রাজাবাজার ট্রাম ডিপুউউ “— উচ্চকণ্ঠে হাঁক ছেড়ে কন্ডাক্টর বাসের দেওয়ালে একটা থাপ্পড় মারল। আমি আসন ছেড়ে গেটের দিকে এগোতে লাগলাম। সামনেই শিয়ালদা স্টেশনে নামতে হবে। ভীড় বাসে সব সময় জায়গা পাওয়া যায় না। বসলে তবু কোথায় এলাম জানলা দিয়ে দেখা যায়। দাঁড়িয়ে থাকলে বাস কত দূর পৌঁছলো— তা জানার জন্যে কন্ডাক্টর বা সহিসের চিৎকারই একমাত্র ভরসা।
কলকাতার কলেজে নতুন ভর্তি হয়েছি — তখনও কোনও হোস্টেলে একটা চৌকি জোটেনি। তাই রোজ বাড়ি থেকে ট্রেনে দেড় দেড় তিন ঘণ্টা যাতায়াত করতে হয়। কলেজে আসার সময় দমদম বা উল্টোডাঙায় নামা চলে, কিন্তু ফেরার বেলায় শিয়ালদা থেকে ট্রেন না ধরলে বসা তো দূরের কথা সিটের কাছাকাছি পৌঁছনোও সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বনগাঁ লোকালের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। শ্যামবাজার থেকে শিয়ালদা যখন আসি, তখন প্রথম প্রথম খুব উৎকন্ঠা থাকত, ঠিক জায়গায় নামতে পারব তো? বেশ কিছুদিন যাবার পর ফুটপাথে একটা নিশানা চিহ্নিত করে ফেললাম। একটা ছোট গাছের নীচে কাঠের গুমটিতে ঠেস দিয়ে বেশ কিছু পরিত্যক্ত মাটির প্রতিমা থাকত। এক কালে কত মাইক বাজিয়ে এদের পূজা অর্চনা হয়েছে , এখন তারা গাছের তলায় আশ্রয় নিয়েছেন। কারও মুকুট উড়ে গেছে, কারও মাটি গলে গিয়ে বাঁশের কাঠামো মাত্র অবশিষ্ট — কি ঠাকুর ছিল তা আর বোঝার উপায় নেই। ভিড় ঠাসা বাসে মানুষের ফাঁক দিয়ে এসব ঠাকুর দেবতাদের দেখতে পেলেই বুঝতাম, এবার ঠেলেঠুলে এগোতে হবে শিয়ালদা স্টেশনে নামার জন্য। ফস্কে গেলেই একেবারে ফ্লাইওভারের ওপারে প্রাচী সিনেমায় নামতে হবে— একটা ট্রেন মিস।

এই দেবদেবীর বৃদ্ধাশ্রমটাই আমার নিত্যযাত্রার ল্যান্ডমার্ক হয়ে উঠল। কিছুদিন পর আবিষ্কার করলাম, ঠাকুর দেবতার সঙ্গে একজন মানুষও ওখানে বাস করে। শীর্ণকায়া মাঝবয়সি এক মহিলা বেশিরভাগ সময়েই শুয়ে থাকে— তার সমস্ত রং-রূপ রাস্তার কালো ধুলো ঢেকে দিয়েছে। মেয়েমানুষ তো, গয়না একটু যেন থাকতেই হয়। আছেও। হাতে দু’গাছা চুড়ি অ্যালুমিনিয়ামের— সোনালী রঙের প্রলেপ কবে ঘুচে গেছে। চুড়িগুলো একা নয়, শাখা পলাও রয়েছে— কেউ কখনও ক্ষণিকের জন্য হলেও মানুষটাকে ভালবেসেছিল, তারই আভাস। পাগলীটা কখনও বসে বসে হাসে, কখনও ঘুমায় হাত দু’টো ছড়িয়ে দিয়ে। অধিকাংশ সময় মৌলালির দিকেই পা দু’টো থাকে তাই ডান হাতটা বেশি চোখে পড়ে। মাটির মূর্তির সাথে এই মানবী প্রতিমাও কালক্রমে আমার কাছে স্থান নির্দেশক চিহ্ন হয়ে উঠল।


কয়েকমাস যাতায়াতের পর ছাত্রাবাসে একটা আসন জুটে গেল। রোজের বদলে এখন সপ্তাহান্তে বাড়ি যাতায়াত করি। পথ এখন অনেক চেনা হয়ে গেছে, তাই কোথায় নামতে হবে সেই উৎকন্ঠা আর নেই। শিয়ালদাতে বাস থেকে নামার পরে তবুও অভ্যাসবশত পাকুড়গাছটার দিকে তাকাই। ঠাকুর দেবতা আরও কিছু নতুন জুটেছে — কারও রং আছে ,কারও ধুয়ে গেছে। আজকাল পাগলীটাকে আর দেখি না ওখানে, বেশ কয়েকমাস হয়ে গেল। আবার কোথায় আশ্রয় নিয়েছে কে জানে?
ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের আড্ডা হয় ক্যান্টিনে, ওখানে ভিড়ে জায়গা না হলে কর্মী আবাসের গলিতে চায়ের ঠেকে, যার আদরের নাম ‘ফাইভ স্টার’। কিছুদিনের মধ্যেই আর একটা নিরিবিলি জায়গা আমাদের জমায়েতের ঠিকানা হয়ে উঠল— সেটা অ্যানাটমির ডিসেকশন হল। শতাব্দী প্রাচীন খালপাড়ের মেডিক্যাল কলেজের শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে বেশ বড় বড় শ্বেত পাথরের টেবিল আর বর্মাটিকের চেয়ার ছিল। ডিসেকশন হলের ফর্মালিনের গন্ধ সহ্য করতে পারলে এ এক অন্যরকম আরামের জায়গা। উঁচু ছাদ থেকে লম্বা লম্বা লোহার দন্ডে সিলিং ফ্যান ঝুলছে— অন্য ঘরগুলির থেকে এখানে গরম কিছুটা কম। প্রথম যেদিন অ্যানাটমি বিভাগে গিয়েছিলাম— সেদিন ভয় নয়, কেমন একটা অনভ্যস্ততার অস্বস্তি ডিসেকশন হলে ঢুকতে বাধা দিয়েছিল। মৃত মানুষের চর্বি যখন বাধ্য হয়ে হাতে লাগাতেই হল তখন অপরিচিত জগত থেকে পরিচিত গন্ডিতে অনায়াসে ঢুকে গেলাম। আমাদের গ্রুপের যে ক’জন উৎসাহ নিয়ে শব ব্যবচ্ছেদ করতাম, তাদের কাছে ডিসেকশন হলটা খুব প্রিয় হয়ে উঠল। তখন গ্লাভস পরা বারণ ছিল, তাই ডিসেকশন শেষ করে বেশ খানিকক্ষণ কার্বলিক সাবান ঘষতে হতো হাতের চর্বি ছাড়াতে। তাতে কী যায় আসে? সানন্দে আমরা ওখানে খাওয়াদাওয়াও সারতাম। এর ওর বাড়ি থেকে বয়ে আনা টিফিনের ভাগাভাগি মড়া কাটার সাথে সাথেই চলত। যার হাতে ছুরি-কাঁচি তাকে অন্য কেউ খাইয়ে দিত— নারকেল নাড়ু , পরোটার টুকরো, সিঙাড়ার ভগ্নাংশ আরও কত কি!

একদিনের ডিসেকশন ক্লাস— আটটা টেবিলে মানুষের দেহ শোয়ানো আছে। কোনটা আস্ত, কোনটা খণ্ডিত। আজ ব্যবচ্ছেদ করার কথা স্বপন আর আমার। দুপুরের বিরতির পর ক্লাস। দু’জনেই সাদা অ্যাপ্রন পরে তৈরি। আমাদের টেবিলে এক মহিলার নিথর দেহ। হঠাৎ কেন যেন আনমনা হয়ে গেলাম।
—স্বপন, আজ ডিসেকশন করব না রে। সুধাংশু, তুই কর না।
— কেন পার্টনার কি হল? শরীর খারাপ লাগছে?
— ইচ্ছে করছে না রে আজ।
সেদিন আর মন বসল না পড়াশুনায়। অন্যমনস্কতায় নার্ভ, মাসল, আর্টারি কিছুই চেনা হল না। কলেজ সেরে হেঁটে হেঁটে দত্তবাগানের হোস্টেলে ফেরার সময় সঞ্জয় বলল, ” আজ হঠাৎ কি হল রে? ডিসেকশন করলি না ?
-মহিলাকে লক্ষ্য করছিলি? আমি বললাম। কি এমন ছিল দেখার মতন ?
-আমি বারবার ডান হাতটা দেখছিলাম।
-হাত! কই, আমার তো কিছু মনে হয় নি।
-হাতের বিবর্ণ অ্যালুমিনিয়ামের চুড়ি গাছা, শাখা ,পলা — ওগুলো আমার খুব চেনা চেনা লাগছিল রে।

1 COMMENT

  1. অসাধারণ লাগল লেখাটা ফিরে গেলাম 50 বছর
    আগের দিনের কিছুটা সময়
    Thanks to অসীম
    মনোজ দা

Comments are closed.