(প্রেসিডেন্সির অধ্যাপক ওটেন সাহেবের নিগ্রহের ঘটনায় সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ওই কলেজেরই ছাত্র অনঙ্গমোহন দাম। বিভিন্ন তথ্য ও বয়ানে স্পষ্ট— নেতাজি নন, অধ্যাপক নিগ্রহে মূল ভূমিকা ছিল অনঙ্গমোহনেরই। ওই ঘটনার জেরে আত্মগোপন, চার বছরের জেল। তারপর বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অনঙ্গমোহন। এই উপেক্ষিত বিপ্লবীর কর্মজীবনের বিভিন্ন দিকের কথা তুলে ধরেছেন সাংবাদিক সুকুমার মিত্র।)
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন মঞ্চে। বক্তব্য রাখছেন প্রেসিডেন্সির ছাত্র বিপ্লবী অনঙ্গমোহন দাম। শুধু বক্তব্যই নয় ওই অনুষ্ঠানে অনঙ্গমোহনের লেখা গান সমবেত গীত হিসেবে পরিবেশন করেছিলেন কলেজের ছাত্ররা। তারিখটা ছিল ১০ ডিসেম্বর, ১৯১৫। প্রেসিডেন্সি কলেজে সেদিন স্যর জগদীশচন্দ্র বসুকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল তাঁর সফল ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপান সফরের জন্য ।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। অনঙ্গমোহন ১৫ বছরের কিশোর। তিনি সিলেট শহরের গিরিশচন্দ্র হাই স্কুলে পড়তেন। ছাত্রবস্থায় বিপিনচন্দ্র পালের ভাষণ শুনে কিশোর অনঙ্গমোহন স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। স্বদেশীদের স্বেচ্ছাসেবকের তালিকায় নাম লেখান। তখন তিনি অন্যদের সাথে স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারের প্রচার করতেন আর বিদেশী দ্রব্য বর্জন করতে মানুষকে উৎসাহিত করতেন। কিশোর বয়স থেকে পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার তাড়না তাঁকে ক্রমশ বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করে।
স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত থাকলেও অনঙ্গমোহন এতটাই মেধাবী ছাত্র ছিলেন যে, ১৯০৯ সালে তিনি স্কলারশিপ পেয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। তখন বিপিনচন্দ্র পাল প্রায়ই বলতেন, ‘শিক্ষা অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতা পারে না’। তাঁর সেই ডাকে বহু মেধাবী ছাত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে এগিয়ে এসেছিলেন।
প্রেসিডেন্সি কলেজে অনঙ্গমোহনের সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ড. জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, ড. জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জী, ড. পুলিনবিহারী সরকার। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তিনি ইডেন হিন্দু হষ্টেলের আবাসিক ছিলেন। সেখানে তিনি ফেব্রুয়ারি ১৯১৬ পর্যন্ত ছিলেন।
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নের সময় অনঙ্গমোহন গোপন বিপ্লবী সংস্থা যুগান্তর দলের সংস্পর্শে আসেন। সেই অগ্নিঝরা দিনগুলিতে বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবীরা বিদেশ থেকে গোপনে অস্ত্র আনাচ্ছিলেন। অনঙ্গমোহন দাম এক চিঠিতে লিখেছেন যে, কিছু অস্ত্র পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়। জোর পুলিশি ধরপাকড় শুরু হয়। এসময় তাঁকেও পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হয়। কিন্তু সেই অস্থির অবস্থার মধ্যেও তাঁরা নতুন সদস্যদের দলভুক্ত করার কাজ জারি রাখেন। তাঁর ‘সুভাষ-স্মৃতি’ লেখায় তিনি জানিয়েছেন, “হিন্দু হস্টেলের আধিবাসী ছাত্রদের স্বদেশপ্রেমের দিকে আকৃষ্ট করিয়া তাদের দেশ স্বাধীন ও ইংরাজ বিতাড়নের কাজে উৎসাহিত করার চেষ্টা আমরা করিতাম।” ইতিমধ্যে তিনি ১৯১৩ সালে দর্শনে অনার্স নিয়ে বি-এ পরীক্ষা পাস করেন। এম-এ পড়তে শুরু করেন। ১৯১৬ সালে অনঙ্গমোহন প্রেসিডেন্সিতে ষষ্ঠ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন অধ্যাপক ওটেনকে মারার জন্য সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে বহিষ্কৃত হন। ওই ঘটনার পরে অধ্যক্ষের অজান্তেই কলেজে ও হিন্দু হোস্টেল বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার।
প্রেসিডেন্সি ও হিন্দু হোস্টেল যে ব্রিটিশ পুলিশের সন্দেহের তালিকায় সব সময় থাকতো তা খোদ নেতাজির লেখায় স্পষ্ট- “In the councils of the C.I.D, the Presidency College students had a bad name— so ran the rumour. 1.The main hostel of the College, known as the Eden Hindu Hostel, was looked upon as a hot-bed of sedition, a rendezvous of revolutionaries, and was frequently searched by the police”. (Ref. Page-73, AN INDIAN PILGRIM, OR AUTOBIOGRAPHY OF SUBHAS CHANDRA BOSE) এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন শাহ নওয়াজ খান, সারদুল সিং, লক্ষীস সায়গল, মেহবুব আহমেদ, ধনরাজ শর্মা, বীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বেলা মিত্র, কল্যাণকুমার বসু।
অনঙ্গমোহন দাম ও নেতাজির প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিস্কারের ঘটনা ১০ এপ্রিল, ২০১০ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, “On February 16, 1916, two students — Ananga Mohan Dam and Subhas Chandra Bose— were expelled from the college on charges of assaulting a teacher, E F Oaten”.
তবে, ইতিহাস গবেষক মৃগাঙ্ক মুখোপাধ্যায় একাডেমিয়া এডুতে তাঁর নিবন্ধ ‘ মেকিং অফ দ্য পলিটিক্যাল কনসাসনেস উইদিন দ্য স্টুডেন্ট কমিউনিটি অফ বেঙ্গল’ –এ হিন্দু হস্টেলে পুলিশি অভিযানে এক ছাত্রের উদ্ধার হওয়া ডায়েরির কথা উল্লেখ করেছেন। যেখানে ওটেন লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে কেবল মাত্র অনঙ্গমোহন দামের উল্লেখ পাওয়া যায়। ওই নিবন্ধে তিনি লিখেছেন,“A lot of items were seized from the rooms of the boarders in the name of raid. Most of these articles were apolitical in nature except a diary of A. Sur found from Manindra Majumdar’s room which provided evidences from the political unrest of 1916. It reports the Oaten /incident in some detail and mentions the name of Ananga Mohan Dam, one of the two boys expelled from the College as the consequence of this incident. But interestingly, the diary does not mention the name of Subhas Bose!”
এদিকে পড়াশোনা, বিপ্লবী আন্দোলনের পাশাপাশি অনঙ্গমোহন সাথী বিপ্লবীদের নিয়ে আর্ত, দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়াতেন। ১৯১৪ সালে বর্ধমান জেলায় ভয়ানক ভাবে বন্যা কবলিত হয়ে পড়লে তিনি আরও কিছু বন্ধুর সাথে বর্ধমানে গিয়ে ত্রাণ কার্যে লিপ্ত হয়েছিলেন। পরের বছর ১৯১৫ সালে বাঁকুড়া জেলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তাঁর ডাকে ও নেতৃত্বে হস্টেলের চতুর্থ ওয়ার্ডের ছাত্ররা সেবছর তাঁদের বাৎসরিক অনুষ্ঠান বাতিল করে দিয়ে বাঁকুড়া ত্রাণ তহবিলে পুরো টাকাটা তুলে দেন।
ওটেনকে মারার পর প্রেসিডেন্সি থেকে বহিষ্কার এবং সেই বছর অর্থাৎ ১৯১৬ সালের জুলাইয়ে কলকাতায় তাঁর বইয়ের দোকান থেকেই গ্রেপ্তার হন অনঙ্গমোহন। ছাত্রাবস্থায় বিপ্লবী আন্দোলনের পাশাপাশি স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ১৯১৪ সালে তিনি একটা বইয়ের দোকানও খুলেছিলেন ১নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের (বর্তমানের বিধান সরণীর) কর্নওয়ালিস বিল্ডিং-এ। অনঙ্গমোহনের ধারণা ছিল, এই বইয়ের দোকানের আয় থেকে তাঁর আইন পড়াশুনা, ইত্যাদির খরচ উঠে আসবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর মুক্তি পেয়েই সেপ্টেম্বর, ১৯২০ কলকাতায় লালা লাজপত রায়ের পৌরহিত্যে কংগ্রেসের যে বিশেষ অধিবেশন হয়েছিল তাতে অনঙ্গমোহন সিলেট জেলা থেকে কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সেই অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব পাস হয়। ইংল্যান্ডের যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলস্-এর ভারত সফরের জন্য কলকাতায় হরতাল ও বয়কট সফল হয়েছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রামে শ্রীহট্ট মহিলা সংঘ গঠিত হওয়ার এক দশক আগেই গান্ধীজির ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে স্বতস্ফুর্ত ভাবে সিলেটের মহিলারা সামিল হয়েছিলেন। ১১ মার্চ, ১৯২১ দেশবন্ধু সিলেট পৌঁছে অসহযোগ ও খেলাফত নেতাদের নিয়ে একাধিক সভা করেন। তাঁর সাথে ছিলেন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী, হেমন্তকুমার সরকার ও সত্যেন্দ্রনাথ মিশ্র। সেদিন সন্ধ্যায় দেশবন্ধু ও বাসন্তী দেবী শহরের নারী মহলকে নিয়ে বিশ্বম্ভর জিউর আখড়ায় সমাবেশ করেন। শহরের মহিলারা স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে পরিহিত সোনার গহনা, নগদ টাকা বাসন্তী দেবীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তখন অনেক পরিবারে মাটির কলস/ভাণ্ডার দেওয়া হয়েছিল। যাতে প্রতিবার রান্নার আগে একমুষ্টি করে চাল তাঁরা ‘দেশমাতাকে দান’ করেন। সেই চাল বিক্রি হয়ে ‘স্বদেশী ভাণ্ডারে’ যাবে। বাসন্তী দেবী সিলেটের মহিলাদের দানকৃত জিনিস-পত্র নিলামে বিক্রি করে তার নগদ অর্থ গান্ধজির হাতে তুলে দেন। সেগুলো পরে ‘স্বরাজ ভাণ্ডারে’ জমা হয়েছিল। ১২ মার্চ, ১৯২১ টাউন হলে দেশবন্ধুকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তিনি জনসভায় অসহযোগের তাৎপর্য তুলে ধরে দেশকে সেবাকাজে যোগদানের আহ্বান জানান। তিনি সিলেটের কয়েকটি জাতীয় বিদ্যালয় পরিদর্শন করে সেগুলো উন্নয়নের জন্য দুই হাজার টাকা দান করেন। এর কিছু দিন পরেই দেশবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে গেলে আসাম-সহ গোটা পূর্বভারতে তাঁর নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হয় বিপ্লবী অনঙ্গমোহন দামকেই। শুধু দেশবন্ধু নন সুভাষচন্দ্র, কিরণশঙ্কর রায়রা গ্রেপ্তার হয়ে যান। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্ব পালন করতে হয় অনঙ্গমোহন দামকেই। তিনি সে কাজ খুব দক্ষতার সাথে করতে পেরেছিলেন। সেই কারণে গান্ধীজিও তাঁকে প্রশংসা বার্তা পাঠিয়েছিলেন। দিল্লিতে গান্ধীজির সঙ্গে অনঙ্গমোহন দেখা করলে তিনি তাঁকে গ্রামে গিয়ে কংগ্রেসের কাজ করতে নির্দেশে দেন। সেই নির্দেশ পেয়ে তিনি ফিরে এসে গ্রামে শিক্ষাবিস্তার, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য-প্রতিষ্ঠার কাজে ব্রতী হন।
১৯৪২ সালে ভারত-ছাড়ো আন্দোলনে দেশ উত্তাল। অনঙ্গমোহন দামকে সে সময় সুরমা উপত্যকা এবং পার্বত্য জেলাগুলি থেকে কেন্দ্রীয় আইন সভায় নির্বাচিত করা হয়েছিল এবং তিনি দিল্লিতে যান। তিনি তখন কংগ্রেসের মতবাদ প্রচার করেছিলেন। তাছাড়া, আসামের উন্নতির জন্য তৎকালীন মন্ত্রী গোপালস্বামী আয়েঙ্গারের নেতৃত্বে বহু কাজ করেছিলেন।
অনঙ্গমোহন দাম তাঁর সিলেটের সাধুহাটি গ্রামের বাড়িতে শেষবারের মত ফিরে গিয়েছিলেন ১৪ অগস্ট, ১৯৪৭-এর দু-তিনদিন আগে। কিন্তু তাঁকে কয়েকজন সতর্ক করে দেন যে, তিনি যেন সিলেট ছেড়ে চলে যান। নতুবা পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করবে। তিনি ১৪ অগস্ট, ১৯৪৭ বা তার একদিন আগেই একা গোপনে শিলং-এ চলে যান। সেখান থেকে কলকাতা চলে আসেন। কলকাতায় প্রথমে ওঠেন তাঁর ছোট সহোদরের লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়িতে। তারপর পার্কসার্কাস এলাকার ঝাউতলা রোডের ভাড়া ফ্ল্যাট বাড়িতে। সেখানে ৪-৫ বছর থেকে তাঁরা উত্তর ২৪ পরগণার উদ্বাস্তুনগরী অশোকনগরে চলে আসেন ১৯৫৪ সালে। পরে অনঙ্গমোহন দামের জ্যেষ্ঠপুত্র আশিস দাম কাশীপুর গান এ্যান্ড সেল-এ চাকরি পেলে ১৯৬৫ সালের মে মাসে সোদপুরের হাউজিং এস্টেটে ফ্ল্যাট কিনে মা, বাবা, ভাই বোনদের সেখানে নিয়ে আসেন।
জানা যায়, অনঙ্গমোহন দাম রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সাক্ষাৎ শিষ্য স্বামী সারদানন্দের (শরৎ মহারাজের) কাছ থেকে মন্ত্রদীক্ষা নিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ১১তম অধ্যক্ষ স্বামী গম্ভীরানন্দ ছিলেন অনঙ্গমোহন দামের পিসতুতো ভাই। স্বামী গম্ভীরানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম ছিল যতীন্দ্রনাথ দত্ত। স্বামী গম্ভীরানন্দের জন্ম বর্তমানের বাংলাদেশের শ্রীহট্টের সাধুহাটিতে। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময় তাঁর সমসাময়িক ছিলেন সজনীকান্ত দাস ও গোপাল হালদার। ১৯২৩ সালে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ সংঘে যোগ দেন। তার শিক্ষা, ব্রহ্মচর্য ও সন্ন্যাস সবই মহারাজ স্বামী শিবানন্দের কাছে। ১৯২৯-৩১ সাল পর্যন্ত তাঁকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে “উদ্বোধন” পত্রিকায় পাঠানো হয়। ১৯৩৫ সালে পর্যন্ত তিনি প্রধানত দেওঘর বিদ্যাপীঠে ছিলেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন অদ্বৈত আশ্রমের অধ্যক্ষ। ইংরাজি মাসিক পত্রিকা ‘প্রবুদ্ধ ভারত’- এর সম্পাদক হিসাবেও কাজ করেছেন। পরে ১৯৬৬ সালে তিনি মঠ ও মিশনের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৭৯ সালে সহকারী অধ্যক্ষ ও এপ্রিল, ১৯৮৫ সালে অধ্যক্ষপদের দায়িত্ব পান। সে ইতিহাসের অন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সঙ্গেও অনঙ্গমোহন দামের নিবিড় সম্পর্ক যে ছিল, তা আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না।
প্রসঙ্গত, প্রথম জীবনে বিপ্লবী অনঙ্গমোহন দাম বিয়ে করবেন না— এমনটাই পিতা অভয়া কুমার দাম ও মা নয়ানবাসী দামকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। বহু পরে পরিবারের সদস্যদের অনুরোধে বেশি বয়সে তিনি বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবেড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার বর্ধিষ্ণু ‘রুটি’ গ্রামের কুসুমকুমারীকে বিয়ে করেছিলেন। সেই সময় অবশ্য ‘রুটি’ গ্রাম ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। অনঙ্গমোহন দামের মৃত্যুর ১৫ বছর পর কুসুমকুমারী দাম ১৪ জানুয়ারি, ১৯৯৩ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অনঙ্গমোহন দামের পিতা অভয়া কুমার দাম উত্তরাধিকারসূত্রে জমিদারী পেয়েছিলেন। তাঁদের জমিদারী ছিল শ্রীহট্ট জেলার তখনকার মৌলভীবাজার সাব-ডিভিশনের ‘সতেরো সতী পরগনা’-য় এবং আরও কিছু ছিটমহলে যার মধ্যে দুটোর নাম ছিল দামিয়া ও বাউরভাগ। অনঙ্গমোহন দামের পিতা অভয়া কুমার দামও স্বদেশীভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি ইংরেজের কাছ থেকে রায়সাহেব অথবা রায়বাহাদুর জাতীয় একটা উপাধিও পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই উপাধি কখনো ব্যাবহার করতেন না। তাই তাঁর বংশধরেরা সেটা ঠিক কি উপাধি ছিল, তা এখন আর বলতে পারেন না। তাছাড়া বিপ্লবী অনঙ্গমোহন দাম ছিলেন সদালাপী তবে নিজের ও পরিবার সম্পর্কে ছিলেন প্রচারবিমুখ। আর এই কারণে এই বিপ্লবীর জীবন ও কর্মকাণ্ড নিয়ে বিক্ষিপ্ত ও অতি সামান্য উল্লেখ পাওয়া যায়। বেশ কিছু তথ্যে নানা জায়গায় অনিচ্ছাকৃত ত্রুটিও রয়ে গিয়েছে। অশোকনগর বা সোদপুর—যে দু’টি জায়গায় তিনি শেষ জীবনের ২৪টি বছর কাটিয়ে গিয়েছেন, সেই এলাকাবাসীদের গুটিকয়েক মানুষজন জানলেও এককথায় প্রেসিডেন্সিতে ওটেন প্রহারের কাণ্ডারী অনঙ্গমোহন দাম- উপেক্ষিত, বিস্মৃত ও অনালোচিত। স্বাধীনতা-৭৫-এ এই বিপ্লবীর স্মৃতিরক্ষামর্থে সরকার ও এলাকাবাসীদের কি কিছুই করার নেই!
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
অনঙ্গমোহন দামের জ্যেষ্ঠ পুত্র আশিসকান্তি দাম-এর স্মৃতিচারণা।
শ্রী উৎপল আইচ, শ্রীহট্ট সম্মিলনী, কলকাতা, ফেসবুক পোস্ট।
‘স্বামী গম্ভীরানন্দ’- দুষ্প্রাপ্য জীবনী গ্রন্থ, শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ, বেলুড়।