মাতৃতান্ত্রিক বেদেদের মুক্তজীবনের গল্প

নতুন শাড়ি গায়ে একটি মেয়ে এক নৌকা ছেড়ে অন্য নৌকায় উঠছে। এ নৌকায় বসা বয়স্ক মানুষটি ওর বাবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মেয়েটি নাড়ির টান ছিড়ে চলে যাচ্ছে আজ। চোখের কোনে বোধ হয় একটু জল চলে এলো লোকটির। যাবার আগে মেয়েটি একবারটি গিয়ে বসলো তার বাবার কাছে। কেঁদো না। প্রতিটি মেয়েকে যেতে হয় বাবা। যাচ্ছি স্বামীর ঘরে। মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো তারপর একটি ছোট লাফ দিয়ে উঠে পড়লো অন্য একটি নৌকায়। বেদের মেয়ে সে। এক নৌকা থেকে অন্য নৌকা, এটাই তো তাদের জীবন। এটাই তাদের প্রথা সম্পর্ক বদলের। নৌকা বদলের সাথে সাথে বদলে যায় সম্পর্ক।
মানুষও তো শেকড বিস্তার করে। জীবনযাপনে থিতু হতে আমরা সংসার গড়ি, শক্ত হয়ে বসি নিজের স্বাচ্ছন্দ্যে। এই আরামের সমান্তরালে আছে অন্য এক রকম বাঁচা, আছে এমন কিছু গোষ্ঠীর উদাহরণ যারা আজীবন শেকড তুলে রেখেছেন। গতির জীবনে যাদের কেবল সরে সরে যাওয়া। এখানে চলে যাওয়া যতটা সত্যি ফিরে আসা ততটা নয়।
গোটা বিশ্বে যাযাবর জনগোষ্ঠীগুলির স্বাভাবিক জীবন মূলত পোষ্যকেন্দ্রিক। বহু পথ ঘুরে তারা ঠাঁই খোঁজেন, খুঁজেও পান, শেষে নতুন আস্তানার রসদ ফুরোলে পুনরায় রওনা দেন অন্য কোনোখানে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও রয়েছে নোম্যাডরা – তাদের শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যে অবিচল। এখনও আছে বেদুইনরা- বাঙালির কাছে যাদের রোম্যান্টিক আবেদন চিরকালের। আছে কোচি জনগোষ্ঠী, আফ্রিকার মাসাই ও সামিরা, মোঙ্গল যাযাবর গোষ্ঠী এবং আমাদের খুব কাছে রয়েছেন বেদেরা।
বাংলা সাহিত্যে বেদেদের প্রসঙ্গ এসেছে বহু গল্প উপন্যাসে। তার বেশিরভাগই সাপ খেলা অথবা বেদেদের স্বভাবগত রহস্যময় গোপনীয়তার কথা বলে। গবেষণা সামান্য কিছু হলেও সাধারন পাঠক সে সব তথ্যের নাগাল পান না।
পশ্চিমবঙ্গ ও প্রতিবেশী পূর্ববঙ্গে এই বেদে জনগোষ্ঠী কিন্ত আজও রযেছে। বাংলাদেশে এঁদের জনসংখ্যা খুব কম নয়। এই বেদে জনগোষ্ঠীর আসল পরিচয় হল এঁদের পূর্বপুরুষরা সপ্তদশ শতাব্দীতে আরাকান ত্যাগ করে বাংলাদেশে আসেন ও ধর্মান্তরিত হন। এঁদের আদি নাম হল মনতং। দেশভাগের পর এঁদের একটা অংশ পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন।
বাংলাদেশে বেদে বা “বাইদ্যা” নামটি প্রচলিত। যার অর্থ ‘হাতুডে ডাক্তার’। ভুললে চলে না যে ভারতবর্ষে চিকিৎসকের বর্ণ “বৈদ্য” বলে মনে করা হত। সাপ খেলা দেখানো বেদেদের আর একটি পরিচয় এই যে এরা গাছ-গাছডা, সাপের বিষ প্রয়োগে বংশানুক্রমে রোগের উপশম করে আসছেন। তাহলে এদেরকে বলা চলে এদেশের আদি কবিরাজ। দুর্লভ লতা-গুল্ম-শেকডের এ দেশে আদিবাসী সংস্কৃতিতেই ওতপ্রোত হয়ে ছিল চিকিৎসা-বিজ্ঞান।
বর্তমান বাংলাদেশের ঘনশ্যামপুর, মরিচা, মুন্সিগঞ্জে নৌকার শহরে, নৌকার উপরেই বাস করছেন বেদেরা। সামাজিক সংগঠন এদের দৃঢ়। প্রাচীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের রীতি অনুসরণ করে এদের পরিবারতন্ত্রও ঝুঁকে আছে মাতৃতান্ত্রিকতার দিকে। এখানে বেদেনিরাই রোজগেরে। পুরুষের কাজ ঘর-সংসারে। বেদেদের বিয়ে হয় কিছু সহজ সাবলীল রীতি মেনে। বাবার ঘর থেকে স্বামীর ঘরে যাবার মানে বাবার নৌকা থেকে স্বামী-শ্বশুরের নৌকায় লাফ দিয়ে ওঠেন নববিবাহিতা বধূ। বিচ্ছেদ ঘটলেও ঠিক এমনই নৌকা-বদল। পিতার নৌকায় ফিরে আসে মেয়েটি।
আজও শীতের শুরুতে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাংলাদেশের বেদেনিরাই। সামান্য কিছু রসদ, সাপ রাখার ঝুড়ি ও ওষুধপত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ান গোখরো বা অজগরের খোঁজে। খেলা দেখাতে গিয়ে গোখরোর আকর্ষন সবচেয়ে বেশি এর ফনার সৌন্দর্যের জন্য। বেদেদের এই যাত্রাকে বাংলাদেশে বলে, “গাওয়াল” ।

বেদেদের জীবন নিয়ে তৈরি বেদের মেয়ে জোসনা বাংলার সর্বকালের সেরা হিট সিনেমার একটি (১৯৯১ সালে মাত্র ২০ লক্ষ টাকায় নির্মিত এই সিনেমা প্রায় ২০ কোটি টাকার ব্যবসা করে)

১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে, কলকাতার রাস্তায় মাঝে মাঝে স্ট্রিট পারফর্মারদের দেখা যেত। এরা জাদু প্ৰদৰ্শন করতো। এদের বলা হতো মাদারী। এরাও একরকম যাযাবর বেদের সম্প্রদায়ের মানুষ। মাদারীরা সাধারণত নানা রঙের কাপড় দিয়ে তৈরি একটি বিরাট ঝোলা নিয়ে ঘুরতেন। যে ঝোলার মধ্যে থাকতো বিভিন্ন আকারের বল, কয়েকটি বাটি, পালক, একটি ‘জাদু’ কাঠি এবং মানুষের ‘হাড়’ ইত্যাদি। রাস্তার কোণে খোলা জায়গায় অগণিত কৌশল এবং যাদু প্রদর্শন করতো। মাদারী কে খেল। সেই সময় এই যাযাবর গোষ্ঠীর অদ্ভুত পোশাক ও কীর্তিকলাপ মানুষের মনে কৌতূহল ও রহস্যের সৃষ্টি করেছিল।
পশ্চিমবঙ্গে বেদেরা আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন বহু এলাকায়। এই বছর বারো আগেও বেদে জনজাতির বংশগত পেশা ও সংস্কৃতি সংকটের মধ্যে পড়েছিল। বহিরাগতরা টাকা খাটিয়ে আদায় করেছিল মহামূল্যবান সাপের বিষ। বলা বাহুল্য যে বেদেরা এ টাকার কিছু পাননি। ২০১১ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণায় ৫০ একর জায়গা নিয়ে বেদেদের জন্য আদর্শ গ্রাম তৈরির পরিকল্পনা ও উদ্যোগের হাত ধরে আজ এ প্রাচীন জনজাতি নিয়ে উৎসাহ ও গবেষণা আশাপ্রদ। বেদেদের একটি গোষ্ঠী আসামেও রয়েছে।এরা আজও পেশাগতভাবে সাপখেলা দেখান। তবে পশ্চিমবঙ্গের বেদেরা আজ অনেকেই অন্য পেশার দিকে ঝুঁকেছেন।
আর্থিক সঙ্গতি এদের বেশিরভাগেরই নেই। তবে জীবনকে সহজভাবে নেবার ক্ষমতা রযেছে। চাহিদার আতিশয্য না থাকায় অপ্রাপ্তির দুঃখ অনেক কম। সাপ খেলা দেখিয়ে বা গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা করে সামান্য রোজগার হয় তবু সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলে দেখুন, বহর থেকে উত্তর আসবেই, “ভালো আছি”। পথ চলতে চলতে একগাল হেসে অভিবাদন জানবেন এদের কাছে। এদের মুক্ত জীবনের আনন্দের মুখোমুখি হয়ে আমাদের নাগরিক না-পাওয়া গুলোকে তুচ্ছ মনে হতেই পারে।