কাজ নেই রাজ্যে। গত বছর অক্টোবরে তাই আশপাশের গ্রাম থেকে আরও ২২ জনকে জুটিয়ে তেলঙ্গানার পেডাপল্লিতে ইটভাঁটার কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ওডিয়া যুবক লক্ষ্মণ লোহার। কিন্তু ওখানে যে ডাঙায় বাঘ থাকতে পারে, ভাবনাতেও আসেনি তাঁর। লক্ষ্মণের অভিযোগ, কাজে যোগ দেওয়া মাত্রই তাঁদের সব টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে বীভৎস অত্যাচার শুরু করে দেয় ভিনরাজ্যের ওই ইটভাঁটার মালিক। পকেটে কানাকড়ি নেই, অথচ পেট ভর্তি খিদে। চাইলে খাওয়ার জলও দেয় না মালিক। হতাশা আর রাগে একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন লিডার লক্ষ্মণ। কিন্তু কপালটাই খারাপ যে! বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার বেয়ে তরতরিয়ে উঠে তো গেলেন। কিন্তু পরের বড় স্টেপ নেওয়ার আগেই বিদ্যুতের এক ঝটকায় ছিটকে পড়লেন মাটিতে। সেই থেকে অকেজো তাঁর ডান হাত। এ বার? আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতেই ওড়িশার ‘টুইটার-কুইন’ দীপা বারিকের নাম কানে আসে তাঁর। ফোনেই সব খুলে বলেন লক্ষ্মণ। তারপর আর দিন চারেকও অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁদের। তেলঙ্গানা পুলিশের বিশাল বাহিনী কার্যত হাতে ধরেই ঘরে ফিরিয়েছে লক্ষ্মণদের।
নয়-নয় করে এ ভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আটকে পড়া কিংবা অত্যাচারের শিকার হাজারেরও বেশি পরিযায়ী শ্রমিককে ঘরে ফিরিয়ে এনেছেন একা দীপাই! এমনিতে মুখচোরা বছর পঁচিশের এমএসসি পাঠরতা ওই তরুণী। কিন্তু ফোন পেলেই হাত নিশপিশ করে তাঁর। না, আর পাঁচটা মেয়ের মতো ইনস্টা-রিল বানাতে নয়। রাজ্যের কেউ বিপদে পড়েছে জানলেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ট্যাগ করে টুইট করে দেন দীপা। তা সে অসহায় বৃদ্ধার প্রাপ্য পেনশন নিয়ে টেনশনই হোক, বা ঝড়ে ছাদ উড়ে যাওয়া বাড়ির মেরামতি— দীপা হ্যায় না?
কে এই দীপা? সুষমা স্বরাজের মতো কোনও মন্ত্রী-সান্ত্রী নাকি! না, ওড়িশার টেমরির এই গেঁয়ো মেয়ের সরকারি কোনও পোর্টফোলিও নেই। তবু সরকার সমঝে চলে তাঁকে। টুইটারে নাম @চারুবালা বি। টেনেটুনে হাজার ছয়েক ফলোয়ার। মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের প্রশাসন তবু সিঁটিয়েই থাকে— এই বুঝি এলো দীপার কমপ্লেন টুইট। অথচ কি আশ্চর্য, ২০১৯-এর আগে মেয়েকে একটা স্মার্টফোনও কিনে দিতে পারেননি দীপার চাষি বাবা এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী মা। ফোন-কম্পিউটারের খুঁটিনাটি তাই বছর তিনেক আগে পর্যন্তও প্রায় কিছুই জানতেন না দীপা বারিক। সে দিনের ওই গোবেচারা দীপাই আজ আর পাঁচটা লোকের কাছে মসিহা। তরুণীর দাবি, গত তিন বছরে সব মিলিয়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষের সমস্যার সমাধান করেছেন তিনি শুধু একটা করে টুইট করে। তবে এ ক্ষেত্রে কাকে, কখন টুইট করতে হবে, এটা জানা খুব জরুরি।
গ্রামের সাধারণ একটা মেয়ে এত সব জানলেন কী করে? দীপার কথায়, ‘ফোন নিয়ে খুটখাট করতে করতেই এলাকার সমাজসেবী হিসেবে পরিচিত দাদা দিবসকুমার সাহুর কাছে আমি টুইটার সম্পর্কে জানতে পারি। উনিই আমায় শিখিয়ে দেন, কোনও সমস্যা নিয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে কী ভাবে, কাকে টুইট করতে হয়।’
জন্মদিনে প্রথম স্মার্ট ফোন গিফট পাওয়ার বছরেই রাজ্যে ফণীর সেই তাণ্ডব এখনও ভুলতে পারেননি দীপা। পাশের গ্রামে সৌকিলাল ও তাঁর স্ত্রী ঝড়ে ঘরবাড়ি খুইয়ে পথে বসেছিলেন। খবর পেয়েই ছবি-সহ সৌকিলালের অবস্থা বিস্তারিত জানিয়ে পাঁচ লাইনের টুইট করেন তরুণী। মনে একটু দ্বিধা রেখেই ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর এমনকী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেও সেই টুইট ট্যাগ করে দেন। হাতেনাতে ফল মেলে ঠিল ৪৮ ঘণ্টার মাথায়। খোদ বিডিও এসে ঘুরে যান সৌকিলালের আস্তানা। ওই সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই বাড়ি মেরামতির জন্য ৯৮ হাজার টাকা ঢোকে সৌকিলালেল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। একই ভাবে বিলাসপুরের চাষিদের হয়ে আওয়াজ তুলে ছ’দিনের মধ্যে চেকপোস্টও সারিয়ে দিয়েছেন দীপা। কে কখন কী অভিযোগ নিয়ে আসবে, সে সবের আর অপেক্ষা করেন না দীপা। এক টুইটে মুশকিল আসানের নেশায় দীপা আজকাল সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েও গ্রামওয়াড়ি সফরে। কলেজের অধ্যাপক হতে চাওয়া তরুণীর কথায়, ‘মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই তৃপ্তিটা কোটি টাকার। যা-ই হয়ে যাক এই অভ্যেসটা ছাড়ছি না।’
এ জন্য অবশ্য শুধু নিজের ঢাক পেটাতে নারাজ দীপা। তাঁর কথায়, ‘রাজ্য সরকারের ফাইভ-টি প্রকল্প অর্থাৎ প্রশাসনের কাজে গতি আনতে ট্রান্সপারেন্সি, টিমওয়ার্ক, টেকনোলজি, টাইমলিনেস ইত্যাদি খুঁটিনাতিতে সরকার পক্ষেরই জোর নজদরদারি না-থাকলে বোধহয় কিছুই করতে পারতাম না।’ কেন্দ্র সরকারের হয়ে একাধিক মন্ত্রক সামলানোর সময়ে এক টুইটে এ ভাবে মুশকিল আসান করতেন প্রয়াত সুষমা স্বরাজও। পাবলিক জানত, মন্ত্রীকে টুইট করলে কাজ হয়। কিন্তু দীপা তো আর কেউকেটা নন! প্রথম দিকে তাই, প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা দীপার টুইট দেখলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। আজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাই পাশে— ঘাড় সোজা রেখে বললেন দীপা।