‘বাল্যকালের ভালবাসায় বুঝি কিছু অভিসম্পাত আছে। যাহাদের বাল্যকালে ভালবাসিয়াছো, তাহাদের কয়জনের সঙ্গে যৌবনে দেখা-সাক্ষাৎ হয়? কয়জন বাঁচিয়া থাকে? কয়জন ভালবাসার যোগ্য থাকে? বার্ধক্যে বাল্যপ্রণয়ের স্মৃতিমাত্র থাকে, আর সকল বিলুপ্ত হয়। কিন্তু সেই স্মৃতি কত মধুর!’ হ্যাঁ, ঠিক এ ভাবেই সাহিত্যের পাতায় হক কথা বলেছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। হে সুধী পাঠক, বুকে হাত রেখে বলুন তো— মিলল কি না! জানি, মিলেছে। এবং তা সত্ত্বেও আপনি চাপ নিতে নারাজ। হয়তো স্মৃতিটাও হারিয়ে ফেলেছেন। উপরের লাইনক’টা পড়েই ফের পুরনো ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে উঠল। টুক করে অধুনা সংসার ফেলে ফিরে গেলেন ওই বোকা-বোকা বাল্যপ্রেমে। ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টে ‘সে’ থাকলে তো মিটেই গেল। না-হলে সার্চবার গিয়ে নির্ঘাত এতক্ষণে তার নামখানা লিখে ফেলেছেন জানি। হায়! যেটা ছিল না, ছিল না সেটা না পাওয়াই থাক! তাই তো নাকি?
হ্যাঁ, বাস্তবে এটাই সমীকরণ। মধ্যবিত্তের ভীরু প্রেম। ব্যর্থ প্রেম। ইতিহাসই তো। সিনেমায় অবশ্য রংচঙে দুনিয়া। সিলভার স্ক্রিনে ম্যাজিক শো ফেঁদেছিলেন পরিচালক অনুরাগ বসু। বেলাশেষের গান শুনিয়েছিলেন! ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ছবিতে বুড়ো বয়সে চার হাত এক করেছিলেন ধর্মেন্দ্র-নাফিসার। কেরিয়ারের মোহে চল্লিশ বছর আগে শুধু দেশ নয়, প্রেমিকাকেও ছেড়ে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দিয়েছিল নায়ক। নায়িকার ঘরে অপেক্ষা তত দিনে জমতে-জমতে অভিমান। ও-পারে শেষমেশ ঘোর কাটে ষাট পার করে। চিঠি আসে নাফিসার ঠিকানায়। তাঁকে শুধু একটিবার চোখের দেখা রাখতে চায় নায়ক। সেই এক বঙ্কিমি স্ট্রাকচার—
‘বালকমাত্রেই কোন সময়ে না কোন সময়ে অনুভূত করিয়াছে যে, ঐ বালিকার মুখমণ্ডল অতি মধুর। উহার চক্ষে কোন বোধাতীত গুণ আছে। খেলা ছাড়িয়া কতবার তাহার মুখপানে চাহিয়া দেখিয়াছে— তাহার পথের ধারে, অন্তরালে দাঁড়াইয়া কতবার তাহাকে দেখিয়াছে। কখন বুঝিতে পারে নাই, অথচ ভালবাসিয়াছে। তাহার পর সেই মধুর মুখ—সেই সরল কটাক্ষ—কোথায় কালপ্রভাবে ভাসিয়া গিয়াছে। তাহার জন্য পৃথিবী খুঁজিয়া দেখি— কেবল স্মৃতিমাত্র আছে।’ কিন্তু সিনেমায় অন্যরকমও হয়। নায়ক প্রাণ ভরিয়ে চাইতেই নায়িকার অভিমান গলে জল। ‘লগে রহো মুন্নাভাই’ ছবিতেও একই ভাবে অর্ধশতাব্দীর ব্যর্থ প্রেমকে কিসিং কার-এর ব্যাক সিটে বসিয়েছিলেন রাজকুমার হিরানি।
সুধী পাঠক, শুধু সিনেমায় নয়, এসব বাস্তবেও হয়। বাস্তবের রুক্ষ মাটিতেও সম্প্রতি ৩৫ বছরের আদি প্রেমে বিয়ের ফুল ফুটিয়েছেন কর্নাটকের চিকান্না-জয়াম্মা। উজ্জ্বল শাড়িতে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন পাত্রী— বয়স পঞ্চান্ন। আর পাত্র মোটে পঁয়ষট্টি। যৌবনের প্রেম স্বীকৃতি পায়নি। বেঁকে বসেছিল পরিবার। এখন মোটামুটি ঝাড়া হাত-পা। বিয়েটা তাই সেরেই ফেললেন দু’জনে।
তবে এ নিয়ে আর পাঁচটা লোক জানুক, একেবারেই তা চাননি জয়াম্মা। আগের পক্ষের বিয়েতে বছর পঁচিশের একটি ছেলে রয়েছে তাঁর। সমঝোতার প্রথম বিয়ে। তবু ভেবেছিলেন, আগামী বছর ছেলেটার বিয়ে হয়ে গেলে ‘সুখবরটা’দেবেন। কিন্তু চিকান্নার সঙ্গে তাঁর মালাবদলের ছবি যে ইতিমধ্যেই ভাইরাল! এবার? বছরের পর বছর অ্যাডজাস্ট করতে-করতে হালে যেন বল পেয়েছেন জয়াম্মা। বলেই দিলেন, ‘যে জানছে জানুক। আর ভয় পাই না। যা হয় হোক, মনের মানুষের সঙ্গে ঘর করার সুযোগ তো পেলাম।’
চিকান্নার অবশ্য লোকলজ্জার ব্যাপার বিশেষ নেই। তাঁর তো এই প্রথম বিয়ে। এতদিন এসব নিয়ে ভাবেননি। পুরনো ব্যথাটা শুধু মাঝে মাঝেই চাগাড় দিয়ে উঠত। ‘জাস্ট ম্যারেড’ লাইফে সেটাও ভ্যানিশ। হাসান জেলার দেবারামুদ্দানাহালি গ্রামের আর পাঁচটা জোয়ান ছেলের মতো তাঁরও প্রেম এসেছিল নীরবেই। গ্রামের মেয়ে জয়াম্মার সঙ্গে সেই প্রথম আর শেষ প্রেম। চিকান্না তখন চুক্তি-শ্রমিক। জয়াম্মার পরিবার তাই আরও ভাল ‘অপশনের’ আশায় তাঁর সঙ্গে বিয়ে নাকচ করে দেয়। অন্যত্র বিয়ে দেয় মেয়ের। প্রতিবাদ করতে পারেননি, শুধু ভিটে ছেড়ে মাইসুরুতে চুক্তি শ্রমিকের কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিলেন চিকান্না। এর মাঝে একবারও তাঁর দেখা কিংবা কথা হয়নি জয়াম্মার সঙ্গে। কিন্তু খোঁজ রাখতেন নিয়মিত। জানতেন যে, জয়াম্মা সুখী হননি। তবু মুখ বুজেই ছিলেন। ওদিকে মুখ বুজে সংসার করছিলেন জয়াম্মাও। শেষমেশ যখন জানতে পারলেন জয়াম্মার স্বামী তাঁকে ছেড়ে গিয়েছেন এবং ছেলেকে নিয়ে জয়াম্মা ঘটনাচক্রে মাইসুরুতেই থাকতে শুরু করেছেন— সাহস জোটালেন পঁয়ষট্টির বৃদ্ধ। ফের শুরু হল মোলাকাত। বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে এবার আর দেরি করেননি জুটিতে। ‘ঘুম থেকে উঠে একসঙ্গে চায়ের কাপ নিয়ে বসব বারান্দায়— এত দিনের স্বপ্ন এবার সত্যি হবে। জীবনে আর কী চাই,’ বলেই ফোকলা মাড়িতে হেসে ফেললেন পঁয়ষট্টির ‘তরুণ’।