সকাল থেকে ব্যস্ততা। বড় জামাই আসবে। মেয়েও  আসবে।  কিছুদিন আগে বটকেষ্টর বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে কৃষ্ণনগরের পাশের গ্রামে ধননন্দ দাসের বড় ছেলের সঙ্গে। প্রথম জামাইষষ্ঠী ওদের। আর জামাই আসছে বলে কথা— চব্যচোষ্য তো খাওয়াতে হবে নাকি। সেই সকালবেলায় শাশুড়ি তার ছোট মেয়েকে নিয়ে গিয়েছেন রান্নাঘরে। জামাই আসছে! তৈরি করতে হবে হরেক পদ। জামাই আমার একটু খেতে ভালোবাসে। দাওয়ায় আজ সুন্দর করে আল্পনা দিয়েছেন শাশুড়ি মা। ষষ্ঠীর পুজো হবে। জামাইয়ের  মাথায় কুলোর হাওয়া দিতে হবে। অনেক আচার।

সকালবেলায় চা-টা খেয়েই বটকেষ্ট গেছে বাজারে। গিন্নি বলে দিয়েছেন, আজ তিনি মনের মতো করে খাওয়াবেন তার জামাইকে।

জামাই আমার লুচি খুব ভালবাসে। তাই এক ধামা লুচি ওর জন্য করা হয়েছে। সেই সঙ্গে অল্প মিষ্টি দিয়ে ছোলার ডাল। সঙ্গে গোটা ছয়েক কাঁচাগোল্লার সন্দেশ কাজকরা সাদা প্লেটে সাজিয়ে দেওয়া হবে। ঘরে রয়েছে মুর্শিদাবাদ থেকে আনা ওই দশ-বারোটা গোলাপখাস। সকালের  টিফিন এতেই হয়ে যাবে। বেশি দেওয়া যাবে না। শাশুড়ি মা ভাবছেন, এরপর তো বাড়ির কোণের গাছের মিষ্টি কাঁঠালটা আছে। ওটা রেখে দেওয়া আছে শুধু জামাইয়ের জন্য।

কাল রাতেই আবার বাড়িতে এসেছে বটকেষ্টর ছেলে জগন্নাথ। ছেলেটা প্রায় সব সময়েই কলকাতাতেই পড়ে থাকে। বিয়েও করেছে ওখানেই। যশোদা ভাবেন, ছেলেটা শহরে গিয়ে কেমন যেন হয়ে গেছে। কিছুই খেতে চায় না। কাল এসেছিল বাড়িতে। একরাত থেকে, অফিস আছে বলে বেরিয়ে যাচ্ছে। জামাইষষ্ঠীর দিনেও অফিস! জানিনা বাপু।

— “তুই অফিসে যাবি? শ্বশুরবাড়ি যাবি না?”

—বেসরকারি অফিসে কাজ করি মা! ওই সব জামাইষষ্ঠীর ছুটিফুটি আমাদের নেই।”

—তা বলে ষষ্ঠীর জল নিবি না? তোর শাশুড়ি তো না খেয়ে থাকবে।”

—কি বলছো মা। না খেয়ে থাকবে! কী ব্যাকডেটেড তোমরা। ওসব জামাইষষ্ঠী-টষ্ঠী ওই বাড়িতে হয় না। একটা হোটেলে সিট বুক করেছেন শ্বশুরমশাই। ওখানেই সবাই যাবো। ঠিক আছে, যাচ্ছি আমি। “

জগন্নাথ ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

—”ওরে খোকা দাঁড়া, আমার থেকে অন্তত ষষ্ঠীর জল নিয়ে যা।”

ছেলেটা ষষ্ঠীর জল পাবে না। মায়ের মন উতলা হয়ে উঠলো।  তাড়াতাড়ি করে একটা  হাতপাখা নিয়ে এলেন তিনি, সঙ্গে একটা ঘটি। ঘটির থেকে জল নিয়ে হাতপাখায় ঢাললেন। তারপর সেই হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে লাগলেন ছেলেকে। 

—”কী করছো তুমি! পুরো গা ভিজিয়ে দিলে! কী ব্যাকডেটেড তোমরা! আমি এখন আসছি।”

অফিসের দিকে রওনা দিল জগন্নাথ। ছেলেটাকে ওর শ্বাশুড়ি রান্না করেও খাওয়াবে না। হোটেল হবে জামাইষষ্ঠী! কী জানি কী দিনকাল পড়লো।  দুর্গা! দুর্গা! ছেলের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে একবার প্রণাম ঠুকলেন যশোদারানী।

একটু পরে একটা রিক্সা থেকে নামলো যশোদার বড়জামাই রঘুনন্দ।

—”ওরে তোদের দিদি জামাইবাবু এসেছে! তাড়াতাড়ি আয় সবাই।’’ বটকেষ্ট জামাইকে দেখে চিৎকার করে সবাইকে ডাকলো।

ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন যশোদারানী, আর তাঁর দুই মেয়ে।

—”যা যা জামাইবাবু আর দিদির থেকে জিনিসগুলি নিয়ে ঘরে রাখ।”

দুই শালী দৌড়ে গিয়ে রিকশা থেকে জামাইবাবুর আনা জিনিসগুলি নিয়ে ঘরের ভিতরে গেল। রঘুনন্দের এটা প্রথম জামাইষষ্ঠী। তাই সবার জন্য কিছু কিছু জিনিস নিয়ে এসেছে সে। সেই সাথে নিজেদের পুকুর থেকে ধরা কিলো চারেকের একটা কাতলা মাছ , বাড়িতে তৈরি বাঁশের চোঙার দই আর আসার পথে কৃষ্ণনগরে নেমে কিছুটা সরভাজা কিনে এনেছে, ওই কিলো দু’য়েক।

ওদিকে জগন্নাথকে ফোন করলেন তার শ্বশুরমশাই।

—”শোনো জগন্নাথ! তুমি দুপুরে অফিস থেকে দু’ঘণ্টার একটা ব্রেক নিয়ে রয়্যাল ইন-এ চলে এসো। আমি সুতপা আর ওর মাকে বলেছি। ওরাও চলে আসবে। ওখানে বসে আমরা মেনু ঠিক করে নেবো।”

যশোদারানী প্রথমে ঠিক করেছিলেন, জামাইকে দুধ পোলাও করে খাওয়াবেন। সেই মতো চেয়েছিলেন কালনা থেকে চাল আনতে। কিন্তু মেয়ের কাছে শুনেছেন, জামাই ধবধবে সাদা ভাত, সেই সাথে একটা গন্ধরাজ লেবু আর কচি পাঠার মাংস খেতে বড় ভালবাসে। তাই পোলাওটা তালিকা থেকে বাদ। প্রথমে থালায় দেবেন সাদা ভাত। একটু ঘি, ঘি-টা নিজের হাতেই বানিয়েছেন যশোদারানী। একটা কাঁচা লঙ্কা, একটু নারকেল কুড়ো। গরম ভাত, ঘি আর নারকেল কুড়ো দিয়ে মেখে একটা কাঁচা লঙ্কায় একটু কামড়, প্রথম পাতে ওটাই মেনু। ভালই লাগবে মনে হয় জামাই বাবাজীবনের। এরপর একদম হাল্কা ডাল করেছেন তিনি, মুগ ডাল। ডালের সাথে মুখে দিয়ে খাবার জন্য ঝিরি ঝিরি আলু ভাজা, লম্বা ডাটিওয়ালা বেগুন ভাজা, তোপসে মাছ ভাজা। আর একটু লালশাক ভাজাও করেছেন, ও বাড়িতে সবাই নাকি শাক ভাজা ভাল খায়।  তরকারির ঝুটঝামেলা আজ তেমন রাখেননি যশোদারানী। তবে কচুর শাক করেছেন। ইলিশমাছের মাথাটা ছিল। ওটা দিয়ে। ঝিমলির বাবা আবার ইলিশমাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক খেতে বড় ভালবাসে। ঝিমলি ! ঝিমলি হল বটকেষ্টর বড়ো মেয়ে। এদিকে যশোদারানী একটু চিন্তায় পড়েছেন।  কোন মাছটা আগে দেবেন।  চিতলের পেটির ঝাল, গলদা চিংড়ির মালাইকারি নাকি সর্ষে ইলিশ। এই তিন রকম পদ। তারপর পাঠার মাংস। পাঠার মাংসটা রান্না করা হয়েছে মাটির হাড়িতে কাঠের আগুনে। ওর স্বাদই আলাদা। মাংসের মধ্যে রান্নার সময় একটা গোটা টমেটো ফেলে দিতে হয়। ওনার মা আমাকে শিখিয়েছিলেন— মনে মনে ভাবলেন যশোদারানী।

অলংকরণে দীপঙ্কর ঘোষ

জগন্নাথ অফিস থেকে দু ঘণ্টার ছুটি ম্যানেজ করে ছুটলো রয়্যাল ইনে। দু-দু’বার ফোন করেছে সুতপা। শ্বশুর, শাশুড়ি, সুতপা সবাই চলে এসেছেন। শুধু জগন্নাথ এখনও এসে পৌঁছয়নি। আজ নাকি জগন্নাথকে অর্ডার দিতে হবে। ঠিক হয়েছে, আজ জগন্নাথ যেমন বলবে সবাই সেইরকম খাবে। রয়্যাল ইন শহরের সবচেয়ে নামজাদা হোটেল। আজ আবার এখানে জামাইষষ্ঠীর স্পেশাল মেনু হয়েছে। জগন্নাথ রেস্তরাঁয় পৌঁছে মেনু লিস্টটা নিজের হাতে তুলে নিলো। 

—”দেখো জগন্নাথ ! আজ তোমার পছন্দে আমরা খাবো। কী অর্ডার দেবে ভাবছো?

 শ্বশুরমশাই চেয়ারটা টেনে একটু দেখতে গেলেন জগন্নাথ কী কী মেনুর কথা ভাবছে।

—”কিছু একটা অর্ডার দিলেই হল! এক কাজ করুন, আমি একা কেন, সবাই মিলে অর্ডার দি।  স্টার্টারটা কি হতে পারে?”

—‘‘দেখো তোমার কিন্তু শরীর ভাল না, বুঝেশুনে অর্ডার দেবে।” সুতপা অর্ডার শুরুর আগেই সতর্ক করলো জগন্নাথকে ।

” এখানে কম অয়েলি কি খাবার  আছে ?”

জগন্নাথের শাশুড়ি বিপাশাদেবী জিজ্ঞাসা করলেন ওয়েটারকে ।

“গোল্ডেন প্রন ফ্রাই বলি!” -জগন্নাথ বড় ভালবাসে চিংড়ি মাছ ভাজা খেতে। বিশেষ করে এই রেস্তোরাঁয়।

—” তুমি প্রন খাবে! দু’দিন আগে না পেটের ব্যাথা হল। না ! চিংড়ি হবে না। তুমি ফিস ওরেলি অর্ডার করে দাও। তেল কম, আর তত স্পাইসি না।’’

গোল্ডেন প্রন ফ্রাই!— জগন্নাথের এক প্রিয় খাবার, সুতপার নির্দেশ বাতিল হল।

—”দেখো আজকে জামাইষষ্ঠী বলে ওরা জিরা রাইস মেনুতে রেখেছে। কি, জিরা রাইস নেওয়া যাক? জগন্নাথ এবার ঢুকে গেল মেইন কোর্স।

—‘‘দেখো, তোমার যা পারো নাও। তবে আমি কিন্তু শুধু একটা পাস্তা নেবো।’’ বিপাশাদেবী জানিয়ে দিলেন। তিনি আজ ইতালিতে আছেন, বাংলায় নেই।

যাই হোক, মেইন কোর্সে ঢুকে জগন্নাথ এক এক করে মেনুগুলি দেখতে লাগলো। বাবা! কত কিছু! কোনটা নেবো! ডাব চিংড়ি, মহারাজা ইলিশ, ছানার পাতুরি, চিকেন গ্রেভি, মটন।  কী কী অর্ডার দেব… ভাবতেই দিন কাবার জগন্নাথের।

—”তোমার দ্বারা হবে না। আমাকে দাও। শোনো, বেশি হ্যাংলামি করবে না। মটন হবে না। রেড মিট বন্ধ! চিকেন নাও। আর একদম ইলিশের কথা ভাববে না। ইলিশে তোমার গ্যাস হয়। ওটা বাদ। একটা লাইট মাছ। তুমি বরং একটা কাতলা ফ্রাই নিয়ে নাও। আর ডেজার্টে ম্যাংগো আইসক্রিম। বেশ এইটুকু। শরীর নিয়ে সাবধান হও।’’ নিজেই মেনু ঠিক করে দিল সুতপা।  

এদিকে সমস্ত আচার সেরে রঘুনন্দ আর বটকেষ্ট বসেছেন দুপুরের খাবার খেতে। না, টেবিল চেয়ারে নয়। একবারে মেঝেতে বাবু হয়ে বসে।  দু’টি জামদানি কাঁসার থালা। এতটাই বড় যেন মনে হচ্ছে , এপাশ-ওপাশ হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে না। থালার মাঝখানে বাটিতে ভাত চেপে বসিয়ে দিয়েছেন যশোদারানী। পুরো থালাটার মাঝখানে ওই উল্টানো বাটির ভাত, তার উপরে একটা কাঁচা লঙ্কা, পাশে অল্প ঘি আর একটু নারকেল কুড়ো। থালার চারপাশটা অসংখ্য বাটি আর প্লেট  দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন যশোদারানী। প্রতিটি পাত্রে ভিন্ন স্বাদের ব্যঞ্জন। তিন রকমের মাছ, পাঠার মাংস, আমের চাটনি, ঝুরো পাঁপড় , মিঠাই, মিষ্টি দই, পোস্ত মিষ্টি, রসগোল্লা সব দিয়েছেন। দেখতে ভারী ভাল লাগছে। রঘুনন্দ খেতে ভালবাসে। সামনের থালাটা দেখে খুশিতে ভরে উঠলো মনটা। তার প্রথম জামাইষষ্ঠীর খাওয়া। তবু ভাবল, এতো খেতে পারবো ? জামাইবাবাজির একপাশে বটকেষ্ট ও অন্যপাশে যশোদারানী। যশোদারানী হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করছেন জামাইকে। আর রঘুনন্দ মন দিয়ে একটার পর একটা বাটি ঢেলে নিচ্ছে নিজের থালায়।

—”তাহলে খাওযা কমপ্লিট! জামাই কী ঠিকঠাক! শোনো, আজকে অনেক কিছু খাওয়া হয়ে গেছে। একটা করে ফ্রেশ লাইম সোডা ওয়াটার নেওয়া যাক। পুরোটা হজম হয়ে যাবে। কোনও অসুবিধা হবে না। খাওয়াটা একটু হেভি হয়ে গেল আজকে ” একটা মৃদু ঢেকুর তুলে বললেন জগন্নাথের শ্বশুরমশাই। 

—”বলেছিলাম তোমাকে, বেশি কিছু খেও না। এই বাঙালিখানা, এতো রিচ সহ্য হয় নাকি। এই দেখো, আমি কেমন পাস্তা খেয়ে নিলাম। শোনো জগন্নাথ, আনইজি ফিল করলে একটা এন্টাসিড চিবিয়ে নিও। আর তোমাকেও বলিহারি, জামাইষষ্ঠী তো কী! বাইরে খেতেই হবে। দিন দিন তুমি যে কী হয়ে যাচ্ছ—বিপাশা দেবী পাস্তার থালাটা ঠেলে দিয়ে ন্যাপকিনে মুখ মুছতে মুছতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন।

—” কী জামাই কিছুই তো খেলে না? ওই দেখো, তুমি তো মাংস খেলেই না। আর একবার মাংস দি।

—” না মা ! আর না! বেশ খেয়েছি। দেখুন সব বাটি ফাঁকা। আর ভাবছেন কেন, রাতেও তো খাবো। এবার উঠি মা। রঘুনন্দ খাবার থালাটাকে প্রণাম করে উঠে পড়লো।

—” এই বুড়ি, জামাইবাবুকে একটু নদীর পাশে নিয়ে গিয়ে বসা। হাওয়ায় বসে বিশ্রাম করুক। আমি যাই বিকেলের খাবারের ব্যবস্থা করতে।’’

না! জামাইটা বড় ভাল। খেতে পারে— মনে মনে ভাবলেন যশোদারানী।

রঘুনন্দ শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে শালীর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গেল নদীর পাশে। শালী একটা মাদুর নিয়ে এসেছে। ওটা বিছিয়ে দিল একটা গাছের তলায়। রঘুনন্দ টানটান হয়ে শুয়ে তাকিয়ে থাকলো নদীর দিকে। কাল সকালে আবার রওনা দিতে হবে বাড়িতে। আবার বসতে হবে চালের আড়তে। সারাদিন ধরে কতো সব কাজ।

এদিকে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে জগন্নাথ সামনের দোকান থেকে একটা এন্টাসিডের স্ট্রিপ কিনে রওনা দিল অফিসের দিকে। আবার অফিস। ভাবলো, অনেকগুলো ফাইল পড়ে রয়েছে। আজকের মধ্যেই ছেড়ে দিতে হবে।

কেটে গেল জামাইষষ্ঠীর একটা দিন। দু’দিকে দু’রকম ভাবে। একটি ছবি গ্রাম বাংলার। অন্যটি কলকাতা শহরের কর্মব্যস্ততার। রঘুনন্দ পালন করলেন জামাইষষ্ঠী একেবারে বিধিবদ্ধ আচার মেনে। জগন্নাথ এখন শহুরে লোক। তাঁর আদবকায়দায় শহুরেপনা। এত আচার বিচার না মেনে সে-ও পালন করেছে জামাইষষ্ঠী।

একটা গেট টুগেদার। একসাথে। শ্বশুর শাশুড়ির সাথে কিছুক্ষণ। কিছু মুহূর্ত ! কিছু ভাল লাগা। কিছুটা আদর। কর্মব্যস্ততার মধ্যে ক্ষনিকের আনন্দ।