দুনিয়ায় নববর্ষ পালনের হোতা ইরানিয়রা। ফার্সি নওরোজের জাঁকজমক অভিভূত ইউরোপ পরে গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জি অনুসারে পয়লা জানুয়ারি পালন শুরু করে। তবে বাংলা নববর্ষ কবে থেকে পালন করা শুরু হয়, কে বাংলা নববর্ষ বা বাংলা বর্ষ গণনা শুরু করেন—এ নিয়ে কিছু বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই পয়লা বৈশাখ নিয়ে কিছু কথা।

ভারতে নববর্ষ পালনের রেওয়াজ শুরু হয় মুঘল আমলে। ফার্সি নওরোজের আদলে ধুমধাম করে রাজধানী দিল্লি ও সুবগুলোতে নববর্ষ উৎসব উদযাপন শুরু হয়। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, বৈদিক যুগে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধার্য হয় অগ্রহায়ণ। অঘ্রাণ মাসেই নবান্ন হত। মুর্শিদকুলি খাঁ যখন বাংলার শাসক তখন খাজনা আদায়ের জন্য ধার্য হয় বৈশাখ মাস। আর আকবরের আমলে হোলি নববর্ষ উৎসব আলাদা মাত্রা গ্রহণ করে। ভূমিসংস্কার করেছিলেন শের শাহ, আকবর এগোলেন রাজস্ব সংস্কারে। ভূমি মাপ, ভূমি ও কৃষি রাজস্ব আদায়ে আইন তৈরি করতে সাহায্য করেন তোডরমল। এখন বছরে একটা নির্দিষ্ট দিন চাই খাজনা আদায়ের। আরবি হিজরি অনুযায়ী সম্ভব নয়। দিন নির্দিষ্ট থাকে না চান্দ্র বর্ষে। তাই সৌর বর্ষের সন্ধান।

১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা নববর্ষের দিনক্ষণ নির্ধারিত হলো। দিনক্ষণ নির্ধারণ করলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তক ফতেউল্লাহ্ সিরাজি। হিজরি সনের ভিত্তিতে তৈরি হল সন-এ-ইলাহি। ভিত্তিবর্ষ হল হিজরি সন আদতে যা ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ। এর নাম কেউ বলেন সন, কেউ সাল, কেউ বঙ্গাব্দ। সন আরবি শব্দ, সাল ফার্সি শব্দ। বঙ্গাব্দ বাংলা। খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলা পৌঁছতে একটা সহজ নিয়ম অনুসরণ করতে পারেন। ৭ বছর, ৩ মাস ১৭ দিন কম করলে সাধারণত মেলে।

।।দুই।।

বাংলায় নববর্ষ নানা নামে প্রচলিত ছিল বা আছে। পুণ্যাহ, হালখাতা, বৈশাখী মেলা, চট্টগ্রাম অঞ্চলে বলী খেলা ইত্যাদি।

‘পুণ্যাহ’ জমিদারদের খাজনা আদায়ের দিন। আর সারা বছর ধারে কেনাকাটা করে ধার শোধ করার উৎসব হালখাতা। ওইদিন হিন্দু মুসলিম দোকানদাররা আমপাতা দিয়ে দোকান সাজান। ধূপ জ্বালান। কেউ কেউ ধুনো দেন। একটা লালখাতায় জমা পড়া টাকার পরিমাণ লেখা হয়। মিষ্টির প্যাকেট দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও লুচি তরকারি আয়োজন থাকে। কেউ কেউ বসিয়ে খাওয়ান। আর ইদানীং দেওয়া হয় ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডার আবহমান বাংলার মিশ্র সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। হিন্দু বা মুসলিম যেই দোকানদার হন দুই সম্প্রদায়ের কথা মাথায় রেখেই ক্যালেন্ডার করবেন। হিন্দু  মুসলিম দুই ধর্মের প্রতিষ্ঠানের ছবি থাকে। আমাদের ছোটবেলায় একটা ক্যালেণ্ডার ছিল খুব ‘কমন’—কাজী নজরুল ইসলামের ছবি দিয়ে তলায় লেখা— ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি? আর থাকতো হৃষ্টপুষ্ট শিশুর মুখ। রাজনৈতিক নেতা নেত্রীর মুখ দেখিনি। ব্যতিক্রম সুভাষচন্দ্র বসু। ঘোড়ায় চড়া সুভাষ থাকতেন। তবে নজরুল ইসলামের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় কেউ ছিলেন না।

প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতি গবেষক শামসুজ্জামান খান লিখেছেন–‘বাংলা নববর্ষের আর একটি প্রধান অনুষ্ঠান হল বৈশাখী মেলা। দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখের প্রথম দিনে বার্ষিক মেলা বসে। এইসব মেলার অনেকগুলোই বেশ পুরনো। এই মেলাগুলোর মধ্যে খুব প্রাচীন ঠাকুরগাঁ জেলার রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদের মেলা এবং চট্টগ্রামের মহামুনির বৌদ্ধপূর্ণিমা মেলা। এক সময়ে এইসব মেলা খুব ধূমধামের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হতো। সে-মেলা এখনো বসে, তবে আগের সে জৌলুস এখন আর নেই। আগে গ্রাম-বাংলার এই বার্ষিক মেলাগুলোর গুরুত্ব ছিল অসাধারণ। কারণ, তখনো সারাদেশে বিস্তৃত যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে মানুষের জীবনযাত্রা ছিল স্থবির। এখন যেমন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে এক দিনের বেশি লাগে না। আগে তা সম্ভব ছিল না। নৌকা, ঘোড়ার গাড়ি, গরুর, মোষের গাড়িতে মানুষ বা পণ্য পরিবহণে বহু সময় বা কয়েকদিন লেগে যেত। এখন নতুন নতুন পাকা রাস্তা ও দ্রুতগতির যানবাহন চালু হওয়ায় সে-সমস্যা আর নেই। আগে এইসব আঞ্চলিক মেলা থেকেই মানুষ সারা বছরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাখত। তাছাড়া, এইসব মেলা অঞ্চল বিশেষের মানুষের মিলনমেলায়ও পরিণত হতো। নানা সংবাদ আদান-প্রদান, নানা বিষয়ে মত বিনিময়েরও আদর্শ স্থানও ছিল এই সব মেলা। আবার বাৎসরিক বিনোদনের জায়গাও ছিল মেলা। মেলায় থাকত কবিগান, কীর্তন, যাত্রা, গম্ভীরা গান, পুতুল নাচ, নাগর দোলাসহ নানা আনন্দ-আয়োজন।

নববর্ষের ওই তিনটি প্রধান সার্বজনীন উৎসব ছাড়াও বহু আঞ্চলিক উৎসব আছে। এদের মধ্যে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত বলী খেলা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯০৭ সাল থেকে কক্সবাজার-সহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের নানাস্থানে এই খেলার প্রচলন আছে। এই বিখ্যাত কুস্তি খেলাকেই বলা হয় বলী খেলা। আবদুল জব্বার নামে এক ব্যক্তি এ খেলার প্রবর্তন করেন বলে একে ‘জব্বারের বলী খেলা’ বলা হয়’।

।।তিন।।

পান্তাভাত খাওয়ার একটা প্রচলন ঢাকায়, কলকাতায় আছে। এর মূলে আছে কৃষকদের আমানি খাওয়ার প্রথা। শামসুজ্জামান খান লিখেছেন—আমানিও নববর্ষের একটি প্রাচীন আঞ্চলিক মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। এটি প্রধানত কৃষকের পারিবারিক অনুষ্ঠান। চৈত্র মাসের শেষদিনের সন্ধ্যারাতে গৃহকর্তী এক হাঁড়ি পানিতে স্বল্প পরিমাণ অপক্ব চাল ছেড়ে দিয়ে সারারাত ভিজতে দেন এবং তার মধ্যে একটি কচি আমের পাতাযুক্ত ডাল বসিয়ে রাখেন। পয়লা বৈশাখের সূর্য ওঠার আগে ঘর ঝাড়ু দিয়ে গৃহকর্ত্রী সেই হাঁড়ির পানি সারা ঘরে ছিঁটিয়ে দেন। পরে সেই ভেজা চাল সকলকে খেতে দিয়ে আমের ডালের কচি পাতা হাঁড়ির পানিতে ভিজিয়ে বাড়ির সকলের গায়ে ছিঁটিয়ে দেন। তাদের বিশ্বাস এতে বাড়ির সকলের কল্যাণ হবে। নতুন বছর হবে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির।

এছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলে ছিল বৈসাবী উৎসব। পার্বত্য বৈসুব, সাংগ্রাই ও বিজু তিনটিকে একত্র করে ‘বৈসাবী’। ‘গ্রাম-বাংলায় নববর্ষে নানা খেলাধুলারও আয়োজন করা হতো। মানিকগঞ্জ মুন্সীগঞ্জে হতো গরুর দৌড়, হাডুডু খেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মোরগের লড়াই, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, নড়াইলে ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি’।

এটা পূর্ববঙ্গের বৈশিষ্ট্য। পশ্চিমবঙ্গ ছিল ৩০ চৈত্র শিবের গাজন বা চড়কের মেলা। লোকে সাত বা তিনদিনের জন্য সন্ন্যাসী সাজতো। ঝাঁপ দিত, কাঁটার ওপর দিয়ে হেঁটে যেত, আগুনের মধ্য দিয়ে  লাফ দিয়ে পার হতো, পিঠে কাঁটা ঝুলিয়ে শূন্যে ঘুরতো। আমাদের গ্রামে উঁচু থেকে ঝাঁপ দিত, পুকুরে স্নান করে আধ কিমি রাস্তা দন্ডি কেটে কেটে ফিরতো। তারপর ঝাঁপ দেওয়ার আগে ডাব ছুড়তো। সেই ডাব কাড়তে হুড়োহুড়ি পড়তো। যারা দল পাকিয়ে বেশি ডাব কাড়তে পারতো তাঁরা নায়কের সম্মান পেতেন। হিন্দু মুসলমান মিলেই দল গড়া।

।।চার।।

রবীন্দ্রনাথ প্রথম নাগরিক জীবনে পয়লা বৈশাখকে অন্যভাবে সঞ্চারিত করেন। পয়লা বৈশাখের পর জলাভাবের কারণে শান্তিনিকেতনে ছুটি দেওয়া হতো। সে জন্য পঁচিশে বৈশাখের বদলে পয়লা বৈশাখ নাচ গান কবিতায় উদ্বেল হয়ে উঠত শান্তিনিকেতন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ফজলুল হক সরকার গঠন করে প্রথম পয়লা বৈশাখে ছুটি ঘোষণা করেন। পরে পাকিস্তান সরকার তা বাতিল করে। পশ্চিমবঙ্গে একুশের প্রথম দশকে পয়লা বৈশাখের ছুটি দেওয়া হয়নি। পরে হইচই করায় ছুটি ফেরে।

১৯৬৭ থেকে রমনা ময়দানে শুরু প্রতিবাদী পয়লা বৈশাখ। আজ তা ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। এ-রাজ্যে ভাষা ও চেতনা সমিতি ১৯৯৯ থেকে সারাদিন টানা ১২ ঘণ্টা জাতীয় নববর্ষ উৎসব পালন করে। এটা আর কোথাও হয়না। বিরতিহীন ১২ ঘণ্টা উৎসব। তবে বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রার কোনো তুলনা নেই। লাখ লাখ মানুষ নামেন পথে ভালবাসায় রঙিন হয়ে।