মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন। ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন। প্রান্তিক মানুষের জীবনজীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন। সুন্দরবনকে জলদস্যু মুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন।

২০১৬ সালের ৩১ মে। টানটান উত্তেজনা সুন্দরবনের পশুর নদীতে। দীর্ঘ যাত্রায় প্রথম সাফল্য। এতদিন বলা হতো, সুন্দরবনের দস্যুদের ভয়ে বাঘ ও হরিণ এক ঘাটে পানি খায়, সেই দস্যুরা নিজের হাতে জমা দিলেন ৫২টি অস্ত্র। শপথ নিলেন স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনে ফিরে আসার। তারপর ধাপে ধাপে ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করলেন ৱ্যাবের হাতে। জমা পড়ল ৪৫০টিরও বেশি অস্ত্র। জলদস্যু মুক্ত হল সুন্দরবন। হাসি ফুটল এলাকার মানুষ ও মৎস্যজীবীদের মুখে।
কাজটা কিন্তু সহজ ছিল না। প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল অনেক আগে, ২০০৯ সালে। কাজটিকে সফল করার জন্য আমাকে ১৩৭ বার সুন্দরবনে যেতে হয়েছে। বোঝাতে হয়েছে সব পক্ষকে। জলদস্যুদের বিভিন্ন দলকে বোঝাতে হয়েছে, সুস্থ জীবনে ফিরে এলে কতটা লাভ হতে পারে তাঁদের। কীভাবে গোটা জীবনটাই বদলে যেতে পারে। তখন জলদস্যুদের অস্ত্রের দাপটে কাঁপছে সুন্দরবন। কিন্তু তাঁরাও তো ঘুমোতে পারছেন না। ওঁদের চোখেমুখে ভয়, অবিশ্বাস। প্রায় রোজই এনকাউন্টার। কে বাঁচে, কে মরে— ঠিক নেই।

প্রথমে কেউ বিশ্বাস করেনি আমাকে। না জলদস্যুরা, না বাংলাদেশের প্রশাসন। বার বার যেতে হয়েছে দু’পক্ষের কাছে। বারবার! অবশেষে ছ’বছরের চেষ্টায় আজ সুন্দরবন অনেকটাই জলদস্যু মুক্ত।
অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, বছরের পর বছর এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে কেন নিজেকে সমর্পণ করেছিলাম আমি? কেন এই ঝুঁকি নিতে গেলাম?

সুন্দরবনের জলদস্যু। ছবি- লেখকের সৌজন্যে

আমাদের সুন্দরবনে জলদস্যুদের প্রধান শিকার হতেন গরিব জেলেরা। মনে হয়েছিল, জলদস্যুদের যদি কোনও ভাবে সাধারণ জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়— তাহলে সুন্দরবন এলাকার ত্রিশ-চল্লিশ লক্ষ মানুষ শান্তিতে ঘুমোতে পারবেন। ওই জলদস্যুরা কেউ আর্থিক ভাবে সচ্ছল ছিলেন না, একটি অর্থনৈতিক চক্রের মধ্যে আটকে ছিলেন তাঁরা। আমার লক্ষ্য ছিল, তাঁদের শান্তির ও সুরক্ষিত জীবন দেওয়া। সেই সঙ্গে নিরাপদ সুন্দরবন।
১২ বছর আগে ঘুর্ণিঝড় আইলার পরে আমার প্রথম সুন্দরবনে যাত্রা। তখন ঢাকা শহরে সাংবাদিকতা করছি। একদিন বিরাট ঝড় বয়ে গেল বাংলাদেশের উপর দিয়ে। পরদিন খবর করতে চলে গেলাম সুন্দরবনে। পৌঁছে দেখি, কোথাও কিছু অবশিষ্ট নেই। যে এলাকায় আইলা আঘাত করেছে, সেই খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদীর মোহনা অঞ্চলে সমস্ত জনপদ বিধ্বস্ত। নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে পুরো এলাকা। মনে হল, গোটা বাংলাদেশে এই লোকগুলির থেকে বিপন্ন আর কেউ নেই। যাঁদের ন্যূনতম খাবার পানিটুকু পর্যন্ত নেই। কিন্তু সুন্দরবনের এই মানুষগুলি যে সম্পদ সংগ্রহ করেন, সেটা অনেক দামি।
এলাকাটা সর্ম্পকে প্রবল কৌতূহল তৈরি হল। খবর করা শুরু করলাম এখানকার মানুষের জীবনযাপন, তাঁদের সমস্যাগুলি নিয়ে। তখন আমি একজন অপরিণত সাংবাদিক। হয়তো সংবাদ পরিবেশনে কিছু খামতি ছিল। তবুও চেষ্টা শুরু করেছিলাম এই মানুষগুলির কথা যতটা সম্ভব তুলে ধরা যায়, দেশের অন্যপ্রান্তের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
ব্যর্থ হলাম। নিউজের ফিডব্যাক খুব কম। কিন্তু আমার একটা বদভ্যাস রয়েছে। যেটা শুরু করি, সেই কাজে লেগে থাকি। মনে মনে ভাবলাম, যতদিন না এখানকার মানুষের কিছু উন্নতি হচ্ছে, ততদিন এই এলাকায় কাজ করে যাব। এখানকার মানুষেরা যে শুধু প্রকৃতির হাতে মার খাচ্ছেন, তা নয়। তাঁদের দুর্দশার পিছনে কিছু স্বার্থান্বেষীরও অবদান রয়েছে। আর ভয় জলদস্যুদের থেকে। বুঝলাম, জলদস্যু ও সেই স্বার্থান্বেষীদের একটা যোগসূত্রও রয়েছে। খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম জলদস্যুদের বিষয়ে।
বাংলাদেশ সরকার তখন চাইছে সুন্দরবনের সমস্যার সুরাহা হোক। কিন্তু আমার মনে হল, এই এলাকায় শুধু পুলিশি অভিযান করে জলদস্যুদের বাগে আনা সম্ভব নয়। আমার ভাবনা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জানালাম। তবে তাঁরা সহমত হলেন না। কী করা যায় ! এরপর কাজের পদ্ধতি পাল্টে ফেললাম। ঠিক করলাম, জলদস্যুদের দলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করব। তারা কী ভাবছে, সেটা জানা দরকার।
সুন্দরবন উপকূলের সঙ্গে বাংলাদেশের পাঁচটি জেলা ও প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের যোগ। মানুষের রোজকার জীবন ও অর্থনীতি জড়িয়ে রয়েছে এখানকার নদীনালার সাথে। এলাকার কেউ যখন নদীতে মাছ ধরতে যান, তাঁর পরিবার বিনিদ্র রাত কাটায়। জলদস্যুরা কখন আক্রমণ করবে, প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে তো মানুষটি! আর যাঁরা মাছ ধরতে গিয়েছেন তাঁদেরও চোখে ঘুম নেই। সন্ধে হলেই বাতি নিভিয়ে দিতে হচ্ছে মাঝনদীতে। একবার জলদস্যুদের চোখে পড়লে রক্ষে নেই। অত্যাচার তারপর মোটা টাকা দিলে মিলবে মুক্তি। তবে খবর পেলাম, মৎস্যজীবীদের সাধারণত মেরে ফেলেনা জলদস্যুরা। মুক্তিপণের জন্য চাপ দিতে থাকে। আবার জলদস্যুদের বিভিন্ন দলের মধ্যে লড়াইয়েও মৃত্যুর খবর সামনে আসে।
এরপর একসময়ে যোগাযোগ হল জলদস্যুদের সঙ্গে। কী ভাবে, সে কথা পরে জানাব। তবে বুঝেছিলাম, যাঁদের জন্য সুন্দরবনের ত্রিশ লক্ষ লোকের আশঙ্কার শেষ নেই— সেই জলদস্যুরাও ঠিক করে ঘুমোতে পারেন না রাতে। নিজেদের জীবন নিয়ে খুশি নন তারা। বেশিরভাগের মুখে একটাই কথা— ‘‘না, এই জীবনে আমরা একদম খুশি নই। কিন্তু একবার যখন চলে এসেছি তখন আগের জীবনে ফিরবো কি করে?’’ আমি প্র্রস্তাব দিলাম, “আত্মসমর্পণ করবেন?” কিন্তু তাঁরা বললেন, “না! আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে বিশ্বাস করি না।” আমার মনে হল, হয়তো সঠিক আশ্বাস পেলে এঁরা আত্মসমর্পণ করতে পারেন— কিন্তু তার জন্য চাই একজন মধ্যস্থতাকারীর। কে সেই দায়িত্ব নিতে পারে— সেই মানুষটিকে খুঁজতে শুরু করলাম।

জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ। ছবি- লেখকের সৌজন্যে

পেলাম না। অনেক ভেবে দেখলাম, আমি একজন সাংবাদিক ঠিকই। কিন্তু তার পরেও তো আমার একটা আলাদা সত্ত্বা রয়েছে। আমি তো বাংলাদেশের একজন নাগরিক। আমারও তো দায়িত্ব রয়েছে।
পুরো বিষয়টা নিয়ে খবর করতে শুরু করলাম। সেই সঙ্গে জলদস্যুদের প্রস্তাব আবেদনপত্রের মাধ্যমে পাঠালাম স্বরাষ্ট মন্ত্রকের কাছে। ব্যর্থ হলাম। নাকচ হয়ে গেল আবেদনপত্র। আবার দিলাম, আবার। পর পর তিনবার। রাজি হচ্ছে না প্রশাসন। অবশেষে চতুর্থবারে রাজি হল সরকার। আত্মসমর্পণ করল একটি বাহিনী।
অবিশ্বাস্য সেই খবর ছড়িয়ে পড়ল গোটা সুন্দরবন এলাকায়। ধীরে ধীরে জলদস্যুদের একের পর এক দল আত্মসমর্পণ করতে থাকল বাংলাদেশের বাহিনীর কাছে।
আমি মানুষগুলিকে কথা দিয়েছিলাম— তোমাদের ঘরে ফেরাবো। তোমরাও শান্তিতে ঘুমোতে পারবে।

আর সেই সঙ্গে শান্তিতে থাকবে সুন্দরবনের ৩০ লক্ষ মানুষ।
চলুন যাওয়া যাক সুন্দরবনের ভেতরে।
বালিহাঁস-এর পাঠকদের দিনলিপির মতো প্রতি সপ্তাহে শোনাবো সুন্দরবনে আমার সেই সব অভিজ্ঞতার কথা।

(ক্রমশ)