akashbani banipur

(বাণীপুর লোক উৎসবের কথা সবাই জানে। জনপ্রিয় সেই উৎসবেই একবার হানা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল। লোক উৎসবে তৈরি অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র তখন সাড়া ফেলে দিয়েছে আশপাশের এলাকায়। তখন টেলিভিশন চ্যানেল, ইউটিউবের দাপাদাপি ছিল না। এলাকায় বেতার কেন্দ্রও সেই প্রথম। সব মিলিয়ে হইহই ব্যাপার। কিন্তু কলকাতার একটি কাগজের রিপোর্ট আবহাওয়া পাল্টে দিল। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল এসে পৌঁছল উৎসবের প্রাঙ্গনে। লিখেছেন সাংবাদিক সুকুমার মিত্র।)

আকাশবাণী। শব্দটা উচ্চারণে অনেকে আজও নস্টালজিক হয়ে পড়েন। আর তা যদি হয় আকাশবাণী, কলকাতা তাহলে তো কথাই নেই। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি সর্তক হয়ে কান পেতে থাকতেন। বেতারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ভবেশ দাশ, ইভা নাগ, নীলিমা সান্যাল, প্রদীপ ঘোষ, পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, প্রণবেশ সেন, উপেন তরফদার-এর সংবাদ বিচিত্রা, সংবাদ পরিক্রমা, প্রদীপ ভাই-এর কৃষিকথার আসর, বিজ্ঞান রসিকের দরবার, অনুরোধের আসর, সন্ধ্যায় যাত্রা, তরজা, নাটক, বোরোলীনের সংসার, সুচিত্রার সংসার, গল্পদাদুর আসরকে ঘিরে বাঙালির কত না আলোচনা। পরবর্তীতে বিবিধ ভারতীর সম্প্রচার বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। আকাশবাণী (Akashvani) কলকাতা-ক, খ, বিবিধ ভারতীর অনুষ্ঠান কোনওটাই উপেক্ষা করার মতো ছিল না। বেসরকারি চ্যানেল ও ওয়েব দুনিয়ায় রমরমার পর আকাশবাণী-র সেই জৌলুস আজ আর নেই, একে ঘিরে বাঙালির সেই উন্মাদনাও হারিয়ে গিয়েছে। যুগের হাওয়ায়, কর্পোরেট সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা বেতার কেন্দ্রগুলি তাদের অনুষ্ঠান পরিবেশনায় বৈচিত্র্য আনলেও বেতার দুনিয়ায় বিংশ শতাব্দী জুড়ে আকাশবাণী-র ছিল একচেটিয়া দাপট। প্রকাশিত হতো পাক্ষিক ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকা। শারদীয় ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকা কেনারও হিড়িক ছিল। পুজোর গান কে কে গাইছেন— তা নিয়ে ছিল জোর চর্চা।

ভারতে বেতার সম্প্রচার শুরু হয় ১৯২৭ সালে বোম্বাই এবং কলকাতায় দুটি ব্যক্তিগত ট্রান্সমিটার দিয়ে। ১৯৩০ সালে এর জাতীয়করণ করা হয় এবং তারপরে এটি ভারতীয় সম্প্রচার পরিষেবা (ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন) নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে এর নাম পরিবর্তন করে ‘আকাশবাণী’ (Akashvani) করা হয়। বর্তমানে এটি প্রসার ভারতীর অধীনে। মাঝে আর চারটি বছর পেরলেই ভারতে বেতার সম্প্রচারের শতবর্ষ শুরু হবে। না, ইতিহাসের কাসুন্দি ঘাটা নয়, আঞ্চলিক ইতিহাসের একটি বিস্মৃত খণ্ডচিত্র তুলে ধরার জন্যই আকাশবাণী-নিয়ে এত কিছুর অবতারণা।

আকাশবাণীর সঙ্গে আমার পরিচয় সংবাদ বিভাগে নানা অনুষ্ঠানের আগাম খবর প্রভাতী অনুষ্ঠানে সম্প্রচারের জন্য পৌঁছে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে। কয়েকবার কয়েকটি খবর লিখে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ইডেন গার্ডেনের ওই ঐতিহ্যবাহী বাড়িতে যাতায়াত। পরে নব্বইয়ের দশকে যুববাণীতে কয়েকটি আলোচনায় যোগ দিয়েছি। কিন্তু আকাশবাণীর (Akashvani) ভিতরে সম্প্রচারের স্টুডিও তখনও আমার কাছে অজানা, অধরা। ১৯৮৮ সালের শেষের দিকে কোলাঘাটে এক মেলায় পরিচয় হল পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমারের বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সদস্যদের সাথে। তাঁরা ওই মেলায় অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র তৈরি করে বিজ্ঞানের জয়যাত্রার কথা মানুষদের বোঝাচ্ছিলেন। সেখানেই পরিচয় সুখেন্দু কুইতি, তমলুকের কাকগেছ্যার নির্মল, কালীকিঙ্কর কুণ্ডুদের সাথে। প্রথম পরিচয়ে হয়ে গেল বন্ধুত্ব। ওদের বললাম, নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে এটাকে আরও আকর্ষণীয় করা যেতে পারে। ওঁরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা আমরা বিজ্ঞান ক্লাব করি। ওইসব আমাদের দিয়ে হয়? হ্যাঁ, বিজ্ঞান ক্লাব হিসেবে ওরা কাঁথির গান্ধী মেলায় দূরদর্শন কেন্দ্রও করেছিল— সেকথা ওদের কাছেই শুনেছি। তবে বেতার কেন্দ্র তুলনামূলক কম ব্যয়ে করা যায়— তাই বিভিন্ন জায়গায় সেটাই তাঁরা করে থাকেন। আমি শুনেছিলাম, বাণীপুর লোক উৎসবে (Banipur lok utsav) পঞ্চাশের দশকের শেষে ক্লোজ সার্কিট টিভি সরকারি উদ্যোগে বসানো হয়েছিল। যতদুর জানি, অধ্যাপক প্রফুল্ল হোড়রায়ের উদ্যোগে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সেটি করা হয়। পাশেই অশোকনগরে ১৯৭৫ সালে রক্তরবি সব পেয়েছির আসরের রজতজয়ন্তী বর্ষের অনুষ্ঠানে ডেমনেস্ট্রেটিভ রেডিও স্টেশন হয়েছিল। খুব কাছ থেকে সেই রেডিও স্টেশন দেখা বা বোঝার কোনও উপায় ছিল না। অনুষ্ঠানে এত মানুষের ভিড় হয়েছিল তাই সেই সুযোগও ছিল না। কোনও মতে দেখা— এর বেশি কিছু না।

কোলাঘাটের মেলায় নন্দকুমার বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সদস্যদের বললাম, বাণীপুর লোক উৎসবে (Banipur lok utsav) টানা আট দিনের অনুষ্ঠানে আসতে হবে। আনুষ্ঠানিক ভাবে লোক উৎসব-এর কর্তাদের সাথে কথা না বলেই প্রস্তাব দিলাম। ভরসা ছিল, শান্তনু দত্তচৌধুরী, নীহার ঘোষদের বললে তাঁরা নিশ্চিত রাজি হয়ে যাবেন। ১৯৮৯ সালে বাণীপুর লোক উৎসবে (Banipur lok utsav) অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র তৈরি হল। তার আগে রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের অনুমতি নিতে হয়। আর ঘোষণা দিতে হয়, আকাশবাণীর কোনও কেন্দ্রের সম্প্রচার ব্যাহত হয়— এমন ফ্রিকোয়েন্সিতে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হবে না। আর আকাশ পথে তিন কিলোমিটার পরিধির এলাকায় সম্প্রচার সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এসব বিধি মেনেই বাণীপুর লোক উৎসব অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র তৈরির ছাড়পত্র পেল। সেই ছাড়পত্র পৌঁছে দিয়ে এলাম নন্দকুমারে গিয়ে। ওরা ম্যাটাডর ভর্তি সরঞ্জাম নিয়ে বাণীপুরে মেলার (Banipur lok utsav) একদিন আগেই এসে হাজির। জনতা হলের উল্টোদিকে বড় বড় শিরিষ গাছের ডগায় বাঁশ বেঁধে অনেক উঁচুতে টাওয়ার সেট করার জন্য পর্বতারোহী বন্ধু মনিরুল হককে বিড়া নারায়ণপুর থেকে ডেকে আনা হয়েছিল। বেশি রাতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সেই সব কাজ চলছিল। উৎসব কমিটির সভাপতি প্রণব ভট্টাচার্য, মানিক বক্সীরাও বেশ কৌতূহলী ছিলেন শেষ পর্যন্ত কি হতে যাচ্ছে তা বোঝার জন্য। মেলার কর্মকর্তা অশোক চক্রবর্তী এসব কাজের মাঝে বলে উঠলেন— ও তেমন কিছু হবে না- বড়জোর টুংটাং শব্দ শোনা যেতে পারে।

আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সেই অস্থায়ী বেতার কেন্দ্রের নামকরণ আমিই করলাম— ‘আকাশবাণী বাণীপুর’ (Akashvani )। লোক উৎসব উদ্বোধনের (Banipur lok utsav) আগের দিন বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সদস্যরা কারিগরী দিক সব দেখে শুনে জনতা হলের বিপরীতে গোটা তিনেক ঘর নিয়ে তৈরি করল বেতার কেন্দ্র। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের জনা সাতেক সদস্যের থাকার জন্য আরও দু’টো ঘর দেওয়া হল। আমি, নিরঞ্জন মিত্র, জনার্দন ঘোষ ছাড়াও বাণীপুরের আরও কয়েকজন মিলে বেতার জগৎ-এর আদলে আকাশবাণী বাণীপুরের অনুষ্ঠানসূচি তৈরি করলাম। নাম দেওয়া হল, বেতার জগৎ। লোক মুখে মুখে আমি হয়ে গেলাম অস্থায়ী বেতার কেন্দ্রের অধিকর্তা। আর বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে এক জোড়া ওয়াকিটকি সেট বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সদস্যরা নিয়ে এসেছিলেন প্রদর্শনের জন্য বা কাজের সুবিধার জন্য। কিন্তু লোক উৎসব কমিটির সম্পাদক নীহার ঘোষ সেটার দখল নিলেন। একটা সেটের বাকিটা কখনও কেষ্টা সাহা (কেষ্টাদা বেঁচে নেই), কখনও শুভেন্দু দত্তর (শুভেন্দুও অকালে চলে গিয়েছে) কথোপকথনের জন্য ব্যবহার হয়েছিল। সেই সব কথাবার্তার সঙ্গে উৎসব কমিটির বা মেলা সংক্রান্ত কোনও বিষয় যুক্ত ছিল না। সেই ওয়াকিটকির সঙ্গে হাবড়া থানার টহলদারি পুলিশের জিপের ওয়ারলেসের সংযোগও ঘটতো। নীহারদা, কেষ্টাদা, শুভেন্দুদের কথোপকথন পুলিশের কাছে মজার খোরাক ছিল। ওয়াকিটকি হাতে কয়েকটা দিন এঁরা তখন একটু অন্য মেজাজ পেয়েছিলেন। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সদস্যরা বুঝে গিয়েছিলেন, আটদিনের জন্য ওই ওয়াকিটকি সেট তাঁদের হাতছাড়া।

আকাশবাণী বাণীপুর-এর জন্য বাণীপুরে বুনিয়াদী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুটি প্রার্থনা সংগীতের একটি বেছে নেওয়া হল সকাল সাতটায় বেতার কেন্দ্রের সূচনা পর্বের সংগীত হিসেবে। আর একটি রাত ১১ টায় অনুষ্ঠান শেষে সমাপ্তি সংগীত হিসেবে। আটদিন টানা ১৬ ঘণ্টার নানা অনুষ্ঠানে সহস্রাধিক মানুষের অংশ গ্রহণে ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল বৃহত্তর হাবড়া ছাপিয়ে বারাসত, বনগাঁ, বসিরহাট মহকুমা এমনকি বাংলাদেশের যশোর, সাতক্ষীরা পর্যন্ত। তিন কিলোমিটারের অনুমতি ভুলে প্রথম থেকেই আকাশপথে ত্রিশ কিলোমিটার পরিধি জুড়ে সম্প্রচার হতে শুরু করে। অনুরোধের আসর-এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘গানের ভুবন’। গান শোনার আর্জি জানাতে পাঁচ হাজার ছাপানো পোস্টকার্ড দু’দিনেই বাণীপুরের গোলঘর থেকে বিক্রি হয়ে গেল। তখন পোস্টকার্ডের দাম সম্ভবত পাঁচ পয়সা, সেসব বিক্রি করা হয়েছিল ২৫ পয়সায়। বাণীপুর পোস্ট অফিসের পোস্টম্যানের হাত ঘুরে ওই পাঁচ হাজারের সঙ্গে আরও হাজার পাঁচেক পোস্টকার্ড ফিরে এল বাণীপুর লোক উৎসবের অস্থায়ী বেতার কেন্দ্রে। এর বাইরে সরাসরি উৎসব কমিটির তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক প্রণব ভট্টাচার্য, শান্তনু দত্ত চৌধুরী, নীহার ঘোষদের কাছে অনুরোধ আসতে লাগল— তাঁদের ছেলে, মেয়ে, বউদের বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠানের সুযোগ করে দিতে হবে। লোক উৎসব-এর উদ্যোক্তারা ওইসব অনুরোধে এতটাই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন যে বলতেন— বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠান সম্প্রচার হবে এমন ধারণাই তাঁদের ছিল না। তাঁরা ভেবেছিলেন, বিজ্ঞানের মডেলের মত কিছু একটা হয়তো হবে। বসু বিজ্ঞান মন্দির-এর সদস্যরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন, ‘এত শিল্পী বাঙাল এলাকায় থাকে’! বেচারারা অনুষ্ঠান সম্প্রচারের দিকটি ঠিকঠাক রাখতে গিয়ে বাইরে বিশাল উৎসবের আমেজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। এই কারণে আমার উপর কিছুটা অসন্তুষ্টও ছিল। একদিন তো বলেই ফেললেন, তাঁদের থেকেও ঢের বেশি পাগলের পাল্লায় পড়ে তাঁরা বাণীপুর লোক উৎসব বেতার কেন্দ্র করতে এসে পড়েছেন। এদিকে বেতার কেন্দ্রের যে ব্যয়, তা তোলার জন্য শিবু ঘোষ প্রস্তাব দিলেন, অনুষ্ঠানের এক একটি পর্ব যদি এক একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সৌজন্যে বলে সম্প্রচার করা হয়, তাহলে বেতার কেন্দ্রের ব্যয় সেখান থেকে উঠে আসতে পারে। উৎসবের বাজেটের দিকে তাকিয়ে সেই প্রস্তাবে কে আর আপত্তি করে।

লোক উৎসব উদ্বোধনের দিন সকালে আকাশবাণী বাণীপুর-এর সম্প্রচার শুরু হতেই শোরগোল পড়ে গেল বৃহত্তর হাবড়া এলাকায়। এদিকে নিরঞ্জন মিত্র (এখন আর আমাদের মধ্যে নেই) বেতার জগৎ-এর সূচি অনুযায়ী দলে দলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসা শিল্পী ও আলোচকদের নিয়ে স্টুডিও-র বাইরে একটা ঘরে বসে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির কাজ সারছেন। অধিকাংশ অনুষ্ঠান ছিল সরাসরি সম্প্রচার আর কিছু স্টুডিওতে রেকর্ড করা অনুষ্ঠানের সম্প্রচার। পেশায় শিক্ষ‌ক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংবাদিক নিরঞ্জনদা অপেক্ষায় থাকতেন লাইভ অনুষ্ঠানের শিল্পী বা আলোচকেরা যদি নির্ধারিত সময়ে এসে হাজির না হন সেই ফাঁকে নিজের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করার। নিরবিচ্ছিন্ন সম্প্রচার বজায় রাখতে এতে বেশ সুবিধাই হয়েছিল। অশোকনগরের কমলেন্দু ভট্টাচার্য অনুষ্ঠানের অন্যতম ঘোষক ছিলেন। তবে বেশির ভাগ অনুষ্ঠানের ঘোষণা করতেন নিরঞ্জনদা। মেলা পরিক্রমা করার জন্য গড়িয়া থেকে স্কুল শিক্ষক প্রদ্যোৎ সেন দুপুরে এসে হাজির হতেন। টেপরেকর্ডার নিয়ে মূল মঞ্চ, দক্ষিণ মঞ্চ, বাউল মঞ্চ, জনতা হল, প্রদর্শনী ও মেলা প্রাঙ্গন ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জনের প্রতিক্রিয়া রেকর্ড করে এনে দিতেন। উৎসব কমিটির কর্মকর্তাদের তিনি ব্যাক্তিগত ভাবে চিনতেন না। তাই অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের কাজের ব্যস্ততার মধ্যে ‘মেলা কেমন লাগছে’ প্রতিক্রিয়া চেয়ে প্রদ্যোৎদা ধমকও শুনেছেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি। বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় গানের অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘এ শুধু গানের দিন’। আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা নিয়ে হাবড়াকে ঘিরে কর্মকাণ্ড বহু আগেই ছিল। তাই আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মাটির পুরাণ’। আটদিন ধরে ৫০টির বেশি শিরোনামে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল ওই বছর লোক উৎসবের অস্থায়ী বেতার কেন্দ্রে।

তৎকালীন জেলা পরিষদের সভাধিপতি নন্দদুলাল ভট্টাচার্য বেতারে ভাষণ দিয়ে খুব খুশি। পরে আর একদিন এসেছিলেন স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে। একই ঘটনা হয়েছিল বারাসতের তৎকালীন মহকুমাশাসকের ক্ষেত্রেও। তিনি বললেন, জীবনে প্রথম বেতার ভাষণ দিলাম আর আমার স্ত্রী শুনতে পেলেন না। আমি যদি আর একদিন ওনাকে নিয়ে আসি, আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেবেন? আমরা তো বেশ খুশি। সস্ত্রীক আসতে বললাম মহকুমা শাসককে। তিনি অস্থায়ী বেতার কেন্দ্রের স্টুডিওতে বক্তব্য রাখছেন। মহকুমা শাসকের স্ত্রী মেলা প্রাঙ্গনে বসে রেডিওতে তাঁর ভাষণ শুনছেন। অনুষ্ঠান শেষে মহকুমা শাসক স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি সত্যি তাঁর বেতার ভাষণ শুনতে পেয়েছেন কিনা। তিনি ‘হ্যাঁ’ বলায় মহকুমা শাসকের মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়েছিল। এসব মাত্র তেত্রিশ বছর আগের কথা। তখন অজস্র চ্যানেল আর ইউটিউবের দাপাদাপি ছিল না।

‘আকাশবাণী বাণীপুর’-এ সবই ঠিকঠাক চলছিল। উৎসবের কয়েকদিনের মধ্যেই স্টুডিওতে এসে হাজির হলেন হাবড়ার একটি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক। তিনি কবি। পেশায় সরকারি কর্মচারী হলেও ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবেও কাজ করতেন। তাঁর আব্দার, সেই মুহূর্তে তাঁর স্বরচিত কবিতা সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে। এতই টাইট প্রোগ্রাম ছিল যে সেটা সম্ভব ছিল না। তাঁকে বলি, একটা নয়, আপনি তিনটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করুন। আমরা রেকর্ড করে রাখছি। ফাঁক পেলে সম্প্রচার করে দেব। তিনি তাতে রাজি নন। তাঁকে সেই মুহূর্তেই সুযোগ দিতে হবে। আমাদের অসুবিধার কথা তিনি কিছুতেই মানতে রাজি হলেন না তিনি। ক্ষিপ্ত হয়ে পরের দিন ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় ‘আকাশবাণী বাণীপুর’ (Akashvani Banipur)-এর তোরণের ছবি-সহ একটি সংবাদ প্রকাশ করলেন। সীমান্তবর্তী এলাকায় এই ধরনের অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র দেশবিরোধী শক্তিকে মদত দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। তাছাড়া, বিজ্ঞাপন নেওয়া হচ্ছে বিধি না মেনে। সর্বোপরি ‘আকাশবাণী’ নামটি ব্যবহার করার অধিকার কোথা থেকে পেয়েছে লোক উৎসব কমিটি? এইসব ভারি ভারি প্রশ্ন তুলে সংবাদ। কিন্তু কোথাও অস্থায়ী বেতার কেন্দ্রের পরিচালকদের বা লোক উৎসব কমিটির কর্তাদের বক্তব্য ছাপা হল না।

সেই সংবাদ প্রকাশ হতেই তিন সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল বিকেলে বাণীপুর লোক উৎসব প্রাঙ্গনে হাজির। তারা সম্পাদক নীহার ঘোষ, শান্তনু দত্ত চৌধুরী, সভাপতি অধ্যাপক প্রণব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করলেন। মেলার কর্মকর্তারা জানিয়ে দিলেন, এ বিষয়ে যা বলার উৎসব শেষ হওয়ার পরেই বলবেন। তবে একই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক অনুমতি নিয়েই অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র করা হয়েছে। তদন্তকারী দলটি বেতার কেন্দ্রে এসে আমার ও বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সদস্যদের কাছে কারিগরি বিষয়ে দু-চার কথা জানতে চাইলেন। তারপর আমাকে বললেন, ‘আকাশবাণী’ নাম ব্যবহার করতে পারেন? আমি বলেছিলাম, যশোর রোডের উপর নগরউখরা মোড়ে ছেলেবেলা থেকে দেখছি রেডিও-র দোকানের নাম আকাশবাণী। তাঁরাও তো ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছে বহু বছর ধরে। একেবারে ‘আকাশবাণী’ নামের প্রতি নস্টালজিয়া থেকেই নামকরণ করা হয়েছে। কোনও অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে নয়।

এদিকে, সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় উৎসব কমিটি কতটা বিপাকে পড়েছে— তা আঁচ করার জন্য সন্ধেবেলায় সেই কবি ঘুরে ঘুরে মেলা দেখছেন আর কর্মকর্তাদের হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছেন। একবার অস্থায়ী বেতার কেন্দ্রে এসে আমাকে ডেকে বলে গেলেন, ‘‘বুঝবে, খবরের জের সামলাতে পারবে তো?’’ সেদিন কোনও কথার উত্তর আমি তাঁকে দিইনি। প্রায় ১৮ বছর পর বনগাঁ লোকালে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমার কাজকর্মের অনেক প্রশংসা করলেন। সৌজন্য দেখিয়ে ভালমন্দ নানা খবর নিলেন। মনে হয়েছিল, কলমের অপব্যবহার করা যে ঠিক নয়, সেটা তিনি পরে হয়তো উপলব্ধি করলেও করতে পারেন। সম্প্রতি তিনি মারা গিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর খবরে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

এদিকে, নন্দকুমার বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সদস্যরা ওই ঘটনায় শিঁটিয়ে গিয়েছিল। পরে একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘‘যত সমস্যা এইসব ‘বাঙাল’ অধ্যুষিত এলাকায়। আমাদের মেদিনীপুরে রেডিও, টিভি সব করি। কোনও দিন এসব ঝামেলায় পড়তে হয়নি। আর এত কবি বসবাস করে হাবড়া, অশোকনগর, বাণীপুরে জানলে আমরা আসতাম না।’’ নন্দকুমার বসু বিজ্ঞান মন্দির সিদ্ধান্ত নেয়, তাঁরা আর অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র বা দূরদর্শন কেন্দ্র তৈরি করে ঝামেলার ভাগীদার হবে না। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দলের আধিকারিকরা তারপর কয়েকবার বাণীপুরে এসেছেন। এসে বুঝেছেন, সংবাদটি নিছকই প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে করা হয়েছিল। তাঁরা নিজেদের রিপোর্ট দিয়ে ফাইল ক্লোজ করেন। সেই পর্বের ঝামেলা থেকে মুক্তি পায় বাণীপুর লোক উৎসব কমিটি।