দেহদান করে ১৪০ কোটির দেশকে শিক্ষা দিয়ে গেল বাচ্চা মেয়েটি
এই জগতে কত বছর বেঁচে থাকতে পারে মানুষ?
কিছু দিন আগেই খবরের শিরোনামে এসেছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ, ফরাসি সন্ন্যাসিনী সিস্টার আন্দ্রে। ১১৮ বছর পেরিয়ে তিনি এখন আর একটি রেকর্ডকে ছুঁতে চাইছেন। সেটা জিন লুইস ক্যালমেন্ট নামে আর একজন ফরাসি মহিলার রেকর্ড। যিনি ১২২ বছর ১৬৪ দিন এই ধরাধামে কাটিয়ে গিয়েছেন। যদি সিস্টার আন্দ্রে সফল হন, তার চেয়ে আনন্দের কিছু নেই। কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয় পত্রিকা নেচার-এর গবেষণা বলছে, এই পৃথিবীতে মানুষ হয়তো বেঁচে থাকতে পারে দেড়শো বছর, তার বেশি নয়।
তবু কিছু মানুষ আরও বেশি সময় বেঁচে থাকেন এই পৃথিবীতে। সেই বেঁচে থাকা তাঁর জীবনের পরিধিকে ছাপিয়ে যায়। এভাবেই আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানের জগতের বহু মানুষ। বিশেষ কিছু কাজকর্ম, ভাবনা দেহের মৃত্যুর অনেক পরেও বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁদের।
আবার অনেকে রয়েছেন, যাঁদের মৃত্যুর পরে দেহের একেকটি অঙ্গপ্রতঙ্গ সজীব থেকে যায় অন্য মানুষের দেহে। দেহদানের মধ্যে দিয়ে অন্যের শরীরে বেঁচে থাকেন তাঁরা। ভারতে আজও দেহদান সেভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। জীবনের যাবতীয় লড়াইয়ের পর কবর কিংবা চিতাতেই সব শেষ— এমনটাই ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি আমরা।
কিন্তু সেই ১৪০ কোটি ভারতীয়কে কার্যত শিক্ষা দিয়ে গেল ৬ বছর বয়সি এক শিশুকন্যা, রলি প্রজাপতি। মৃত্যুর পর দেহদানের মধ্যে দিয়ে রলি আজও বেঁচে পাঁচটি শিশুর দেহে। দিল্লির এইমস হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁদের হাসপাতালে দেহদানের ইতিহাসে এত কম বয়সি কোনও শিশুকে খুঁজে পাননি তাঁরা। অর্থাৎ, রলিই হল সর্বকনিষ্ঠ দেহদানকারী। রলির ব্রেন ডেথ হওয়ার পর তার লিভার, দু’টি কিডনি, কর্নিয়া আর হৃৎপিন্ডের ভালভ অন্য শিশুদের দেহে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এইমসের সিনিয়র নিউরো সার্জেন ডাঃ দীপক গুপ্ত জানিয়েছেন, ১৯৯৪ সাল থেকে অঙ্গদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ওই হাসপাতালে। কিন্তু এত কম বয়সি কারও দেহদানের ঘটনা দিল্লি কিংবা সংলগ্ন শহরগুলিতে কখনও ঘটেনি।
পাঁচটি শিশুর জীবন বাঁচিয়ে দিল যে শিশুকন্যাটি, সে কিন্তু কোনও অসুখে মারা যায়নি। একটি সংবাদ সংস্থাকে দীপক গুপ্ত জানিয়েছে, নয়ডার বাসিন্দা রলিকে মাথায় গুলি করা হয়েছিল। অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর গুলিতে রলির মস্তিষ্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মাথায় বুলেট নিয়েই গত ২৭ এপ্রিল এইমস হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল শিশুকন্যাটি। ডাক্তারেরা অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। ডাক্তারেরা জানিয়ে দেন, ব্রেন ডেথ। আর কিছু করা সম্ভব নয়।
কিন্তু রলিকে বাঁচাতে না পারলেও তার অঙ্গপ্রতঙ্গগুলিকে ব্যবহার করে অন্য শিশুদের বাঁচানোর কথা মাথায় আসে চিকিৎসকদের। রলির দেহদানের জন্য তাঁরা বাবা-মায়ের কাছে প্রস্তাব দেন। তাঁদের বলেন, রলির দেহদান করলে অন্য শিশুদের বাঁচানো সম্ভব হবে। ডাঃ গুপ্ত জানিয়েছেন, দেহদানের ব্যাপারে রলির বাবা-মা ততটা অবহিত ছিলেন না। কিন্তু অন্য শিশুদের বাঁচানোর তাগিদটা তাঁরা বুঝেছিলেন। ফলে নিজেদের মেয়ের দেহদান করতে রাজি হয়ে যান তাঁরা। রলির বাবা হরনারায়ণ প্রজাপতি একটি সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন, ‘‘ডাঃ গুপ্ত ও তাঁর টিমের সদস্যরা আমাদের বুঝিয়েছেন, রলির দেহদান করলে অন্য বাচ্চারা বেঁচে থাকতে পারবে। ব্যাপারটা নিয়ে আমরা চিন্তা করেছি। তারপর মনে হল, এভাবেই তো রলিও বেঁচে থাকতে পারবে অন্যদের দেহে।’’ এমন আবেগ রলির মা পুনম দেবীর কথাতেও। তিনি ভেবেছেন, ছোট্ট রলি তাঁর জীবন শেষের পরে যদি অন্যদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, তবে তাই হোক।
রলিকে বাঁচাতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু শোকের সময়েও যে ভাবে রলির দেহদানে রাজি হয়েছেন শিশুটির বাবা-মা, তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন এইমসের চিকিৎসকেরা।