(মহাকাশে নিখুঁত ভাবে ১০৪টি কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনের বিশ্বরের্কড ভারতের হাতেই। তার আগে, হলিউডের ব্লকবাস্টার সিনেমা ‘গ্র্যাভিটি’-র থেকেও কম খরচে ভারতের মঙ্গলযান অভিযান চমকে দিয়েছিল গোটা দুনিয়াকে। আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, জাপান কেউই প্রথমবারে মঙ্গল অভিযান সফল করতে পারেনি। কিন্তু ভারত এক চান্সেই পাশ। মহাকাশ অভিযানের এই সব সাফল্যের পথ ধরেই কৃত্রিম উপগ্রহ (Artificial satellite) স্থাপনের ব্যবসায় বিশ্বের প্রথমসারির দেশগুলির আধিপত্যে থাবা বসাচ্ছে ভারত। লিখেছেন সুবীর বিশ্বাস।)

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। দিনটা ছিল শুক্রবার। ভারতীয় সময় সকাল ৯ টা ২৭ মিনিট। কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেল…৩, ২, ১, ০।
গোটা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে দেখল, ভারতের শ্রীহরিকোটা থেকে একটি রকেট মহাকাশে উড়ল। আর সেটি নিখুঁত ভাবে ভূপৃষ্ঠের নিকটবর্তী কক্ষে পর পর ১০৪টি কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করল। হ্যাঁ, বিশ্বরেকর্ড। এর আগে ছিল রাশিয়ার ৩৯টি কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর কৃতিত্ব। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ইসরো এক লহমায় ভেঙে দিল সেই সব রেকর্ড। উপগ্রহগুলির মধ্যে একটি ছিল বেশ বড়— ৭১৪ কেজির, ভারতের কার্টোস্যাট-২। বাকি ১০৩টি ন্যানো উপগ্রহ। ২টি ভারতের, ৯৬টি আমেরিকার আর কাজাকস্তান, ইজরায়েল, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর একটি করে।
ভারতীয় রকেটটি ছিল PSLV C37 (৩৭তম polar satellite lunching vehicle) মেরু উপগ্রহ স্থাপন যান। নিরক্ষীয় তলের লম্ব তলে আবর্তিত ভূপৃষ্ঠের ৭০০-৮০০ কিলোমিটার ঊর্ধ্বের এই মেরু কক্ষ। মোটামুটি ২ ঘণ্টায় একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। ভূপৃষ্ঠ থেকে সংকেত আসতে যেতে মাত্র ০.০১ সেকেন্ড সময় লাগে। এই মেরু কক্ষের রকেটে (PSLV) ভারত এখন বিশ্বসেরা।

এর অনেক উপরে ৩৬০০০ কিলোমিটার ঊর্ধ্বে নিরক্ষীয় তলে রয়েছে ভূসমলয় বা পার্কিং কক্ষ। তার সঙ্গে সামান্য কোণের কক্ষে উপগ্রহ স্থাপনের রকেটকে বলা হয় GSLV বা জিও সিনক্রোনাস উপগ্রহ স্থাপন যান। এই সমস্ত কক্ষে রয়েছে আমাদের টিভি উপগ্রহগুলি। প্রদক্ষিণ কাল ২৪ ঘণ্টা। প্রায় ৭২০০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সংকেত যাতায়াতে প্রায় ১/৪ সেকেন্ড সময় লাগে। এটা বোঝা যায় টেলিভিশনে লাইভ টেলিকাস্টের সময়। স্টুডিও থেকে অ্যাঙ্কর কিছু প্রশ্ন করলে ঘটনাস্থলের রিপোর্টারকে কিছু সময় পর মাথা নেড়ে উত্তর দিতে দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে অবশ্য ভারত একটু পিছিয়ে রয়েছে।
তবে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনের ব্যবসায় ভারতের একেবারে সামনের সারিতে উঠে আসার কারণ মূলত দু’টি। স্বাধীনতার ঠিক পরেই মহাকাশ গবেষণায় প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর বিশেষ নজর দেওয়া। একদিকে গবেষণা কেন্দ্র ইনকসপার থেকে ইসরো। আর থুম্বা থেকে শ্রীহরিকোটায় রকেট লঞ্চিং কেন্দ্র স্থাপন । অপরদিকে অ্যাস্ট্রো ফিজিক্স পড়াশোনার জন্য আইআইটি-সহ আরও বেশ কয়েকটি উৎকর্ষ শিক্ষা কেন্দ্র।
দীর্ঘ সময় ধরে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনের ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল আমেরিকা, ফ্রান্স, ইউরো এজেন্সি ও চিনের। ভারত এই ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বিশ্ববাজারে ভালই থাবা বসিয়েছে। ইদানীং আবার অতিগতির ব্রডব্যান্ড সস্তা হওয়ার কারণে জনপ্রিয় হওয়ায়, ছোট উপগ্রহ স্থাপন বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। গত তিন বছরে (২০১৯ থেকে ২০২১) ভারতের রাষ্ট্রীয় সংস্থা NSIL (New Space India ltd) ৩৫ মিলিয়ন ডলার ও ১০ মিলিয়ন ইউরো আয় করেছে।
ভারতের উপগ্রহ স্থাপনের যান তিন ধরনের। ভূপৃষ্ঠের নিকটবর্তী কক্ষে ছোট কৃত্রিম উপগ্রহের জন্য SSLV (small satellite lunching vehicle) অপেক্ষাকৃত বড়র জন্য PSLV (polar satellite lunching vehicle) আর ভূসমলয়-সহ মঙ্গল বা তার থেকেও দুরের বা মনুষ্যবাহিত যানের জন্য GSLV mk3। এটি ক্রায়োজনিক বা অতি নিম্ন তাপমাত্রার (-১২০°C এর কম) প্রযুক্তির ইঞ্জিন। আমেরিকার চাপে রাশিয়া এই প্রযুক্তি ভারতকে দিতে রাজি না হওয়ায় প্রায় দু’দশক ধরে অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে ইসরোর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এই রকেটটি বানিয়েছেন। আবার আমেরিকায় যেমন ইলন মাস্কের (বিখ্যাত ইলেকট্রিক গাড়ি কোম্পানি টেলসার মালিক) স্পেসএক্স কর্পোরেশন, তেমনই ভারতে উদ্যোগপতিদের সাহায্যের জন্য তৈরি হয়েছে IN-SPACE ( Indian National Space Promotion & Authorisation Center) । যার মাধ্যমে ইসরো বা উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের সুযোগসুবিধা শিল্পপতিরা পেতে পারেন। ইসরোর আরেকটি শাখা ACL ( Antrix Corporation ltd)। ভারত সরকারের একটি লিমিটেড কোম্পানি। মহাকাশ প্রোডাক্ট, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং কনসালটেন্ট সার্ভিস দিয়ে থাকে।

ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মহাকাশ অভিযানের আরেকটি ঘটনা চিরস্মরণীয়। মঙ্গলায়ন-১ বা মঙ্গল অভিযান। ২০১৩ সালের নভেম্বরে উৎক্ষেপণ এবং ২০১৪র সেপ্টেম্বরে এটি মঙ্গলের কক্ষে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে একমাত্র দেশ ভারত এক চান্সে পাশ করে। আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, জাপান কেউই প্রথমবারে মঙ্গল অভিযান সফল করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, এত সস্তায় এই ধরনের অভিযানের কথা কেউ ভাবতেই পারেনি। মাত্র ৭০ মিলিয়ন ডলার, হলিউডের ব্লকবাস্টার সিনেমা ‘গ্র্যাভিটি’-র খরচের চেয়েও কম। যেখানে আমেরিকার খরচ হয়েছিল ৬৭০ মিলিয়ন ডলার। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ অবশ্য ভারতের এতবড় সাফল্যকে হেয় করে কার্টুন ছেপেছিল। জনমতের চাপে পরে ক্ষমা চেয়ে নেয়।
এখন অবশ্য আগামী পরিকল্পনা সাজিয়ে এগোচ্ছে ইসরো। প্রতি মাসে একটি অভিযান। গত তিন বছরে ভারত বিদেশি গ্রাহকের ৪৫টি ছোট-বড় কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পাঠিয়েছে। ইতিমধ্যেই বিদেশি ক্রেতার সঙ্গে ৪টি বড় চুক্তি করেছে। সুতরাং উপগ্রহ স্থাপন ব্যবসায় ভারতের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল।