পর্ব ১৮

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন। ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

কী হয়েছে মোস্তফা শেখের সঙ্গে? একটা লোক চাইছিল একটু শান্তির জীবন। স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে গ্রামের এক কোণে ভাঙাবাড়িতে একটা সংসার। আর তো কোনও চাওয়া ছিল না। তবুও লোকটাকে পালিয়ে যেতে হল। লোকটা তবুও নিরাপদ জীবন পেল না। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছিল লোকটাকে। খোঁজ করার চেষ্টা করলাম, কোথায় গেল মোস্তফা শেখ? উত্তর পেলাম না। সেই কবে ২০১১ সালে যখন প্রথম দেখা হয়েছিল। ধীরে ধীরে মনে পড়ছিল সেই দিনগুলি। আমি গিয়েছিলাম রাজুবাহিনীর ডেরায়। সেই দলের একজন সাধারণ জলদস্যু ছিল মোস্তফা শেখ। অনেকের মতো তার সাথেও পরিচয় হয় আমার। ওখানে ইলিয়াস ছিল, নোয়া মিঞা ছিল। মোস্তফাও ছিল। তখন সাগর ছদ্মনামে চিনতাম তাকে।

রাজুবাহিনীর আস্তানা থেকে ফিরে আসার পরেও মোস্তফা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতেন। ফোনে কথা হতো আমাদের। এরপর একদিন উনি ডাকাতির লাইন ছেড়ে দেন। চেষ্টা করছিলেন সাধারণ জীবনে ফিরে আসার। এই সময়টায় প্রতিনিয়ত উনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। এমনকি, আমার সঙ্গে দেখা করতে ঢাকাতেও এসেছিলেন। ২০১৩ সালে ইলিয়াস অনেকবার চেষ্টা করেছিল মোস্তফাকে তার বাহিনীতে নিতে। কিন্তু মোস্তফা যাননি। চট্টগ্রামের কক্সবাজারে তিনি তখন পলাতকের জীবন কাটাচ্ছিলেন। এই সময় একটি কন্যাসন্তান হয় তার। তার কন্যাসন্তান হবার খবর তিনি আমাকে ফোন করে জানান। সেদিন তার গলা শুনে মনে হচ্ছিল, মোস্তফা একজন গর্বিত বাবা। খুব খুশি ছিলেন। তারপর একদিন মামলা সামাল দিয়ে মোস্তফা ফিরে আসে নিজের গ্রামে। আমি ছিলাম সেখানে। বড় ভাল কেটেছিল সেই রাতটা আমার। সেই রাতে মোস্তফা শপথ নিয়েছিল— আর কখনও ওই পেশায় যাবো না। আমি একটু শান্তির জীবন চাই।

মোস্তফা শেখ ও তার রাজকন্যা মার্জিয়ার সাথে আমি ও বায়েজিদ ইসলাম পলিন (আত্মসমর্পণের পরে )

দীর্ঘ এতগুলি বছর ধরে আমি সুন্দরবনে যাচ্ছি। মোস্তফা শেখ আমাকে সেই কথাটাই শুনিয়েছিল যা আমি সুন্দরবনের সমস্ত ডাকাতদের কাছে শুনতে চেয়েছিলাম— “আমি কোনওদিন ডাকাতি করবো না।” আমার ভেতরে একটা অজানা সুখ অনুভব করেছিলাম। ফিরে এলাম আমার নিজের বাড়িতে। ঢাকায়। কেটে গেল দু-তিন মাস।

আচমকা একটা ফোন এলো আমার কাছে। মোস্তফা শেখ। “দাদা ওরা আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে , আমাকেও মেরে ফেলবে। আমি কোথায় যাবো? কোথায় থাকবো জানি না। বেঁচে থাকলে দেখা হবে।” যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মোস্তফা শেখের সঙ্গে। খবর পাচ্ছিলাম না। বেশ কিছুদিন পরে শুনলাম, মোস্তফা আবার জলদস্যু দলে যোগ দিয়েছেন।

লোকটার দোষ ছিল একটাই । জীবনে একটু শান্তিতে বাঁচার চেষ্টা। সহ্য হয়নি উপরের দস্যুদের। টাকার অনন্ত মহিমা। ক্ষমতার অনন্ত মহিমা। পাছে মোস্তফা শেখের মতো আরও লোক জলদস্যুর পেশা ছেড়ে দেয়। তাই মোস্তফাকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া যাবে না। ওকে আবার জলে নামতে হবে বা পালিয়ে বেড়াতে হবে। এটাই ভবিতব্য ছিল মোস্তফার।

ইলিয়াস তখন জলদস্যুবৃত্তি ছেড়ে চলে গিয়েছে। ওর জায়গায় নেতা নোয়া মিঞা। তার দলে যোগ দিয়েছেন মোস্তফা। নোয়া বাহিনীতে ঢুকে তিনি একদম চুপচাপ হয়ে যান। সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। আমি তাকে খবর পাঠাই। কিন্তু তিনি চুপচাপ। সব রকম যোগাযোগ তিনি বন্ধ করে দেন।

আমার মনে হয়েছিল, কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারার কারণে মোস্তফা আমার সঙ্গে কথা বলছেন না। সেই সময় তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলাম। চেষ্টা করছিলাম, তারা যেন একটু শান্তিতে থাকতে পারেন। এরই মধ্যে একদিন হঠৎ একটা অপরিচিত নম্বর থেকে মোস্তফা ফোন করেন আমাকে।

—‘‘ভাই আমি তো লজ্জায় আপনাকে ফোন দিতে পারছি না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার আর কোনও উপায় ছিল না। তাই আবার এই পথে ফিরতে হল আমাকে।’’

আমার যেন একটু অভিমান হয়েছিল সেদিন। আমি বললাম, ‘‘করতে থাকেন ডাকাতি। আমার কি বলার আছে?’’

মোস্তফা বলল, ‘‘একটা জিনিস আমি আপনাকে জানায় রাখি। যদি বেঁচে থাকি, আপনাকে ভাল কোনও খবর দেবো।’’

একথা বলে ফোন কেটে দেয় মোস্তফা। তারপর থেকে সব যোগাযোগ বন্ধ।

কেটে গেল বেশ কিছুদিন।

সময়টা ২০১৪ সালের মে-জুন মাস। খবর পেলাম, সুন্দরবনে নোয়াবাহিনীতে বিদ্রোহ হয়েছে। নোয়া আর ওই বাহিনীর নেতা নন। নতুন নেতা মাস্টার। আর ওই দলটির নাম হয়েছে মাস্টারবাহিনী। আর সেই মাস্টার হলেন মোস্তফা শেখ! এক সাধারণ জলদস্যু থেকে দস্যু নেতা।

আমাকে ফোন করলেন মোস্তফা শেখ ওরফে মাস্টার।

—ভাই আমি মোস্তফা।

—আরে ভাই, আপনাকে আমি কতদিন খবর পাঠাচ্ছি।

—ভাই আপনার সাথে কথা বলবো সেই মুখ আমার নাই। তবে ভাই একটা খবর দিই। আমি আত্মসমর্পণ করার একটা পরিবেশ তৈরি করছি। পরিস্থিতি মতো আপনাকে জানাবো।”

এইটুকু বলে ফোনটা কেটে দিল মোস্তফা।

মাত্র ছয়জন সঙ্গে ছিল মোস্তফার। সেই ছয়জনকে নিয়েই একটা সুচতুর পরিকল্পনা করে পুরো বাহিনীর দখল নেন মোস্তফা। সেই সময় আলিফ, জাহাঙ্গীর-সহ কয়েকজন দস্যুনেতা এক হয়ে সুন্দরবনে দস্যুতা চালাচ্ছিলেন। আর মোস্তফা তখন সন্তর্পনে দলের মধ্যে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। 

আচমকা আমি যেন আবার একটা সোনালী রেখা দেখতে পেলাম। সুন্দরবনের জলদস্যুদের মধ্যে অন্তত একজন আছেন, যিনি মনেপ্রাণে চান আত্মসমর্পণ করতে, শান্তির জীবন ফিরে পেতে। যিনি অন্তত বুঝতে পেরেছেন, জলদস্যু জীবনের শেষ কারও ভাল হতে পারে না। এটা ঠিক, হয়তো অনেকে চেয়েছেন সুস্থ ভাবে জীবন যাপন করার জন্য আত্মসমর্পণ করতে। কিন্তু যে কোনও ভাবে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সর্বান্তঃকরণ চেষ্টা শুধুমাত্র মোস্তফার মধ্যেই ছিল।

কিন্তু একদিক থেকে চেষ্টা করলে তো হবে না। চেষ্টা করতে হবে দুই দিক থেকে। যদি জলদস্যুরা দু-পা বাড়ায় তবে প্রশাসনের দিক থেকেও তো এক পা বাড়াতে হবে। সরকারকেও তো কিছু ইনিশিয়েটিভ নিতে হবে। কিন্তু সেই কাজটা করবে কে? কে দায়িত্ব নেবে সরকারের কানে খবর পৌঁছে দেবার? আমি সেই আইলার পর থেকে চেষ্টা করছি সুন্দরবনকে একটা সুন্দর সকাল উপহার দেওয়ার। যেখানে থাকবে না বারুদের গন্ধ। থাকবে না ভয়। মনে মনে স্থির করলাম, আবার যাবো সেই লোকগুলির কাছে। প্রশাসনের কর্তাদের কাছে। সুন্দরবনের অন্তত একটি বাহিনী যদি আত্মসমর্পণ করে তবে সেটাই একটা উদাহরণ হতে পারে। আমাকে আরও চেষ্টা করতে হবে। নতুন উদ্যমে নেমে পড়লাম আমার কাজে।

মোস্তফার বিদ্রোহ ও বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া কোনও রহস্য রোমাঞ্চ সিনেমার প্লটের থেকে কম নয়। বলবো সেই কথা আগামী পর্বে।

(ক্রমশ)

2 COMMENTS

Comments are closed.