১৯৭৪ সাল। ইডেন গার্ডেন। দর্শকে দর্শকে স্টেডিয়াম পরিপূর্ণ। পঞ্চম দিনের খেলা শুরু হবে। ব্যাট হাতে ক্রিজে পৌঁছে গিয়েছেন আগের দিনের নট আউট  দুই ব্যাটসম্যান ক্লাইভ লয়েড আর এলভিন কালীচরণ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩ উইকেটে ১৪৬। জিততে গেলে লাগবে ৩১০ রান। দর্শকেরা চুপ করে বসে। তবে চাপা উত্তেজনায় ফুটছেন।

 আগের দিন চন্দ্রশেখর খুব বাজে বল করেছেন। রিচার্ডস তো একেবারে খেয়ে ফেলেছিলেন চন্দ্রাকে। ভাগ্য ভাল, মদনলালের বল হেলায় খেলতে গিয়ে আউট হয়ে যান রিচার্ডস।  

কিন্তু একি! সমস্ত দর্শক ,খেলোয়াড় যখন ভাবছেন, পঞ্চম দিনের  প্রথম ওভারে বল করবেন বিষাণ সিং বেদি আর সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ক্যাপ্টেন ভাবলেন অন্যরকম। বলটা তুলে দিলেন সেই চন্দ্রার হাতে। 

না, টাইগার না! ওঁর দ্বারা হবে না। তুমি প্রসন্ন কিংবা বেদিকে দিয়ে বল করাও। উত্তাল হল গ্যালারি।

 কিন্তু টাইগার কারও কথা শুনলেন না। চন্দ্রাকে দিয়েই বল করাবেন তিনি। চন্দ্রশেখরের  প্রথম ওভারটি খেলে দিলেন লয়েড। কিন্তু চন্দ্রা যে ভাবে বল করছে, খুশি নয় দর্শক। তারা বার বার বলতে শুরু করল, চন্দ্রাকে সরাও। আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল লয়েড যখন চন্দ্রাকে পরপর তিনটি  বাউন্ডারি মারলেন। রঞ্জি স্টেডিয়ামের দিকে শুরু হল গন্ডগোল। দাবি উঠল, চন্দ্রাকে সরাতেই হবে। 

কিন্তু ভারতের সেই সময়ের অধিনায়ক  একজন বাঘ। তাঁর একটাই কথা, পারলে চন্দ্রাই পারবে। বার বার ছুটে গেলেন চন্দ্রার কাছে। পিচে  একটা স্পট রয়েছে। তুমি-ই পারবে চন্দ্রা। 

ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন পৌঁছে গিয়েছে ১৬৩ রানে। হঠাৎই বেরিয়ে এল চন্দ্রার ম্যাজিক বল। লয়েড আউট ,তারপর কালীচরণ, ব্রেন্ডন জুলিয়ানও আউট। চন্দ্রশেখর পর পর তিনটি উইকেট নিয়ে সেই টেস্টে ধ্বংস করে দিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। আবার উত্তাল হল স্টেডিয়াম।  তবে অন্য ভাবে।

এই টেস্ট জয়টি ভারতের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে এই সিরিজের আগেই অজিত ওয়াডেকরের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড সফর করেছিল ভারত। যতটা বাজে ভাবে হারা যায়, ততটাই খারাপ পারফরম্যান্স ছিল ভারতের। এমনকি, একটি টেস্টে মাত্র ৪২ রানে আউট হয়ে গিয়েছিল সবাই। অজিত ওয়াডেকর দেশে ফিরেই পদত্যাগ করেন।

এদিকে দুর্ধর্ষ টিম নিয়ে ভারতে আসছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যাপ্টেন কে হবে? কে পারবে মনোবল ভেঙে যাওয়া ভারতীয় টিমকে দিশা দেখতে? একটাই নাম ,পারলে সে-ই পারবে। ফিরিয়ে আনো টাইগারকে। মানে মনসুর আলি খান পতৌদিকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমে তখন  ওপেন করতেন ফেড্রিক ও নবাগত গর্ডন গ্রিনিজ। তারপর কালীচরণ , রিচার্ডস , লয়েড, ডেরেক মারে। বোলিংয়ে বিশ্বত্রাস অ্যান্ডি রবার্টস। 

প্রথম দুটো টেস্টে ভীষণ ভাবে পর্যুদস্ত ভারত। টিমের একনম্বর ব্যাটসম্যান গাভাসকার আহত রবার্টসের  বলে। পতৌদি নিজেও আহত হলেন। ব্যাটসম্যান বলতে দেড়জন! জি আর বিশ্বনাথ আর কিছুটা হলেও অংশুমান গায়কোয়াড়। এই অবস্থাতেই কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে শুরু হয়েছিল তৃতীয় টেস্ট। সিরিজে ২-০ থেকে ২- ১। তারপর মাদ্রাজে ২-২। যদিও মুম্বইয়ে  হেরে ভারত সিরিজ হারালো। আর  টাইগার ঘোষণা করলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তিনি অবসর নিচ্ছেন। বললেন, অ্যান্ডি রবার্টসকে খেলতে অসুবিধা হচ্ছে। বুড়ো হয়ে গিয়েছি!

 বুড়ো লোকটার একটা চোখ পাথরের! তবে তিনি নবাব। নবাবের মতোই বিদায় জানালেন ক্রিকেটকে। টাইগার হলেন সেই ব্যক্তি যিনি ক্রিকেট মাঠে ভারতকে প্রথম লড়তে শিখিয়েছিলেন। জিম্বোবোয়ের তাতেন্দ্র তাইবু  এখন বিশ্বের সব ক্রিকেট দলের মধ্যে সর্বকনিষ্ট ক্যাপ্টেন।  তার আগে পতৌদিই ছিলেন টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে কমবয়সি ক্যাপ্টেন। মাত্র ২২ বছর ৭৪ দিনের মাথায় ক্যাপ্টেন হয়েছিলেন তিনি। ছিলেন বিশ্বের সেরা ফিল্ডার , একজন ডানহাতি পেস বোলার ও ডানহাতি ব্যাটসম্যান। দুর্ঘটনায় ডান  চোখটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যে কোনও জিনিস দু’টো করে দেখতেন। কিন্তু অবাক করা বিষয়, দুর্ঘটনার ছ’মাসের মধ্যেই ক্রিকেটে ফিরে এসেছিলেন পতৌদি। হয়েছিলেন ভারতের ক্যাপ্টেন।  

ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে নবাব মনসুর আলি খান পতৌদি তাই এক অবিস্মরণীয় নাম। সত্যিকরের বাঘ।