ধর্মের সম্পর্কে কেউ বাড়াবাড়ি করবে না। এই বাড়াবাড়ির জন্য বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে—
৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ আরাফত ময়দানে শেষ ভাষণে বলেছিলেন ইসলাম ধর্মের ‘প্রবর্তক’ বলে পরিচিত হজরত মহম্মদ। এই বাড়াবাড়ির জন্য তাঁর নিজের কোরেশ বংশের লোকদের হাতে অত্যাচারিত নিপীড়িত হয়ে নিজের বাসভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে (২০ বা ২৪ সেপ্টেম্বরে) তিনি মক্কা ছেড়ে মদিনা যান। এই যাওয়াকে বলা হয় হিজরত বা দেশত্যাগ। এর ১৭ বছর পর খলিফা ওমর এই হিজরতের স্মরণে হিজরি সাল গণনা শুরু করেন। হজরত মহম্মদের মৃত্যুর ৭ বছর পর।
হজরত মহম্মদ মদিনা গিয়ে দেখলেন, সেখানকার মানুষেরা দু’টি উৎসব পালন করেন। নওরোজ ও মিহিরজান। একটি বসন্তে আরেকটি শরতে। ৩০০০ বছর আগে পারস্যে অন্ধকার দূর হয়ে আলো আসার স্মারক ছিল নওরোজ। পরে এটি নববর্ষ উৎসব হিসেবে চিহ্নিত হবে। এবং ইউরোপ এই উৎসবের অনুসরণে ‘নিউ ইয়ার’ পালন করবে নাচ গান আলো পিঠে (কেক) সংযোগে।
মিহিরজান ছিল শরতের আনন্দ উৎসব। হজরত মহম্মদের ছিল বৈজ্ঞানিক মনন। তিনি কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন না। খ্রিস্টান স্ত্রী মরিয়মের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন হজরত মহম্মদের পুত্র ইব্রাহিম। শিশু অবস্থাতেই মারা যান তিনি। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি। ওই দিন সুর্যগ্রহণ হয়। মহম্মদ কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই সঙ্গী মুসলমানদের বলেন, ‘এর সঙ্গে আমার পুত্রের মৃত্যুর কোনও সম্পর্ক নেই।’
হজরত মহম্মদ (সা:) একটি যুক্তিবাদী ধর্মপ্রচারের প্রধান বাণীবাহক। পৃথিবীর অনেক ধর্মগুরু ও প্রবর্তকরা যখন নিজেদের ‘ঈশ্বরের সন্তান’ বা ‘ঈশ্বর’ বলে দাবি করেছেন, তখন তিনি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। নিজে কোনেও কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন না। মানুষের অলৌকিক ক্ষমতা নেই, সেকথা জানাতেও ভোলেননি। কোরেশরা যখন তাঁকে কোনেও অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় দিতে বলে, যথা ধুলোকে সোনা, শূন্য থেকে মিষ্টি বা কোরান নামিয়ে আনা ইত্যাদি— তিনি প্রতিটি কথার জবাবে বলেন, আমি একজন মানুষ এবং মরণশীল মানুষ।
ব্যক্তি পূজার তীব্রতম বিরোধী ছিলেন হজরত মহম্মদ। তাই তাঁর কোনও মূর্তি নেই। ছবি পর্যন্ত আঁকতে দেননি। কারণ, তিনি জানতেন, রক্তজ পৌত্তলিক মানুষরা তাহলে তাঁকেই পুজো করতে শুরু করবে। নিজেকে কখনও কোনওদিন ঈশ্বরের সন্তান বলেও দাবি করেননি। তিনি ঈশ্বরের প্রেরিত দূত—এভাবেই তাঁর ব্যাখ্যা। যে ধর্মের বা সমাজের যা কিছু ভাল, তিনি তা গ্রহণ করেছেন। যা কিছু খারাপ, তা বর্জন করেছেন। নিজ বংশ আরবে অতি উচ্চ বংশ। পৌত্তলিক। ভোগী। বিদ্বেষপরায়ণ মনোভাব অনেকের। তাই তা ত্যাগ করলেন। নিয়ে এলেন সাম্য মৈত্রী ও নারী এবং ক্রীতদাসের অধিকারের তত্ত্ব।
ইহুদিদের ছিল সিয়াম। সিয়াম মানে সংযম। উপবাস তার একটা প্রকাশ । আসল কথা আত্মসংযম। সর্ব অর্থে। মিথ্যা কথা না বলা, অন্যের অনিষ্ট চিন্তা না করা, পরচর্চা পরনিন্দা কোনও সময়েই না করা, উপবাস অবস্থায় যৌন সম্পর্কে বিরত থাকা, অসূয়া বিদ্বেষ পোষণ না করা, সুদ না খাওয়া, নেশা না করা ইত্যাদি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মোঃ আতাউর রহমান মিয়াজি মনে করেন, হিজরি দ্বিতীয় সনে ইদের প্রবর্তন করা হয়েছিল।
‘হিজরি প্রথম বছরের অষ্টম মাস অর্থাৎ শাবান মাসে রোজা বাধ্যতামূলক করার আয়াত নাজিল হয়, এবং তখন নবম মাস অর্থাৎ রমজান মাসে একমাস সিয়াম সাধনাকে ফরজ করা হয়; জানাচ্ছেন অধ্যাপক মিয়াজি।
এরপর হিজরি দ্বিতীয় সালে এসে বিধান দেওয়া হয় যে রমজান মাস – চাঁদের হিসাবে যা ২৯ দিনেও শেষ হতে পারে বা কখনও ৩০ দিনেও শেষ হতে পারে — শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদ উদযাপন করা হবে।
‘ঈদের সামাজিকতা ওই সময় থেকে শুরু হয়,” বলেছেন ইসলামের ইতিহাসের এই অধ্যাপক।
এ বিষয়ে আনাস নামে নবি মুহাম্মদের একজন সাহাবা বা সাথীর বর্ণনা করা হাদিসের উদ্ধৃতি অনুযায়ী জানা যায়, মদিনায় যাওয়ার পর নবি দেখলেন যে সেখানকার মানুষ বছরে দুইটি বড় উৎসব পালন করে।
‘নওরোজ এবং মিহিরজান নামে দু’টি উৎসব — যেগুলি সেখানকার বাসিন্দাদের ধর্ম এবং গোত্রের রীতি অনুযায়ী একটি বসন্তকালে অন্যটি শরৎকালে উদযাপিত হতো।
‘ওই দুইটি উৎসবের আদলে মুসলমানদের জন্য বছরে দুইটি ধর্মীয়, সামাজিক এবং জাতীয় উৎসব পালনের রীতি প্রবর্তন করা হয়’ বলেছেন অধ্যাপক মিয়াজি।
২৯ বা ৩০ দিন উপবাসের শেষে ইদ উল ফিতর। আরেকটি ইদ উল আজহা। দ্বিতীয়টি কুরবানি নামে বেশি প্রচলিত।
ইদের নামাজ পড়লেই হবে না, নিজের রোজগারের ২.৫% দান করতে হবে। যার নাম জাকাত। এটি স্বেচ্ছায় করতে হবে।
হারাম এবং হালাল কথাটি এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। হারাম মানে অবৈধ ভাবে রোজগারে ইদ পালন, দান ধ্যানে কোনও পুণ্য বা নেকি নাই। যতই উপবাস করো।
বৈধ সৎ পথে উপার্জিত অর্থই কেবল আল্লাহর পছন্দ। অকারণ বৈভব দেখানো, জাঁকজমক করা, তোরণ করা, আলোকসজ্জা ইসলামের আদর্শবিরোধী।
আসল কথা, দান ধ্যান আত্মসংযম ও আত্মউন্মোচন।
নিজের কাছে, নিজের আয়নায় দাঁড়ানোর উৎসব ইদ।
দেখানেপনা নয়।
অনবদ্য। তথ্যনিষ্ঠ, সুন্দর বিশ্লেষণ। মেসেজটাও অপূর্ব।