(আজ থেকে প্রায় সত্তর-বাহাত্তর বছর আগে কেমন ছিল অশোকনগর? রেলস্টেশন ছিল না। ট্রেনে এসে নামতে হতো হাবড়া স্টেশনে।  জনমানবহীন গোটা এলাকা। সরকারি খাতাপত্রে নাম ছিল ‘হাবড়া আরবান কলোনী‘। সাধারণ মানুষও সেই নামেই এলাকাটিকে জানতেন। অশোকনগর নামটাই তো দেওয়া হয়নি তখন। সেই সময়ে কেমন ছিল এখানকার বাসিন্দাদের জীবন, তা নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন প্রয়াত সুতপেশ দাশ, তাঁর ‘অশোকনগরের কাহিনী’ বইটিতে। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক অতুল সুর। দীর্ঘদিন ধরে বাজারে-না-থাকা বইটি থেকে কিছু অংশ কয়েকটি পর্বে তুলে ধরছি আমরা। আজ প্রথম পর্ব)

নিউ মার্কেট থেকে চৌরঙ্গী যাওয়ার রাস্তা। একসময় প্লেন ওঠা নামার রাস্তা ছিল এটি

…সেদিনকার সেই আরবান কলোনীতে বাড়ী ছিল মাত্র গুটিকয়েক। অনেক বাড়ী তখন তৈরী হচ্ছে। কনস্ট্রাকশন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে কনট্রাকটাররা এসব বাড়ী তৈরী করেছে। ১৯৫০ সালের জুন মাসে যখন এখানে এলাম তখন সীমিত সংখ্যক কয়েকটি বাড়ী মাত্র শেষ হয়েছে। ‘কচুয়া মোড় থেকে আরম্ভ করে ‘রায়-কেবিন’ অর্থাৎ ‘আর. ও অফিস’ এলাকা অবধি বাড়ীগুলোই মাত্র শেষ হয়েছে। বাস রাস্তার পূর্ব পাশের বাড়ীগুলির চিহ্নমাত্র ছিল না। ছিল না চৌরঙ্গী, গোলবাজার, ছিল না ৩ নম্বর, ৮ নম্বর, ৫ নম্বর প্রভৃতি স্কীম। অবশ্য রাস্তাগুলো ছিল। রানওয়ে ভেঙ্গে বার করা সুবিন্যস্ত রাস্তা। তবে বড্ড নির্জন। চৌরঙ্গী এলাকা বা আরও দক্ষিণে বেড়াতে গেলে আমরা সঙ্গী নিয়ে যেতাম। একা যাবার সাহস হত না।

দুটি প্লেন রাখার জায়গায় এখনো পুরোনো অশোকনগরের স্মৃতি উস্কে দেয়

এলাকার চেহারাটা ছিল একটু বিশেষ ধরনের। চারদিক জুড়ে একটিও গাছ ছিল না। শুধু বুক সমান উঁচু কাশবন আর তার মধ্যে দিয়ে সোজা বেরিয়ে গেছে রানওয়ে ভাঙ্গা রাস্তা। গাছ গাছালি না থাকায় স্বভাবতঃই গরমটা বেশী ছিল। জোরে হাওয়া দিলে চারদিকে ধুলো উড়তো ভয়ানক । রাস্তায় চলতে চলতে প্রচণ্ড রোদে তেতে উঠলে একটু ছায়া পাবার উপায় ছিল না। তাই দুপুর রোদে লোকে পারত পক্ষে বেরোত না। কনস্ট্রাকশন বোর্ডের লোকেরা বা কনট্রাকটারদের কর্মীরাও উত্তপ্ত দুপুরে অফিস ঘরে আশ্রয় নিত। আবার কাজে বেরোত বেলা ৩ টার পর।

কনস্ট্রাকশন বোর্ড— অফিসে একজন একজিকিউটিভ ইনজিনীয়ারের অধীনে এস. ডি. ও, ওভারসীয়ার, এসটিমেটর, কেরানী, পিয়ন প্রভৃতি অনেক কর্মী ছিলেন। একটা রিক্রিয়েশন ক্লাবও ছিল। বলতে গেলে সেই সময়কার মুষ্টিমেয় উদ্বাস্তু বাসিন্দাদের কাছে এই অঞ্চলে কনস্ট্রাকশন বোর্ডে’র অফিসটাই ছিল একমাত্র প্রাণকেন্দ্র। যেটটুকু বৈচিত্র্যের স্বাদ এরা পেতেন, তা ঐ অফিস কর্মীদেরই কল্যাণে। এরাই মাঝে মাঝে থিয়েটার জলসার আয়োজন করতেন। বিল্ডিং-এর ‘এলোটি’-রা তাতে যোগ দিতেন দর্শক হিসেবে। বৈচিত্র্যহীন নিস্তরঙ্গ জীবনে তাঁরা পেতেন একটু আনন্দের ঝলক।

তখনকার দিনে, অর্থাৎ এই শহর সৃষ্টির আদি পর্যায়ে, এখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত সহজ সরল । কারো অফিসে যাবার তাড়া নেই। কারণ ‘ডেলি প্যাসেঞ্জার’ শ্রেণীটি তখনও তৈরী হয়নি। এখান থেকে গিয়ে কলকাতায় অফিস করার কথা কেউ ভাবতেও পারতেন না।

এখনো কিছু অ্যালুমিনিয়াম-এর বাড়ি আছে প্রোডাকশন সেন্টারে

তাই এখানে থাকেন তাঁরাই যাদের রোজ ঘুম থেকে উঠে অফিসে দৌড়তে হয় না। তারপর স্কুলের তাড়া নেই। কারণ স্কুলই নেই। এসব পরে ধীরে ধীরে হয়েছে। তাই প্রথম যুগে দেখা যেতো এখানকার বাসিন্দারা সকালে উঠে সামান্য কিছু প্রাতঃরাশ সেরে নিয়ে ধীরে সুস্থে বাজারে যেতেন। বাজার মানে সেই কল্যাণগড়ের বাজার। ওদিকটায় বসতি শুরু হয়ে গেছে অপেক্ষাকৃত আগেই। তাই বাজার, স্কুল সবই ওখানে গড়ে উঠেছে। বাজার টাজার সেরে এসে কিছু কিছু বাড়ীর কাজকর্ম করা, বাগান-টাগান করা ইত্যাদি চলতো। তারপর খেয়ে দেয়ে ঘুম। বিকেলে বাড়ীর পাশেই একটা পায়চারী করে সময় কাটানো। আাশেপাশের দু’চার জন প্রতিবেশীর সঙ্গে বাক্যালাপ। তারপরেই সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে না নামতেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে থাকা। এই ছিল নিত্যকার কাজ। নিঃসীম অন্ধকারে জনবিরল পথে সন্ধ্যার পরে বেরুতে গা ছম ছম করত। ক্লাব নেই, লাইব্রেরী নেই, সভা সমিতি নেই— সে ছিল তখন এক অন্য জীবন।

তখনকার দিনে ভোরবেলায় পাখিটাখির ডাক বড় একটা শোনা যেত না। কারণ গাছপালা ঝোপঝাড় কিছুই যে নেই। তবে ভোরবেলায় কিছু কিছু, পাখি— শালিখ, চড়াই, কাক প্রভৃতি আসতো। আশেপাশের গ্রাম থেকে উড়ে এসে বসতো বাড়ীগুলোর ন্যাড়া ছাদে। একটু বেলা হলে আর এদের পাত্তা মিলত না। ভোরবেলা সূর্যটা যেন একলাফে আকাশে উঠে যেতো। এখন যেমন গাছপালার আড়াল থেকে ধীরে ধীরে উকি মারে, তখন সেরকম হত না। পরবর্তী কালে সূর্য ওঠার সেই ধরনটা আস্তে আস্তে কখন বদলে গেছে আমাদেয় সকলের অজান্তে, তা টেরই পাইনি।

প্রত্যেকটি বাড়ীর বাসিন্দার প্রধান লক্ষ্য ছিল দুটো চারটে করে গাছ লাগানো। প্রকাণ্ড প্লটটার কোনদিকে কোন ঘেরাও নেই। ঘেরাও দেবারও কোন সোজা পথ বা সামর্থ্য নেই। সেই খোলা জমিতেই তাঁরা লাগাতেন নারকেল-সুপারীর চারা। দু-একটা সজনের ডাল বা স্থলপদ্ম আর জবাফুলের চারা । এসব তারা নিয়ে আসতেন আশেপাশের গ্রাম থেকে সংগ্রহ করে। আর আনতেন কল্যাণগড় থেকে। কল্যাণগড়ে ইতিমধ্যে অনেক লোকের বসতি হয়ে গেছে। ঐখানকার বাড়ীগুলোকে তখন গাছগাছালির সুন্দর শ্যামল শ্রী ঘিরে নিয়েছে। ঘরে ঘরে লাউমাচা, পুঁইমাচা, ভুঁই কুমড়া আর মাঝে মাঝে যুঁই, বেলী তার দোপাটির চারা এদিকে ওদিকে শোভাবর্ধন করছে।

এখানকার প্রথম দিককার জনাকয় এ্যালোটির মধ্যে যে প্রয়োজনীয়তার কথা সর্বপ্রথম মনে এল তা হচ্ছে এখানে নাগরিকদের একটা সমিতি গড়ে তোলা। যার কাজ হবে এখানকার বিভিন্ন প্রকারের অভাব অভিযোগের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তার প্রতিবিধানের জন্যে সচেষ্ট হওয়া। অসুবিধা ছিল বহু রকমের। কনট্রাক্টর দিয়ে যে বাড়ীগুলি তৈরী করানো হয়েছে সেগুলি ছিল ত্রুটিযুক্ত। স্কুল, রেশন, দোকান, পোষ্ট অফিস, বাস সার্ভিস কিছুই ছিল না। যাই হোক সকলে মিলে উদ্যোগী হয়ে একটি সমিতি গড়ে তুললেন। নাম হল “নাগরিক সংঘ”। সম্পাদক ছিলেন কেদারনাথ ভট্টাচার্য।

পি এল ক্যাম্পের বাড়িগুলি সেই একইরকম আছে

‘নাগরিক সংঘ’ গঠিত হবার পরই এই সংস্থা স্থানীয় R. O. অফিস এবং Construction Board অফিসের সঙ্গে এখানকার বিভিন্ন অসুবিধাগুলির কথা নিয়ে আলাপ আলোচনা সুরু করেন এবং অনেক চেষ্টার পর ঐগুলি কতকাংশে দূর করতে সমর্থ হন। তৈরী বাড়ীগুলোর দরজা-জানালা ঠিকমতো আটকানো যেত না। কোন কোন বাড়ীর ছাদ দিয়ে জল চুঁইয়ে পড়তো। কোন বাড়ীর আবার মেঝে ফেটে চৌচির। সরকার থেকে সংশ্লিষ্ট কন্টাক্টর দিয়ে সেইসব প্রায়ই সারাই করে দেওয়া হত। এ নিয়ে মাঝে মাঝে এ্যালোটি কন্ট্রাক্টর সরকারপক্ষ এই তিন দলের ঝগড়াও বেধে যেত । এরকম ঝগড়ার দৃশ্য এখানে ওখানে প্রায়ই দেখা যেত।

এরপরই নাগরিক সংঘ এতদঞ্চলে একটি প্রাইমারী স্কুল স্থাপনে উদ্যোগী হলেন। প্রতিদিন এখানে নতুন এ্যালোটি আসছেন। প্রতিদিনই ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়ছে। একটা প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা নিতান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এই তাগিদেই সৃষ্টি হল ‘নাগরিক শিক্ষা সংঘ প্রাইমারী স্কুল’-এর। স্কুল বাড়ী তো নেই। না থাক। এমনি তৈরী হয়ে পড়ে থাকা খালি বাড়ী তো আছে অনেক। তারই দুখানা নিয়ে নেওয়া হল স্কুল চালানোর জন্যে। সরকারকে এ তথ্য জানিয়ে রাখা হল। তারপরেই শিক্ষাবিভাগের সঙ্গে চিঠি বিনিময় সুরু হল বিদ্যালয়টি অধিগ্রহণের জন্যে। এতদঞ্চলে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তালিকায় “নাগরিক শিক্ষা সংঘ” স্কুলের নাম সর্বপ্রথম। পরে এক এক করে অনেক স্কুলই তৈরী হয়েছে। ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে স্কুলটি সরকার কর্তৃক অধিগৃহীত হয়। পরবর্তীকালে এই ‘প্রাইমারী স্কুলটি জুনিয়র বেসিক স্কুল’ পর্যায়ে উন্নীত হয়। এই প্রাইমারী স্কুলে কমিটির সভাপতি ছিলেন মতিলাল সরখেল এবং সম্পাদক ছিলেন বিনয় চক্রবর্তী। সমগ্র অঞ্চলটিতে ‘নাগরিক শিক্ষা-সংঘ’ ব্যতীত আর কোন স্কুলে ছিল না। “মরুর মাঝে পান্থপাদপ”-এর মতো এই এলাকায় একটি মাত্র প্রাইমারী স্কুলে টিম টিম করতো। উচ্চতর শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা নিকটবর্তী কল্যাণগড় বিদ্যামন্দির (ছেলেদের) এবং কল্যাণগড় বালিকা বিদ্যালয় (মেয়েদের) স্কুলে দুটিতে ভর্তি হল। সুরু হল তাদের পড়াশোনা। কল্যাণগড় এলাকায় লোক সমাগম অপেক্ষাকৃত আগে হয়েছে বলে এই অঞ্চলের শিক্ষিত ব্যক্তিরা মিলে ইতিমধ্যেই এই স্কুলে দুটি চালু করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

অশোকনগর-কল্যাণগড় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূমিতে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের ভার ন্যন্ত ছিল যাঁর ওপর সেই নিরলস কর্মী জনদরদী হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম এখানকার সকলেই অবশ্যই মনে রাখবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্বান্ত, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার ছিলেন তিনি। হিরন্ময়বাবু বিশেষ দরদ দিয়ে এখানকার সমস্যগুলোর কথা শুনতেন, প্রতিকারের ব্যবস্থা করতেন। এখানকার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নাগরিক সংঘ তাঁর কাছে ডেপুটেশন দিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তিনি আন্তরিকভাবে বক্তব্য শুনেছেন এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে প্রতিকারও করেছেন।

একবার তিনি এ জায়গাটি পরিদর্শনে এসেছেন। সেটা বোধ হয় পঞ্চাশ সালের নভেম্বর মাস টাস হবে। গোটাকয় সুন্দর সুন্দর গাড়ী আমাদের শিববাড়ী এলাকায় ঢুকলো। তখন অবশ্য এই এলাকার নাম শিববাড়ী ছিল না। তখনও শিব মন্দিরটি প্রতিষ্ঠাই হয় নি। হিরণ্ময়বাবুর সঙ্গে ছিলেন আরও জনাকয় অফিসার। আর ছিলেন তখনকার দিনের স্থানীয় কংগ্রেস নেতা কান্তিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়।

অশোকনগর তাঁতকল

গাড়ী থেকে নেমে কিছুটা রাস্তা হেঁটে গেলেন। দু’ধারের বাড়ীগুলি দেখলেন। বাসিন্দাদের সঙ্গে দু-চার কথা বললেন। ছোট ছোট বাচ্চাদের কাছে টেনে নিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। নাম ধাম জিজ্ঞেস করলেন। মুখে তাঁর প্রশান্ত হাসি ।

-বেশ তো আপনারা সব ঘরসংসার গুছিয়ে নিয়েছেন। এটাই এখন আপনাদের দেশ বলে মনে করবেন। আপনারা উদ্বাস্তু আপনারা সরকারের দাক্ষিণ্য গ্রহণ করেছেন, এসব কথা মনেও ভাববেন না। এই যে কেদারবাবু আপনারা সব রয়েছেন। এ জায়গাটার একটা সুন্দর নাম দিন না আপনারাই পছন্দ করে? সিদ্ধান্ত করে আমাদের জানিয়ে দেবেন। আমরা সেটাই গ্রহণ করব।’ কেদারবাবু, অর্থাৎ শ্রীহট্ট জেলার আজীবন কংগ্রেস সেবী এবং প্রাক্তন এ. আই. সি. সি.-র মেম্বার কেদারনাথ ভট্টাচার্য তাঁর স্বভাবসুলভ সরল হাসি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরা শীগগীরই এ জায়গার নামকরণ করব। আমাদের নাগরিক সংঘে সিদ্ধান্ত নেব। পরে আপনাকে জানাব।’ এর ঠিক একমাস পরেই এই জায়গাটার নাম রাখা হয় ‘অশোকনগর’।

(বানান অপরিবর্তিত)

4 COMMENTS

  1. খুব ভালো লাগলো পড়ে , পরবর্তি পর্বের অপেক্ষায় রইলাম

  2. লিখুন সুতপেশদা, আপনি পারবেন।আরো ডিটেলে লিখুন।

  3. চমৎকার লাগল। অশোকনগরে আগে দিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধের রানওয়ে ছিলো। সেই বিষয়ে একটু আলোকপাত হলে ভালো হত।

Comments are closed.