পর্ব ২৯

    পুরাকালে তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে বেদপুর নগরে কেশব বলে এক বেশ্যাসক্ত ব্রাহ্মণ বাস করতেন। সে তাঁর পিতা, মাতা ও স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে গণিকাগৃহে থাকতে শুরু করলো। তার হাতের সমস্ত অর্থ সে বেশ্যার পিছনে খরচ করে ফেলল। কিন্তু বেশ্যারা কখনও নির্ধন ব্যক্তিকে আদর করে না। তাই সে ধনের জন্য চৌর্য্যবৃত্তি শুরু করল। একবার সে চুরি করতে এক ব্রাহ্মণের ঘরে প্রবেশ করল এবং খড়্গ দিয়ে গৃহকর্তা হত্যা করে সমস্ত দ্রব্য হরণ করল। তখন ব্রহ্মহত্যা তাকে তাড়া করে বেড়াতে লাগল। ব্রহ্মহত্যার ভয়ে সে শুধু দৌড়তেই থাকল। এ গল্প স্কন্দপুরাণের বিষ্ণু খণ্ডে আছে। 

    এই খণ্ডে আরও একটি কাহিনী আছে- কুরুক্ষেত্রে পুণ্ডরীক নামে এক ব্রাহ্মণ ও অম্বরীষ নামে এক ক্ষত্রিয় দুজনে হরিহর আত্মা বন্ধু ছিলেন। তারা ছিলেন মদোন্মত্ত ও সর্বদা বেশ্যা সহবাসে অভ্যস্থ। এই ভাবে বিপথগামী দুজনের আয়ু অর্ধেক ক্ষয় হয়ে গেল। তখন তাদের টনক নড়ে এবং ধর্ম কার্যের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মায়। এই দুটি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, গণিকাসঙ্গ পুরাণের যুগে নিন্দনীয় ছিল, আজকের যুগেও তা প্রশংসনীয় নয়। 

   এই কারণে আমাদের সাহিত্যে গণিকা চরিত্রকে কখনও উজ্জ্বল করে দেখানো হয়নি। তাদের অর্থলোভী, অমানবিক, অনাচারিণী হিসাবে দেখানো হয়েছে। আমাদের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র, নাটক ও যাত্রাতে বেশ্যা চরিত্রগুলো সবক্ষেত্রে অতটা খারাপ না দেখালেও, চিত্রনাট্যে তাদের অবতারণার উদ্দেশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থাকে যৌনতার আমদানি। আগে হিন্দি সিনেমার ভ্যাম্প চরিত্রগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হতো হোটেল নর্তকী বা বার সিঙ্গার। 

    এরপর আছে বিষকন্যা। কুমারী মেয়েদের শিশু কাল থেকে খাদ্যের সঙ্গে বিষ খাইয়ে তৈরি করা হত বিষকন্যা। তাদের শরীর হয়ে উঠতো বিষময়। এদের সংস্পর্শে এলে বা ঠোঁট স্পর্শ করলে বা এদের ঘাম গায়ে লাগলে সাধারণ লোকের মৃত্যু ঘটত। ইতিহাসের কিংবদন্তীতে বিষকন্যার উল্লেখ আছে। শিশুনাগ বংশের কালাশোককে হত্যা করে নন্দবংশের মহাপদ্মনন্দ মগধের সিংহাসন দখল করেন। বলা হয়, মহাপদ্মনন্দ কালাশোককে মারতে বিষকন্যা পাঠিয়েছিলেন। এমনকী চাণক্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে প্রতিদিন খাদ্যের সঙ্গে অল্প অল্প করে বিষ খাওয়াতেন, যাতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে কেউ বিষপান করিয়ে হত্যা না করতে পারে। 

     বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিষকন্যার অস্তিত্ব আদৌ ছিল না। হয়তো কিছু গণিকা যারা ছলাকলার সঙ্গে বিষ বিদ্যাতেও পারদর্শী, তারা সঙ্গোপনে বিষ নিয়ে যেতো এবং সুযোগ বুঝে শিকারের ওপর বিষ প্রয়োগ করত, তাতে নির্দিষ্ট শত্রু মৃত্যু বরণ করত। তবে আমাদের সাহিত্যে, লোককথায় বিষকন্যা খুব জনপ্রিয়। বিদেশি সাহিত্যেও এর উল্লেখ আছে। 

     ব্যোমকেশস্রষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিষকন্যা’ নামে একটি গল্প আছে। সে গল্পের পটভূমি মগধ রাজ্য এবং সময় শিশুনাগ বংশের রাজত্বকাল। 'উল্কা' নামে এক বিষকন্যা শিশুনাগ বংশ ধ্বংস করতে এসে নিজেই আত্মহত্যা করে। এখানে বিষকন্যা বিষ দিয়ে নয় 'ছুরিকা' দিয়েই তার কাজ সারতো।

     আমরা দেখতে পাচ্ছি পুরাণে, লোককথায়, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে সর্বত্র দেহ পসারিণীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিকৃষ্ট চরিত্র হিসাবে দেখানো হয়েছে। তারা অর্থের লোভে সবকিছু করতে পারে। তাদের জন্য অসংখ্য সুখের সংসার ছারখার হয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে সঙ্গসুখ কিনতে যে অর্থ লাগে, সেই অর্থ সংগ্রহ করতে পুরুষ মানুষ চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা করতে পিছপা হয় না। তারা সাত্ত্বিক মানুষকে ধর্মপথ থেকে বিচলিত করে। এই বক্তব্য গুলো একটিও হয়তো মিথ্যা নয়। কিন্তু তাদের গণিকাবৃত্তি বেছে নেওয়া, তাদের নগরনটী হিসাবে নিয়োগ করা, তাদের বিষকন্যা হিসাবে গড়ে তোলার পিছনে যে নারীপাচারের কাহিনী আছে তা কিন্তু সর্বত্রই উপেক্ষিত থেকে গেছে। 

       সমাজ বারাঙ্গনাদের অতীত নিয়ে বিশেষ ভাবিত নয়, তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়েও বিশেষ চিন্তিত নয়। কেবল মাত্র চাণক্য তাঁদের বৃদ্ধবয়সের জন্য কিছু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। সমাজ তাদের বর্তমানের রূপ, যৌবন, গুণ, উপভোগ করতেই ব্যস্ত। শুধু পুরুষ নয়, সমাজের নারীরাও এই ব্যবস্থাপনায় অভ্যস্ত। পুরুষ যদি বেশ্যালয়গামী হয়, বা কোন নগরবধুর মোহে আসক্ত হয়, সেই পুরুষের ঘরের মাতা বা স্ত্রী বা কন্যা সেই পুরুষের দোষ বিশেষ দেখে না, তারা সেই রূপপোজীবিনী মেয়েটির দোষ দেখে। সমাজের এই চিন্তাধারা আজও যৌনকর্মীদের অপাংক্তেয় করে রেখেছে। 

     একবার নারীপাচার হয়ে গেলে তাকে সমাজ ছুড়ে ফেলে দেয় যৌনপল্লীতে। পাচারকারীরা সমাজে দিব্যি বহাল তবিয়তে থাকে। পাচার হওয়া মেয়ে উদ্ধার হলেও, তাকে তার পরিবার ঘরে ফিরিয়ে নিতে চায় না। পরিবারের বক্তব্য- 'পাড়ায় মুখ দেখাতে পারবো না। আমার আরও কন্যা আছে, তাদের বিয়ে হবে না।' 

       সমাজের এই চিন্তাধারা গড়ে উঠেছে আমাদের পুরাণ, লোককথা, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের সহায়তায়। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আজও এই মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি আমাদের সমাজ। আজও ধর্ষিতা হলে মেয়েরা লজ্জায় মুখ লুকায়, ধর্ষক বীর দর্পে ঘুরে বেড়ায়। ধর্ষিতা মেয়ের চালচলন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। 

     সমাজের এই মানসিকতা যুগে যুগে নারীপাচার প্রক্রিয়াকে সজীব রেখেছে। 

তথ্য ঋণ:
১. স্কন্দপুরাণ (বিষ্ণুখণ্ড) – নবভারত পাবলিশার্স
২. কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র: সংক্ষিপ্ত অনুবাদ – সুকুমার শিকদার (অনুষ্টুপ)
৩. উইকিপিডিয়া