গোলাবারুদ নিয়ে লড়াই করেন না এদের কেউ। সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের সঙ্গে দূরদূরান্ত পর্যন্ত সম্পর্ক নেই। তবু নেহাত পদবির কারণেই আতঙ্কিত বাংলার একটি বিশেষ অংশের মানুষ। নিজেদের ‘জঙ্গি’ পদবিটি ছাড়তে পারলেই যেন বেঁচে যান তারা। আর সেই চেষ্টাতেই চার পুরুষের পরিচয় বদলে ফেলার চেষ্টা। তফেল শেখ জঙ্গি-র পরিবারের সদস্য নিজের পদবি পাল্টে অর্ণব আলী। বীথিকা খাতুন জঙ্গি এখন বীথিকা খাতুন।
জঙ্গি’ শব্দের আবির্ভাব ‘জঙ্’ থেকে, যার অর্থ ‘যুদ্ধ’। যিনি যুদ্ধ করেন, তিনি ‘জঙ্গি’। শব্দটির সঙ্গে শৌর্যের, বীরত্বের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। অথচ বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের প্রভাবে আধুনিক সময়ে জঙ্গি শব্দটি যে ব্যঞ্জনা অর্জন করেছে, তা নদীয়ার ধুবুলিয়া নিবাসী একটি পরিবারের পক্ষে এক মর্মান্তিক কলঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অগত্যা নিজেদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা অক্ষুণ্ন রাখতে ‘জঙ্গি’থেকে ‘আলী’তে পরিবর্তন । তফেল শেখ জঙ্গির বর্তমান বংশধর পদবি বদলে হয়েছে অর্ণব আলী, বীথিকা খাতুন জঙ্গির পরিচয় বীথিকা খাতুন নামেই।
অর্ণব আলীর চার পুরুষের নাম যথাক্রমে: তফেল শেখ জঙ্গি—নাসিরউদ্দিন শেখ জঙ্গি—নওশের আলী শেখ জঙ্গি—পিন্টু জঙ্গি। দেশভাগের পর এপার বাংলার যেসব মুসলমান দেশ বদলায় নি তাদের তালিকায় আছে বর্তমান নিবন্ধকারের মা সামসুন্নাহার জঙ্গির পরিবার। তিনি নাসিরউদ্দিন শেখ জঙ্গির কন্যা। বর্তমানে অর্ণব আলী এই পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ উত্তরসূরি। অর্ণব আলী পূর্বপুরুষদের পদবি ‘জঙ্গি’ সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করেছে। নাসিরউদ্দিন শেখ জঙ্গির এক উত্তরসূরি দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গে (বাংলাদেশ) চলে গিয়েছিলেন, সেই পরিবারও তাদের জঙ্গি পদবি বজায় রাখতে পারেনি।


‘জঙ্গি’ নিছক একটি শব্দ মাত্র। কিন্তু শব্দের সঙ্গে মিশে যাওয়া আতঙ্ক ক্রমাগত দৃষ্টি আকর্ষণ করে যায়। শুধু এই ধ্বনিটুকুর কারণেই পিন্টু জঙ্গির পরিবারকে বারংবার অনর্থক দুর্ভোগের বোঝা বইতে হয়েছে। পদবির কারণেই সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজন এমন সব মন্তব্য করে গেছেন যাতে পরিবারটি রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। অবশেষে একসময়ে গত্যন্তরহীন অবস্থায় পারিবারিক ইতিহাসের আধার পদবিটি পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ মুক্তি— নিছক একটি শব্দ থেকে নয়, সামাজিক বিড়ম্বনা থেকে, নিরাপত্তাহীনতার ভয় থেকে। ‘জঙ্গি’ পদবি ছেড়ে তাঁরা শুধু আলী বা শেখ হয়েছেন। বীথিকা খাতুন এই পরিবারের পুত্রবধূ। তাঁর বিবাহ পূর্ববর্তী পদবি ছিল খাতুন, কর্মজীবনে দুর্গতির শিকার হওয়ায় তিনি প্রাক-বৈবাহিক পদবিকেই ফের আঁকড়ে ধরেছেন।

নামে কিছু না-ই এসে যেতে পারে, কিন্তু পদবিতে যে ক্ষেত্রবিশেষে অনেক কিছুই এসে যায় তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। আর পদবি-জ্ঞাপক শব্দটিকে ঘিরে যদি সামাজিক সংশয়, শঙ্কা ও সন্দেহ জমে ওঠে, তাহলে আর রক্ষা নেই। নদীয়া জেলার ধুবুলিয়ার পরিবারটি সেই বিড়ম্বনার শিকার। দুর্ভোগ থেকে বাঁচার তাগিদেই সুদীর্ঘকাল ধরে বয়ে চলা পদবি ছেঁটে ফেলতে হয়েছে তাদের। নিছক সামাজিক ভীতির কারণে মুছে গিয়েছে একটি পারিবারিক ইতিহাস।
অথচ ভারতে ছয়ের দশকে জয়সুখলাল হাতি নামে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর পদবি এমন সন্দেহের উদ্রেক কখনও করেনি যে তিনি অরণ্যবাসী ছিলেন। কিংবা ‘সিংহ’ পদবিধারী মানুষদের আশপাশে যাদের ঘোরাফেরা, তারা আক্রান্ত হবার আতংকে ভোগেন, এমন কথাও কারুর জানা নেই। কিন্তু এই বাংলায় শুধু ‘জঙ্গি’ পদবি ধারণ করার কারণে একটি পরিবারকে অহেতুক অমর্যাদা ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার হতে হবে কেন, এই প্রশ্নের উত্তর দেবার দায় কেউ কখনও বোধ করেনি।