সুজিত সাহা
“রামায়ণ করিল বাল্মিকী মহাকবি।
পাঁচালী করিল কৃত্তিবাস অনুভবি।”
বাংলার আদি কবি কৃত্তিবাস ওঝা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন বাল্মিকী রামায়ণ। পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে লিখিত সপ্তকাণ্ড রামায়ণ শ্রীরাম পাঁচালী নামে পরিচিত। সহজ সরল ভাষায় লিখিত শ্রীরাম পাঁচালী বাংলার ঘরে ঘরে ঠাঁই পায়। রামায়ণের চরিত্ররা ঢুকে পড়ে বাঙালির মননে। কবি কৃত্তিবাস করেছিলেন রামায়ণের ভাবানুবাদ। বাঙালির সামাজিক পটভূমিতে সুখ-দুঃখের কাহিনী রূপে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল রামায়ণ। মহাকাব্যের বিশালত্ব কৃত্তিবাসের হাতে বনে গিয়েছিল বাঙালির প্রতি ঘরের সহজ-শ্রুতি।
এইবার একটু বিপ্রতীপ সন্ধানে গেলে ভ্রূকুঞ্চিত হবে। এই সমাদৃত মহাকাব্যের মূল পুঁথি বা পান্ডুলিপি আমাদের বাংলায় তথা ভারতে নেই। যা আছে, সব তার নকল প্রতিলিপি। কিন্তু কিভাবে আমাদের বাংলার কোহিনূর-সম সম্পদ বিদেশে স্থানান্তরিত হল সেই কাহিনী অবশ্যই জানা দরকার।
বর্তমানে রামায়ণের যত রকম সংস্করণ আমরা হাতে পাই তার সমস্তই রচিত হয়েছে, শ্রীরামপুর মিশনারি প্রেসের ছাপা ‘শ্রীরাম পাঁচালী’র অনুকরণে। আনুমানিক ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরী জয় গোপাল তর্কালঙ্কারের সহায়তায় প্রাচীন পুঁথি সংশোধন করে সর্বপ্রথম কাঠের হরফে শ্রীরাম পাঁচালী পাঁচ খন্ডে ছাপা হয়। বাংলায় রামায়ণ তথা মুদ্রণের ভগীরথ বলা যায় উইলিয়াম কেরী সাহেবকে। তারপর বিভিন্ন ভাবে রামায়ণ ছাপা হয়েছে। ধীরে ধীরে মূল রামায়ণের ভাব অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে।
চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশ। চন্দননগর থেকে একজন ফরাসী শিক্ষাবিদ কর্ডিয়ার সাহেব নৌকায় ফুলিয়া আসেন। সেখানে তিনি মূল শ্রীরাম পাঁচালীর সন্ধান পান। সেই পুঁথি তিনি সেখান থেকে সুদূর ফ্রান্সে নিয়ে যান। যা আজও প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাকারে সংরক্ষিত আছে।
নদিয়া জেলার ফুলিয়া কবি কৃত্তিবাসের জন্ম ভিটে। সেখানে গড়ে উঠেছে কৃত্তিবাস লাইব্রেরী ও সংগ্রহশালা। এখান থেকে উদ্যোগ নিয়ে ১৯৯৬ সালে প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগার থেকে মাইক্রো-কপি ফিল্ম আকারে নিয়ে আসা হয় ফুলিয়ায়। ফুলিয়ার কৃত্তিবাস সংগ্রহশালায় মূল পুঁথির ফটোকপি তৈরি করে সংরক্ষণ করা আছে। সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ হয়েছে রামায়ণের সমস্ত ভাষায় অনূদিত সংস্করণে। মোট সাড়ে ১২ হাজার বইয়ের মধ্যে, আড়াই হাজার ১১টা ভাষায় রামায়ণ আছে। আছে কবির বংশলতিকা এবং রামায়ণ অবলম্বনে অঙ্কিত চিত্র। আছে বহু কিছু। কিন্তু মূল সৃষ্টি হারিয়ে গেছে স্রষ্টার ঘর থেকে।
বাংলার কোহিনূর শ্রীরাম পাঁচালী আজ পরবাসে। কোনদিন কি ফিরবে সেই সম্পদ? আজও ফুলিয়া চেয়ে থাকে সেই আশায়। চেয়ে আছি আমরাও। যদি কোনওদিন ফিরে পাওয়া যায় হারানো মানিক।
অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়