানা, বোঁদে, জিলিপি, ইত্যাদি ঈষৎ হলুদ বা গেরুয়া রঙের খাবারের মেটালিন ইয়োলো, চিনির তৈরি খাবার যেমন হাওয়াই মিঠাই, চিনির ঘট ইত্যাদিতে রোডমি বি মেশানো হয়।
কতগুলি অতি সাধারণ ভেজাল মেশানো পন্থার একবার উল্লেখ করি। ব্যবহৃত চা পাতা শুকিয়ে রং করে নতুন চা পাতা বলে চালানো হয়। ছানা, পনির, ছানার তৈরি মিষ্টিতে স্টার্চ মেশানো হয়। চিনিতে চকের গুঁড়ো, সব রকম মশলাতে কাঠের গুঁড়ো বা ভুসি। চালে কাঁকর, সরষেতে ইঁদুরের মাটি। ইত্যাদি ইত্যাদি।
সাধারণত চাষিরা ভেজাল মেশায় না। চাষিদের কাছ থেকে যেসব পাইকার বা ব্যবসায়ীরা পণ্য কেনেন, তাদের স্তর থেকে ভেজাল মেশানো শুরু হয়। চাষির কাছ থেকে সরষে কিনে পাইকারদের তার মধ্যে ইঁদুরের গর্তের গুড়ো গুড়ো সর্ষের দানার মত মাটি মেশাতে দেখেছি। সবজিওয়ালা সবজি নিয়ে বসার আগেই জল ছিটিয়ে তাজা করেন, সেই সঙ্গে একটু ওজনও বাড়িয়ে নেন।
চাষিদের পুরোপুরি ছাড় দেওয়া যায় না। ফলন বৃদ্ধির জন্য তারা অনেক পন্থা গ্রহণ করেন। সেটা অবশ্য এই বৃহৎ জনসংখ্যা দেশে সবার মুখে খাদ্য তুলে দিতে করতেই হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে চাষি বা মৎস্যজীবী যখন নিজেদের খাওয়ার জন্য সবজি চাষ বা মৎস্য চাষ করে, সেটা আলাদা ভাবে করে। তাতে কীটনাশক, অজৈব সার, প্রাণীজ খাদ্য কম দেয়।
অতিরিক্ত অজৈব সার, কীটনাশক, প্রাণীজ খাদ্যের প্রয়োগের কুফল জেনে জনসাধারণের মধ্যে জৈব পদ্ধতিতে চাষ, ভেষজ পণ্য, নিয়ে বিশেষ সচেতনতা এসেছে। সেটা জেনে ব্যবসায়ীরা বাজারে নিয়ে এসেছেন নানা অর্গানিক ফার্মিং-এর ফসল, নানা হার্বাল প্রোডাক্ট। কিন্তু এগুলো কতটা আর্গানিক বা কতটা হার্বাল তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
চোখ খোলা রাখলেই দেখা মেলে নামজাদা ব্র্যান্ডের জিনিসপত্রের নকল বাজারে প্রচুর আছে। সে ক্ষেত্রে মোড়কের রং, ডিজাইন একই রেখে নামের এক বা একাধিক অক্ষর পাল্টে দিয়ে বিক্রি করা হয়। এক্ষেত্রে আইনত বিশেষ কিছু করার নেই। কিন্তু অনেক ব্যবসায়ী আছেন, মোড়ক হুবহু রেখে জাল জিনিস ভরে বিক্রি করে। এতে সাবান, শ্যাম্পু খাদ্যবস্তু কী নেই।
বিভিন্ন নামীদামি কোম্পানি এজন্য বাজারে তাঁদের চর নিয়োগ করে রাখেন। তাঁরা খোঁজ পেলে কোম্পানিকে জানায়। কোম্পানি তখন পুলিশ তথা প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। আগে যখন বাজারে সিডি অর্থাৎ কমপ্যাক্ট ডিস্কের রমরমা ছিল, তখন বাজারে প্রচুর জাল সিডি বিক্রি হতো। তখন একই ভাবে নানা সিডি উৎপাদক সংস্থা বা সিনেমা কোম্পানিগুলো প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালাতেন। বর্তমান সবকিছু ডিজিটাল হয়ে এগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
সম্প্রতিক কালে আর একটি ঘটনা ভোজন রসিক বাঙালিকে ধাক্কা দিয়েছিল। তা হলো বিভিন্ন রেস্তরাঁ, হোটেলে মৃত পশুদের মাংস সরবরাহ এবং তা সুচারু রন্ধন প্রণালীতে রঞ্জিত হয়ে সুদৃশ্য পাত্রে পরিবেশন। তা খেয়ে বাঙালি পরিতৃপ্তির উদগার। জানাজানি হতে কয়েক দিন রেস্তোরাঁগুলো মাছি তাড়ালো, এখন আবার ভোজনালয়গুলোতে আর মাছি প্রবেশ করতে পারছে না।
ভেজালের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়ার জন্য পৌরসভা এলাকার ফুড ইন্সপেক্টর আছেন। জেলার ক্ষেত্রে ব্লক লেভেলে আছেন ব্লক স্যানিটারি ইন্সপেক্টর। মহকুমা স্তরে সাব ডিভিশনাল ফুড ইন্সপেক্টর। জেলাস্তরে উপভোক্তা সুরক্ষা কেন্দ্রের সভাপতি হলেন ডি.এম. স্বয়ং। ক্ষতিগ্রস্ত উপভোক্তারা ক্ষতিপূরণের জন্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে অভিযোগ জানাতে পারেন।
তথ্য ঋণ: খাদ্য দূষণ ও সর্তকতা – উপভোক্তা বিষয়ক বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
অলংকরণ – রাতুল চন্দরায়