(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)

আত্মসমর্পণ করিয়ে সুন্দরবনের দস্যুতা বন্ধ? কিছুতেই সম্ভব নয়। এটা হচ্ছে আই ওয়াশ। বনদস্যুদের কাছে এত এত অস্ত্র তো থাকার কথা নয়। অস্ত্রগুলো র‍্যাব-ই দিয়ে দিচ্ছে। এগুলো সব নাটক…।


২০১৬ সালের নভেম্বরে রাসমেলার আগের সন্ধ্যায় দুবলার চরে বসে কথাগুলো বলছিলেন সুন্দরবন-সাগরের বড় এক মাছ ব্যবসায়ী। সে বছরের ৩১ মে থেকে শুরু হয়ে ততদিনে ৭টি দস্যুদল আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে। আমাকে বলা হলো, এসবের মধ্যে আমি কেন জড়িয়েছি? সেই বিগশট ব্যবসায়ী আমাকে বলছিলেন, বার বার একই অস্ত্র দেখিয়ে আত্মসমর্পণ দেখানো হচ্ছে। আমি বললাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র জমা দেওয়ার পর সেগুলো মামলার আলামত হিসেবে থানা হয়ে আদালতে পৌঁছে যাচ্ছে। তাহলে সেই একই অস্ত্র কী ভাবে বার বার দেখাবে র‍্যাব? জবাবে তিনি বললেন, এসব লোক দেখানো কাজ। ক্রসফায়ার ছাড়া সুন্দরবনের দস্যুদের দমন করা যাবে না।


মধ্যস্থতা করতে গিয়ে সুন্দরবনের দস্যুদের আদ্যোপান্ত জেনেছি। আর পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম বলে বুঝেছিলাম কী কারণে, কারা আত্মসমর্পণের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছিলেন? যাই হোক, মৃদু প্রতিবাদ করে নীরবে নিজের মতো করে কাজ করে যাচ্ছিলাম। এরপর ধাপে ধাপে আড়াই বছরে সুন্দরবন দস্যুশূন্য হয়ে গেল। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর শেষ ৬টি দস্যুদলের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সুন্দরবনে সংগঠিত দস্যুবৃত্তির অবসান ঘটল।


আসলে দস্যুমুক্তির আগে পর্যন্ত সুন্দরবনের মানুষকে একটা বিভীষিকার মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে। খুলনার এক প্রবীণ মাছ শিকারী আমাকে বলছিলেন— বড়শি হাতে বসে থাকি জঙ্গলে। এক একটা গলদা চিংড়া ধরার জন্য কত হাজার বার যে আল্লাহর নাম নিই! সেই মাছ যখন ডাকাতে নিয়ে যায় তখন কী কষ্টটা যে লাগে! ও আপনারা বুঝবেন না…। সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়ায় দেখা হয়েছিলো তাঁর সঙ্গে। প্রতি গোন-এ একা একা নৌকা বেয়ে খুলনা থেকে তিনি আসেন সুন্দরবনে। গোন শেষে আবার ফিরে যান। (গোন অর্থ হল, চাঁদের হিসাবে মাছ ধরার সময়)
কয়েক হাজার কাঁকড়া শিকারী সুন্দরবনে যাওয়া আসা করেন সারা বছর। বনের এই সম্পদটি বেশ দামী। অথচ কাঁকড়া আহরণের এই মহাযজ্ঞটি সুন্দরবনে চলে নীরবে। কোটি কোটি টাকার সম্পদ উঠে আসে বন থেকে।

সেই অর্থের একটি অংশের দাবি করে দস্যুদলগুলো। অবশ্য দস্যুদের সঙ্গে কাঁকড়া শিকারীদের দেখা হলেও টাকা পয়সার লেনদেন তারা সরাসরি করতো না। লোকালয়ে বসবাস করা কিছু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে এই লেনদেন হতো। সুন্দরবনের মাছ, কাঁকড়া কিংবা মধু আহরণকারীদের নিয়েই ছিলো বনদস্যুদের কারবার। এর বাইরে বড় কয়েকটি দস্যুদল সাগরে যেত, জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ নিত, কেড়ে নিয়ে আসত মাছ। সশস্ত্র জলদস্যু-বনদস্যুদের এই দলগুলোকে পরিচালনা করা হতো লোকালয় থেকে। চাঁদা সংগ্রহ, মুক্তিপণের টাকা লেনদেন, অবৈধ অস্ত্র-গুলি সরবরাহ থেকে শুরু করে বাজার পাঠানোর কাজটিও করতো ডাঙার কিছু মানুষ, যাদের বনদস্যুদের গডফাদার বলা হতো। বনের দস্যুদের রোজগার করা অর্থের বড় অংশই তাদের পকেটে যেত।
দস্যুতার চক্র নির্মূলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সদিচ্ছা ছিল। সে কার

ণেই গঠন করা হয় টাস্কফোর্স। র‍্যাবের নেতৃত্ব এই টাস্কফোর্স এর উপস্থিতি শুরু থেকেই ছিল। চেষ্টা চলছিল। কিন্তু শুধু অভিযান করে কি এত বড় একটি গহীন বনের অপরাধীদের ধরা সম্ভব? এবিষয়ে নিবিড় ভাবে কাজ শুরু করেছিলাম ২০০৯ সালে, সামুদ্রিক জলোচ্ছাস আইলা’র পর। সুন্দরবন উপকূলে কাজ করতে গিয়ে জানতে পারি যে দস্যুদের নিয়ে ভয়ানক বিপদে আছে জেলেরা। এই বিপন্ন জনপদের কথাগুলো মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে আসে না। আমি প্রথমে একটি একটি করে অনুসন্ধানী সংবাদ করতে শুরু করলাম। কাজ করতে গিয়ে কথা হল বড় বড় দস্যুনেতাদের সঙ্গে। জানলাম, দস্যু জীবন তারাও উপভোগ করে না। বরং সেই জীবন অনেক বেশি আতঙ্কের। দিন রাত মৃত্যুভয় নিয়ে বনের ভিতরে ঘুরে বেড়ায় তারা। ডাকাতি, চাঁদাবাজি আর মুক্তিপণের টাকা দিয়ে শুধু অস্ত্র গুলি কিনতে পারতো তারা। বাকি টাকা খেয়ে ফেলতো নানা জনে। কাজেই ফেরারি জীবনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর থেকে দূরে থাকা ছাড়া দস্যু জীবনে আর তেমন কোনও প্রাপ্তি ছিল না।


তাহলে এই জীবনে আছেন কেন? আত্মসমর্পণ করেন না কেন? উত্তরে বনদস্যুরা বলতো ক্রসফায়ারের কারণে তারা আর ফিরতে পারছে না। কিন্তু ইচ্ছা আছে। তখন থেকেই দস্যুদলগুলো নিয়ে সংবাদ সংগ্রহের পাশাপাশি আত্মসমর্পণে মধ্যস্থতার চিন্তা মাথায় আসে। পরবর্তীতে তিন দফা প্রস্তাব আসে আত্মসমর্পণের। কিন্তু সরকার তাতে সায় দেয়নি। সংশ্লিষ্টরা ভেবেছিলেন, আভিযানিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নির্মূল হবে দস্যুতা। কিন্তু পরে সেই ধারণা থেকে বের হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চতুর্থ দফায় আবারও একটি বড় দস্যুদলের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে। তখন র‍্যাব মহাপরিচালক ড. বেনজির আহমেদ। সিদ্ধান্ত হয়, আত্মসমর্পণের ভাবনায় রাজি হয় সরকার।
২০১৬ সালের ৩১ মে প্রথম দস্যুদলটি আত্মসমর্পণ করে। এর পর ধাপে ধাপে আত্মসমর্পণ এগিয়ে চলে। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর শেষ দস্যুদলগুলো আত্মসমর্পণ করে। সুন্দরবন হয় দস্যুমুক্ত। সেই অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাবেক দস্যুদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেন তিনি। একই সঙ্গে তাদের মামলাগুলো প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেন।

২০১৮ থেকে ২০২২। ৩২টি বনদস্যু-জলদস্যু দলের ৩২৮ জন আত্মসমর্পণ করে, জমা দেয় ৪৭০টি বন্দুক ও সাড়ে ২২ হাজার গুলি। এরপর চার বছর পেরিয়েছে। সুন্দরবন এখনও দস্যুমুক্ত আছে। মাঝে মাঝে কিছু ছোট গ্রুপ আবারও দস্যুতায় নামার চেষ্টা করে। কিন্তু আগের সেই পরিবেশ নাই বলে তারা টিঁকতে পারে না। ফলে সংগঠিত দস্যুতা এখনও ফেরেনি সুন্দরবনে। তার মানে কি ভবিষ্যতেও সুন্দরবন দস্যুমুক্ত থাকবে? বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, সুন্দরবনে এবার দস্যুতা ফিরলে আবারও নতুন করে এই বনটিকে দস্যুমুক্ত করা যাবে না। আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত দস্যুতার অবসান ঘটলেও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে তেমন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কখনওই। তারা আবারও নড়াচড়া শুরু করেছে।


সুন্দরবনের দস্যুদের পৃষ্ঠপোষক ও সহায়তাকারীদের প্রায় সবাই চিহ্নিত। বহাল তবিয়তেই আছেন তাঁরা। সময় সুযোগ এলেই আবারও আগের ভূমিকায় নামার জন্য অপেক্ষায় তাঁরা। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দস্যুতার কারণে বড় বিপদে থাকা বড় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা খুশি হননি কেন? ভাবতে হবে। কারণ সুন্দরবনকে আবারও ঝুঁকিতে ফেলা যাবে না কিছুতেই।
এদিকে সাবেক বনদস্যুদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলছে। সামাজিক পুনর্বাসন হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক ভাবে দৈন্যদশায় তারা। তার উপরে মামলা চালানোর খরচ চালাতেও হিমসিম খাচ্ছে এই মানুষগুলো। তবুও এই জীবনে ফিরে আসা নিয়ে সন্তুষ্ট তারা। শুধু সরকারের প্রতিশ্রুত মামলাগুলোর প্রত্যাহার করা হলেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে সাবেক বনদস্যুরা।