(বহু পুরস্কারে সম্মানিত, বিশিষ্ট চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ অসীম শীল চোখ দেখতে গিয়ে মানবজীবনের গভীরে ঢুকে পড়েন। কলকাতার একটি সংশোধনাগারে চিকিৎসা করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছেন তিনি। )

সকালের নির্ধারিত সময়েই লৌহ কপাটের সামনে পৌঁছে গেলাম। এই অতি উচ্চ পাঁচিলটার পাশ দিয়ে অসংখ্যবার যাতায়াত করেছি। কিন্তু প্রাচীরের অন্য দিকটা দেখবার কোনও সুযোগ হয়নি। এবার এক সামাজিক কাজের সূত্র ধরে মহানগরের এক সংশোধনাগারে প্রবেশ ঘটল। আইন মানতে যা কিছু করণীয় সবই সম্পন্ন করতে হল, ভারী দরজাটা একজন ঠেলে দিতেই ভিতরে ঢুকে কয়েক পা হেঁটে জেলর সাহেবের অফিসে গিয়ে বসলাম।
উপস্থিত সবার সাথে সৌজন্য বিনিময় হতে হতেই চায়ের কাপ হাতে পৌঁছে গেল। জেলর সাহেব জানতে চাইলেন, সংশোধনাগারের অধিবাসীদের চোখ পরীক্ষার আয়োজনটা কেমন করে করা হবে। এসেছি ছয়জনের একটা দল— তাতে ডাক্তার দু’জন, শুভ্রা ও আমি। বললাম, “আমাদের হলটা দেখিয়ে দিন। আমরাই ব্যবস্থা করে নেব।” চা শেষ করে ছেলেদের দল ভিতরে চলে গেল যন্ত্রপাতি সাজাতে, আমরা দু’জনে আরও কিছুক্ষণ বসে রইলাম। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে সন্ন্যাসী মহারাজ পৌঁছে গেলেন আমাদের উৎসাহ দেবার জন্য। উনি এখানে নিয়মিত আসেন। তাই সবার সাথে খুব সহজ পরিচিতি আছে দেখলাম। পরিচয় করিয়ে দিলেন এক মেধাবী ছাত্রের সাথে— এবছর সে এম.এ পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। মহারাজ ওর পড়াশুনায় সাহায্য করেছিলেন। অনেকেই এসে তাঁর কাছে মনের কথা বলে গেলেন।
সংশোধনাগারের ভিতরে দোতলায় একটা ছোট অডিটোরিয়াম, সেখানেই এক দিকে চশমা পরীক্ষা আর মঞ্চের উপর চোখ দেখার আয়োজন হল। হলের দেওয়াল ধরে দুই পাশেই লম্বা সারি নানান বয়সের পুরুষ মানুষের। চক্ষু পরীক্ষা শিবির উদ্বোধনের পর অফিসাররা প্রায় সবাই যে যার কাজে চলে গেলেন। হলটা এখন আমাদের হাতে, দু’জন সর্দার গোছের যুবক আমাদের মূল সাহায্যকারী। আমার সাথে যাকে দেওয়া হল তার নাম খোকন- বয়স তেত্রিশ-চৌত্রিশ হবে। পরনে লুঙ্গি আর একটা সাদা জামা। বেশ গুছিয়ে কাজ করার ক্ষমতা আছে ছেলেটার , কোনও কিছু এলোমেলো হতে দিচ্ছে না।
-স্যার, প্রথমেই একটা সময়ের হিসাব আপনাকে বলে দিই। বারোটায় সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে, লাঞ্চে যাবে। এরপর আবার দেড়টায় দেখা যাবে। সাড়ে তিনটেয় আবার ছাড়তে হবে, তখন রোল কলের সময়। এর মধ্যেই আপনাদের সবার চোখ দেখে নিতে হবে।
-ঠিক আছে ভাই, আপনি এক এক করে সবাইকে ডেকে এই চেয়ারে বসান।
কত বিচিত্র মানুষ— যুবক ও মাঝবয়সির সংখ্যা বেশি হলেও কয়েকজন বৃদ্ধ ও সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ তরুণও রয়েছে এদের মধ্যে। খোকন প্রত্যেককেই নাম ধরে ডাকছে। কারও সাথে মশকরা করছে। কার চোখের সমস্যা ও-ই আগে বলে দিচ্ছে। এতো দেখছি সবার অভিভাবক।

গৌরনদী

-খোকন, তুমি সবার অসুবিধা জানো কী করে? লোক তো নেহাত কম নয়।
-ও স্যার, এত দিন থাকতি থাকতি সব জেনি ফেলিছি। কোনডার কখন কি রোগ বাধে, সেই আমারেই তো হাসপাতালে নে যেতি হয়। সব চিনি, মুখ চোখ দেখলি বলতি পারি কে আন্ডার ট্রায়াল , কে কনভিকটেড।
বিভিন্ন গ্রাম, শহরে মানুষের মেলায় অসংখ্যবার মিশে গেছি চোখ দেখার অছিলায়, এবারেও ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছি। কিন্তু কোথায় যেন সাবলীলতায় আটকাচ্ছে। সব প্রশ্ন এখানে করা যায় না। কারাপ্রাচীরের ভিতরে দুই হাতে হিরে -পান্না-চুনির আংটি পরা মানুষ বা অভিজাত পরিবারের যুবক কী ভাবে এল— সে ঔৎসুক্য নিবারণ করাই ভাল, স্থান-কাল-পাত্র এখানে একেবারে ভিন্ন। তবুও কখনো কখনো মুখ ফস্কে স্বতঃস্ফূর্ত প্রশ্ন বেরিয়ে আসে। একটা ফুটফুটে ছেলেকে দেখে শুভ্রা প্রশ্ন করে ফেলে, “তুই এখানে?” অবলীলায় উত্তর দেয়— ” আমার বাবার বিজনেস পার্টনার বাবাকে মারছিল, আমার পাল্টা মারে সে মারা গেছে।” ওর সমবয়সি আর একজন , “প্রেমিকা বেইমানি করেছিল …।”
কয়েকজন আবার রাজবন্দি, তাদের কথাবার্তার ধরনই আলাদা। কিছু আছে সমুদ্রে ধরা পড়া জেলে, ভিনদেশি— তাদের ছাড়াবার কেউ নেই। পরপর চোখ দেখা চলতে থাকে , মাঝে মাঝে চা জুটে যায়। মনে কৌতূহল বাড়তে থাকে খোকনের পরিচয় নিয়ে। পোশাক দেখে বোঝা যায় ও সংশোধনাগারের কর্মী নয়, ইউনিফর্মে না থাকলেও কর্মচারী হলে অন্তত লুঙ্গির বদলে প্যান্ট পরা থাকত। কাজকর্ম, চালচলন কিন্তু অভিজ্ঞ অফিসারের মতনই। লাঞ্চের বিরতি ঘোষিত হল— “আপনারা খেয়ে নেন ,আবার দেড়টায় দেখা হবে।” খোকন বলে চলে গেল।
সংশোধনাগারের কর্মীরাই আমাদের খাবারের প্যাকেট সাজিয়ে দিলেন। খেতে খেতে এখানকার মানুষদের সম্পর্কেই কথা হতে থাকল। নিজেদেরই ঘরের কাকা-মামা-ভাই-ভাইপোদের অন্য পরিবেশে দেখা। সকালেই সন্ন্যাসী মহারাজ বলেছিলেন, “এদের প্রায় সবাই ভাল মনের মানুষ, কোন বিশেষ পরিস্থিতি জীবনে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিয়েছে।” খোকনের পরিচয় নিয়ে আমার কৌতূহল প্রথম থেকেই ছিল, তাই একজন সরকারি কর্মীকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম ওর বিষয়ে।খোকন বহুদিন আছে ,দশ বছরের বেশি হবে। বুদ্ধি আছে, অলস নয় তাই অফিসাররা অনেক কাজে ওকে লাগায়।
-তা কয়েক ঘণ্টাতেই বুঝতে পেরেছি।
-না ছেলেটা ভাল। লোকের উপকার করে।
দেড়টার পর আবার কাজ শুরু হল, চলল বিকেল পর্যন্ত। এবার ফেরার পালা। আমাদের একটা ইচ্ছা ছিল, স্বাধীনতা আন্দোলনের বিখ্যাত নেতারা যেখানে কারারুদ্ধ ছিলেন, সেগুলি একবার দর্শন করার। খোকনই আমাদের সবাইকে সেই সব স্মৃতিকক্ষ দেখাতে নিয়ে গেল। সবার শেষে দেখাল আমগাছের নীচে ফাঁসির মঞ্চ। এখানে নীরব হয়ে একটু দাঁড়াতেই হয়। কিছু বীর বিপ্লবীর নাম তো মনকে ছুঁয়ে যাবেই।
-খোকন ভাই ,আমাদের কাছে কিছু চকোলেট আছে সবার জন্য। প্যাকেটটা কাকে দেব ? শুভ্রা ওর কাছে রাখা চকলেটগুলো বের করলো।
সমবেত ছেলের দল বলে ওঠে , “ম্যাডাম , ম্যাডাম। “
খোকন বলে, “দিদিই সবার হাতে দিয়ে দিন। বোনের হাত থেকে কিছু নিতে ভাইদের সবসময়েই ভাল লাগে।’’
জেলর সাহেব খবর পাঠালেন আমার যেন ওনার অফিসে এক কাপ চা খেয়ে তবে যাই। একটু সময় পেয়ে খোকনের সাথে গল্প শুরু করলাম। এতক্ষণে কিছুটা বন্ধুত্ব তো হয়েই গেছে। ব্যক্তিগত প্রশ্ন করাই যেতে পারে।

খোকন তোমার বাড়ি কোথায় ?
-যেখানে আমারে দেখতিছেন সেখানেই।
-তাই হয় না কি ? আপত্তি না থাকলে বললে খুশি হব।
-বরিশাল।
-ও তুমি বাংলাদেশের। আমাদেরও পূর্বপুরুষের দেশ বরিশাল। কিন্তু তোমার কথা যে একেবারে চব্বিশ পরগনার সীমান্ত অঞ্চলের। কেউ তোমার কথায় বরিশালের টান পাবে না।
-কত বছর হয়ে গেল। যাদের সাথে সারাদিন সারারাত কাটাই তাদের মতই ভাষা হয়ে গেছে।
-বরিশালের কোথায় ?
-গৌরনদী।
-ওই বরিশাল থেকে ভাঙ্গা হয়ে ঢাকা আসার রাস্তার পড়ে? কয়েকবার স্টিমারে পদ্মা পার হবার জন্য ওই রাস্তা দিয়ে এসেছি। বাটাজোর, মাহিলারা এইসব জায়গা পড়ে না ওই রাস্তায় ? গৈলাও তো গৌরনদীর কাছাকাছি, তাই না?
খোকন নির্বিকার। কোনও উচ্ছ্বাস নেই। ওর জন্মভূমিকে দেখেছে বিদেশে এরকম কাউকে কাছে পেয়েও মনের বহিঃপ্রকাশ কিছুই নেই।
ওর ভাবলেশহীন নীরব মুখটাকে দেখলে মনে হয় গলায় যেন কিছু আটকে আছে। কথা আছে, আবেগ আছে— বেরোতে পারছে না, আত্মগ্লানি আর দুঃখ তাদের চেপে রেখেছে।
-দেশের কথা মনে করে কী হবে, ডাক্তারবাবু ? এদেশে বেড়াতে এসেছিলাম, সোনারপুরে চায়ের দোকানে আড্ডা মারতে মারতে একটা ছেলে আমার মায়ের নামে বিশ্রী গালাগালি করে, রাগের চোটে তার কানের গোড়ায় এমন থাপ্পড় মেরেছিলাম যে ছেলেটা মারা যায়। তারপর এখানেই এত বছর কেটে গেল। সেই মা-ই তো মাটিতে চলে গেছে ,আর কার কাছে যাব?
-যখন পাঁচিলের বাইরে যাবে তখন দেশে ফেরত যেও।
-যে ভাগ্না-ভাগ্নীগুলোকে ঘাড়ে চড়িয়ে ঘুরেছি, নাকের শিকনি পরিষ্কার করেছি— তারা কি আর চিনতে পারবে ? চিনলেও ঘেন্না করতে পারে। ভারী হয়ে আসে খোকনের কন্ঠস্বর।
ছেলেটা কষ্ট পাচ্ছে, একটু প্রসঙ্গটা ঘোরানোর চেষ্টা করলাম।
-তোমাদের গৌরনদীর মিষ্টি খুব ভাল না ? বরিশাল শহরে তো কতগুলো দোকান আছে গৌরনদী মিষ্টান্ন ভান্ডার বলে।
-খেয়েছেন গৌরনদীর মিষ্টি ?

নিশ্চয়। আমার চেহারাটার দিকে দেখ। দেখে বোঝা যায় না আমি খেতে ভালোবাসি কি না? না খেয়ে কি আর ছেড়েছি ? আমার বন্ধু নজরুল অন্তত দু’টো দোকানে খাইয়েছে।
-তাইলে বলেন তো ,গৌরনদীর কোন মিষ্টি সবচেয়ে বিখ্যাত ? খোকন হেসে ফেলে।
-দই ,তাই না ?
-ঠিক বলেছেন। যত বাস ওই রাস্তা দিয়ে যায় গৌরনদীতে বেশি সময় দাঁড়ায় যাতে লোকে মিষ্টি কিনতে পারে। এখন রাস্তাঘাট কেমন হয়েছে কে জানে ?
-এখন খুব সুন্দর রাস্তা। পদ্মা নদীর উপর ব্রিজ তৈরি হচ্ছে, বরিশাল -ঢাকা যাতায়াতের সময় কত কমে যাবে।
-তাই না? সব বদলে যায়, আমার ও তো কত বদল হয়ে গেল।
-সব বদলালেও তোমার গৌরনদী তো থাকবেই।
-ছলছল চোখে খোকন আমার হাতটা চেপে ধরে বলে, কতদিন পর চেনা নাম শোনালেন—”গৌর…নদী’’, দীর্ঘশ্বাস ভরা দীর্ঘ উচ্চারণ।
গৌরের প্রেমের নদী ফল্গুধারার মতো বয়ে চলে জন্মভূমির গভীরে।