[দশম পর্ব]

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

স্বামী বনিতার পতি,

স্বামী বনিতার গতি,

স্বামী বনিতার বিধাতা।

—কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী

পতি শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হল রক্ষক বা পালক। পতি শব্দের স্বাভাবিক স্ত্রীলিঙ্গ হল পত্নী। কিন্তু পত্নী শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হল, যিনি যজ্ঞ কর্মে অংশগ্রহণ করেন। আমরা প্রমাণ পেয়েছি বৈদিক যুগে নারীরা যজ্ঞ করতেন। সেই অধিকার হরণ করলেন ‘মনু’। স্মৃতিশাস্ত্রের প্রামাণ্য গ্রন্থ মনুসংহিতায় বলা হল, “নারীর পৃথক ভাবে করণীয়, কোন যাগযজ্ঞ ব্রত উপবাসাদি কিছুই নাই; একমাত্র পতি সেবাই তার পরমধর্ম এবং পতি ভিন্ন তার কোন সত্ত্বাই নেই।”

অবশ্য বৈদিক যুগের শেষ দিকে এর চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। অথর্ব বেদে বলা আছে, “কুমারী কন্যা ব্রহ্মচর্য অথবা বেদ অধ্যয়নের দ্বারাই তরুণ যুবা পতি লাভ করে থাকে।” এ যেন আজকের যুগের প্রতিচ্ছবি। অনেক অভিভাবক শুধুমাত্র মেয়েদের মাধ্যমিক পাস করায়, ‘কন্যাটিকে সুপাত্রস্থ করার জন্য’। মেয়েকে গান শেখায় ছেলেদের বাড়ি থেকে দেখতে আসলে যাতে হারমোনিয়াম নিয়ে বসতে পারে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সূচী শিল্প ও রন্ধন পটিয়সীতার পরীক্ষা নেওয়া হতো। তবে এই দু’টি জিনিস ‘গৃহকর্মে’ প্রয়োজনীয় ছিল। আজও ‘পাত্র চাই পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনে চাহিদা আছে ‘প্রকৃত সুন্দরী’, গৃহকর্মে ‘নিপুনা’ কন্যার।

মনু শুধু নারীদের যজ্ঞে অধিকার হরণের কথা বলেননি, কিছু অধিকারের কথাও বলেছেন। যেমন, কন্যার পছন্দ মতো পাত্র নির্বাচন করা। ঋতুমতী কন্যাকে তিন বছরের মধ্যে বাবা মা যদি বিবাহ না দেয়, তাহলে ঐ কন্যা নিজের পছন্দ মতো স্বামী মনোনয়ন করতে পারবেন। কিন্তু কোনও পিতা-মাতা এতদিন অপেক্ষা করতেন না পাপী হবার ভয়ে, বরং ৮ বছরের নীচের কন্যা বিয়ে দিয়ে গৌরীদানের পূণ্য অর্জন করতেন।

বিবাহের বয়সের ক্ষেত্রে মনুসংহিতায় এক বিশাল বৈষম্যের কথা আছে। বলা আছে, তিরিশ বছরের যুবক মনোমতো বারো বছরের কন্যাকে বিবাহ করবে। চব্বিশ বছরের যুবক পছন্দ মতো আট বছরের কন্যাকে বিবাহ করবে। ব্রহ্মচারীর বেদ গ্রহণ যদি চব্বিশ বছরের আগে শেষ হয়ে যায়, তাহলে আগে বিবাহ করতে পারবে। টীকাকার কুল্লুকের মতে, কনের বয়স অপেক্ষা বরের বয়স তিনগুণ বেশি হবে, এই মাত্রা জ্ঞাপন করাই এই বয়স উল্লেখ করার তাৎপর্য। কন্যার বয়ঃক্রম নির্ধারণ করা এই বচনের উদ্দেশ্য নয়। একটা ব্যাপার এখানে তাৎপর্যপূর্ণ— তা হল, শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, বিদ্যা শিক্ষা শেষ না করে বিবাহ করতে পারবে না। সমাজতত্ত্ববিদেরা বলেন, বিবাহের ক্ষেত্রে মেয়ের বয়স ছেলের বয়সের থেকে কম হলে ভাল। শারীরবৃত্তীয় কারণে মেয়েদের বয়স ছেলেদের থেকে পাঁচ বছর কম হওয়া ভাল। 

অতীত ভারতে স্ত্রীর সামাজিক নিরাপত্তাও ভাল ছিল। একমাত্র ‘অসতীত্ব’ ভিন্ন অপর কোনও কারণে স্বামী, স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে পারতো না। স্ত্রীর অন্যকিছু অপরাধে স্বামীর সহবাসে বঞ্চিত হতেন বটে, কিন্তু গ্রাসাচ্ছদনে বঞ্চিত হতেন না। ব্যভিচারী পত্নীর ভরণপোষণের কোনও ব্যবস্থা শাস্ত্রে ছিল না। মনুর মতে, ছটি হল ব্যভিচার দোষ— মদ্যপান, কু-লোকের সংসর্গ, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ, যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো, অসময়ে নিদ্রা এবং আত্মীয়দের বাড়িতে দীর্ঘদিন থাকা।

বৈদিক সাহিত্যের প্রমাণ থেকে ধরে নেওয়া যায়, বৈদিক যুগে সংসারে এবং সমাজে পতি-পত্নীর সমান অধিকার ছিল। স্মৃতিশাস্ত্রের যুগ থেকে বৈষম্য দেখা দিল। স্বামীকে উচ্চস্থানে দেখানো শুরু হল। চাণক্য লিখলেন, ‘নারীণাং ভূষণং পতিঃ’। লক্ষীকে দেখা গেল নারায়ণের পদসেবা করতে। গুপ্তযুগের ভাস্কর্যেই প্রথম দেখা গিয়েছিল লক্ষী-বিষ্ণুর পদসেবার মূর্তি। সব মিলিয়ে নারী ভাবতে শুরু করল তাদের স্থান পুরুষদের নীচে।

পতি পরমেশ্বর, পতির পূণ্যে সতীর পূণ্য, স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর স্বর্গ— এসব প্রচার তো ছিলই, তারপর এল পতির পদবির ব্যবহার। পদবির ব্যবহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে পুরুষের অধস্তন হিসাবে প্রমাণ করা, বৈবাহিক অবস্থা প্রমাণ, সামাজিক পরিচিতি সহজবোধ্য করা। প্রাচীন বাংলায় কুমারী মেয়েরা নামের শেষে পিতৃকুলের পদবির সঙ্গে দুহিতা কথাটি যোগ করা হতো। যেমন কমলা মিত্র দুহিতা। বিবাহের পর শ্বশুরবাড়ির পদবীর সঙ্গে ‘জায়া’ কথাটি যোগ করা হতো। যেমন, কমলা ঘোষ জায়া। পরে যৌন শৃঙ্খলার প্রশ্নে স্বামী সর্বস্ব করে তোলার জন্য শুধু স্বামীর পদবি ব্যবহার করলেই চলতো। ঐতিহাসিকেরা বলেন রাজা বল্লালসেন বর্ণগোত্র অনুসারে বাঙালি হিন্দুদের পদবির ব্যবহার প্রচলন করেন।

 পুরুষের বহুবিবাহ, কুলীনদের অসংখ্য বিবাহ, রাজ-রাজরাদের শতাধিক বিবাহ, নারীর মনে বদ্ধমূল ধারণা হল, বিবাহ ছাড়া তার আর কোনও গতি নেই। অতীত ভারতে মেয়েরা বিবাহ না করে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারতো; তা তারা জানতেও পারলো না শিক্ষার অভাবে। অতএব নারী যদি স্বামী দ্বারা পরিত্যক্ত হয়, তাহলে তার স্থান একমাত্র যৌনপল্লীর নরক। এই ধারণা যুগে যুগে নারীর দেহব্যবসাকে সমৃদ্ধ করেছে অর্থাৎ নারী পাচার হয়েছে।

এই বিবাহ ব্যবস্থাপনা, স্বামী সর্বস্বতা যুগে যুগে নারী পাচারের জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে।

তথ্যসূত্র:

১. বঙ্গীয় শব্দকোষ – হরিচরণ বন্দ্যেপাধ্যায়

২. মনুসংহিতা- সম্পাদনা ও ভাষান্তর- চৈতালী দত্ত নবপত্র প্রকাশন।

৩. প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য

৪. বাঙালি নারী, হাজার বছরের ইতিহাস – মাহমুদ শামসুল হক, হাতেখড়ি (বাংলাদেশ)