ভারতে এর চেষ্টা শুরু হয়েছে এবং দৃঢ় পদক্ষেপে এগোচ্ছে।

সুবীর বিশ্বাস

বেহালা ফ্লাইং ক্লাবের পাশ দিয়ে গড়ি চালিয়ে অঙ্কিত ফিরছে। সময় পেলেই সে এদিকে আসে। ছেলে সরকারি চাকরি করছে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সাংসারিক সব কিছু দেখভালে স্ত্রী, হাঁটু বদলে পর ভালই চলাফেরা করেন। সবাই যে যার মত মহাব্যস্ত। অঙ্কিত যেন একাকিত্বের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। অঙ্কিত গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ে। এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ লাগে। কত স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। অঙ্কিতের পাইলট শিক্ষা এখানেই। তারপর ১৯৯৪ সাল থেকে ইনস্টিটিউট বন্ধ। পাইলট ইনস্ট্রাকটর চলে যাওয়ার পর রাজ্য সরকার আর খুলতে পারেনি।

অবশ্য খুলেও লাভ ছিল না। কিছুদিনের মধ্যেই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটত। আর হবেই না বা কেন? বিশ্বের অতবড় দুই বিমান নির্মাণ কোম্পানি—বোয়িং আর এয়ারবাস, তারাই লাটে উঠতে চলেছে। বিশ্বের তাবড়-তাবড় ফ্লাইং ক্লাব এখন বন্ধ, এয়ার লাইন্সগুলি উঠে যাওয়ার মুখে। অঙ্কিত স্বপ্নে ডুব মারে। কোথা থেকে যে এই নতুন প্রযুক্তি এল— সব ওলট-পালট করে দিল। সত্যিই কি এরকম হতে যাচ্ছে? পাইলট, এয়ারহোস্টেজ, তৈরি-রক্ষণাবেক্ষণ ইঞ্জিনিয়ার সবার চাকরি শেষ? শুধুমাত্র সামরিক বিমানবাহিনী ছাড়া আর কোনও সিভিল প্লেন থাকবে না?


হ্যাঁ। সেদিন সুদূর নয় আর। বিজ্ঞান যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে ২০৩৫-এর পর হয়তো এমনটাই হতে চলেছে। এসে যাচ্ছে পঞ্চম মোডের (রাস্তা, রেল, জল, আকাশ— চার মোড বাদে) হাইপারলুপ পড (Hyperloop Pod) পরিবহন ব্যবস্থা। যা বিমান পরিবহনকে সেকেলে করে দেবে। ১/৪ ভাগ সময়ে ১/৪ ভাগ খরচে ৪ গুণ স্পিডে পৌঁছে যাওয়া যাবে গন্তব্যে। গতির জগতে হাইপারলুপ কী এমন ব্যবস্থা, যা সবকিছুকে থমকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে? ব্যাপারটা একটু দেখে নেওয়া যাক।


হাইপারলুপ পডগুলি (Hyperloop Pod) মোটামুটি ভাবে ১২০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা— অর্থাৎ শব্দের বেগ বা ম্যাক১ বেগে চলবে। জাপানের বিশ্ব শ্রেষ্ঠ সিনকানসেন (Shinkansen) বুলেট ট্রেনটির সর্বোচ্চ বেগ ৩২০ কিমি/ঘণ্টা। আর এখনও পর্যন্ত প্রযুক্তির শেষতম সংযোজন— ভূমি থেকে সামান্য উঁচুতে ভেসে চলা এস সি ম্যাগলেভ ট্রেন (Maglev)। তারও বেগ ৬৫০কিমি প্রতি ঘণ্টা। সাধারণ যাত্রিবাহী বিমানের বেগ ৭০০-৮০০ কিলোমিটারের মতো, ড্রিমলাইনার বোয়িং ৭৪৭ অবশ্য সর্বোচ্চ ১০০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা তুলতে পারে। তবে যুদ্ধবিমানগুলি ১.৮ থেকে ২.৫ ম্যাক পর্যন্ত স্পিডে যেতে পারে। আবার অধুনা এসেছে হাইপারলুপ মিসাইল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইতিমধ্যেই রাশিয়া তা ব্যবহার করেছে। যাদের স্পিড ম্যাক ৪ থেকে ম্যাক৮ পর্যন্ত। ভারতও এই মিসাইল পরীক্ষা করেছে। অসামরিক ক্ষেত্রের পরিবহণে কিন্তু এস সি ম্যাগলেভের ৬৫০ কিমি/ঘন্টাই এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ বেগ (বাস্তবায়িত হবে ২০২৭ সালে) হাইপারলুপ এর দ্বিগুণ স্পিড অর্জন করল কী ভাবে? আসলে বুলেট ট্রেনের হাইস্পিডের বাধা দুটি। এক, লাইন ও চাকার ঘর্ষণ। দুই, বায়ুর বাধা (সান্দ্রতাজনিত বাধাবল)। আর প্লেনের রয়েছে দ্বিতীয়টি। এই বাধাগুলি অতিক্রম করতেই জ্বালানির সিংহভাগ খরচ হয়। অথচ এই দুই বাধা থেকে হাইপারলুপ মুক্ত।


কী ভাবে? এক, ম্যাগলেভ (Maglev) সিস্টেমে শূন্যে ভেসে চলে। ফলে সে ঘর্ষণমুক্ত। আবার ভ্যাকুয়াম টিউবের মধ্যে দিয়ে যায় বলে বায়ুর বাধা সামান্য। তাই ১২০০কিমি/ঘণ্টা কেন তারও বেশি স্পিড তুলতে এর কোন পিছুটান নেই। ফলে জ্বালানিও পোড়ে খুবই কম। সেই সঙ্গে সম্পূর্ণ দূষণহীন। যে কোন পরিবহণের খরচ মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত। এক তো পরিষেবা। দুই রক্ষণাবেক্ষণ। সবচেয়ে বেশি খরচ তৃতীয়টির— অর্থাৎ জ্বালানির। এইখানেই হাইপারলুপ সবাইকে টেক্কা দেবে। বাধা প্রায় শূন্য বলে খুবই কম জ্বালানি খরচ। তা-ও টিউবের উপর সোলার সেল বসালে পুরোপুরি সবুজ জ্বালানি।


জনসমক্ষে এই প্রকল্প প্রথম নিয়ে আসেন আমেরিকার ধনকুবের এলন মাস্ক, ২০১৩ সালে । টেসলা, স্পেসএক্স এবং সর্বশেষ এক্সের মালিক। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, মাস্ক এটিকে সম্পূর্ণ ওপেন প্রোজেক্ট হিসেবে নিয়ে এসেছেন। যে কেউ এটি দেখে তাদের দেশের উপযোগী করে এগোতে পারেন। এটা কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানির নীতি থেকে ভিন্ন। বাস্তবে তা-ই হয়েছে। বিভিন্ন দেশ এই পথে এগিয়েছে। ভারতও পিছিয়ে নেই।


হাইপারলুপ পড (Hyperloop Pod) প্রযুক্তির প্রধান স্তম্ভ হল জাপানের এস সি (সুপার কনডাকটিভ) ম্যাগলেভ ট্রেনের, পদার্থের অতি পরিবাহিতা তত্ত্ব কাজে লাগানো। যদিও সেটা বাস্তবায়িত হবে ২০২৭-এ, টোকিও থেকে আগোয়ার পথে। বেশ কিছু পদার্থ অতি নিম্ন একটি নির্দিষ্ট সন্ধি উষ্ণতার নীচে থাকলে তাদের তড়িৎ রোধ শূন্য হয়ে যায়, যে ধর্মকে অতি পরিবাহিতা বলা হয়। তখন তাদের মধ্যে অতি উচ্চ তড়িতপ্রবাহ (একটি সর্বোচ্চ সীমার নীচে) একবার চালু করলেই বিশাল চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়। তখন আর কোন বাইরের উৎসের প্রয়োজন হয় না। উপবৃত্তাকার এই অতি পরিবাহী লুপকে যুক্ত করা হয় হাইপারলুপ যাত্রিবাহী পডে নীচে। আর অতি নিম্ন তাপমাত্রার জন্য তরল হিলিয়াম এবং তরল নাইট্রোজেন কাজে লাগানো হয়। পডের দুই পাশে সারি সারি ইংরাজির 8 আকৃতির পরিবাহী লাগানো হয়। যার নিম্ন অর্ধেকের মধ্যে দিয়ে চলমান পডে যুক্ত লুপের চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন ঘটতে থাকে।

ফ্যারাডের সূত্রানুসারে তড়িচ্চুম্বকীয় আবেশের জন্য, 8 এর নিম্নার্ধে যদি অ্যান্টিক্লক তো উর্ধাংশে ক্লক অভিমুখী আবিষ্ট প্রবাহমাত্রা, উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর সৃষ্টি করে। ফলে নীচে বিকর্ষণ আর ওপরে আকর্ষণের মিলিত ক্রিয়ায় একদিকে উর্ধমুখী বল পডকে ভাসিয়ে রাখে, অপরদিকে সম্মুখগতির সৃষ্টি করে। চুম্বকের মেরু পরিবর্তন-সহ সমগ্র ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রিত হয় কম্পিউটার সফটওয়্যার দ্বারা। সমান্তরাল দুই টিউবের (আসা যাওয়া) মধ্যে প্রায় শূন্যস্থানের মধ্যে দিয়ে পডগুলি যাওয়া আসা করবে। সামান্য কিছু বায়ু রাখা হয় ব্রেক কষার জন্য।


তবে সহজে এটা ব্যাখ্যা করা যায় ঠিকই, কিন্তু এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে প্রযুক্তিগত সমস্যা। বিভিন্ন দেশ জোর কদমে এগিয়ে চলছে। দৌড়ে প্রথমে রয়েছে আমেরিকার ভার্জিন কোম্পানি। মেক্সিকোর মরুভূমিতে ইতিমধ্যে টেস্ট ড্রাইভ সম্পূর্ণ। তাদের দাবি ২০৩০-এ শিকাগো থেকে ক্লিভল্যান্ডের মধ্যে প্রথম হাইপারলুপ পড চালু হবে।
আমাদের দেশেও বিষয়টি শুধুমাত্র লেখালিখির স্তরে নেই। নীতি আয়োগের অন্যতম সদস্য সারস্বত বিষয়টি আয়োগের বৈঠকে উত্থাপন করেছিলেন। তবে তিনি বলেছেন হাইপারলুপ ট্রেন এখনও পরীক্ষানিরীক্ষার স্তরেই রয়েছে। আমাদের দেশে এই মুহূর্তে এর কোনও বাস্তবতা নেই।


কিন্তু “দুঃসাহসী বিন্দু আমি, বুকে বহি সিন্ধুর চেতনা।“ হ্যাঁ। কবির কথার প্রতিধ্বনি তুলে আইআইটি মাদ্রাজের বালাজি রঙ্গস্বামী, অরবিন্দ ভরদ্বাজ, সত্য চক্রবর্তীরা গড়ে তুলেছেন টুটিরের (TuTr) হাইপার লুপ। তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ডিসকভারি ক্যাম্পাসে বিশ্বকে চমকে দিয়ে বানিয়ে ফেলেছেন এশিয়ায় প্রথম মিনি হাইপার লুপ পড (Hyperloop Pod)। যাকে ৪০০ মিটার বায়ুশূন্য টিউবে ১৫০ মিটার/ঘণ্টা বেগে ছুটিয়েছেন। খুব ছোট উদ্যোগ হলেও বহু জটিল প্রযুক্তি কাজে লাগাতে হয়েছে। সুতরাং এটির মহীরুহতে পরিণত হওয়া সময়ের অপেক্ষা।


আরেকটি স্টার্টআপ কোম্পানি কুইনটার্নস, এলন মাস্কের মুক্ত প্রোজেক্ট কাজে লাগিয়ে পুণে- আমেদাবাদ লাইনে হাইপার লুপ ট্রেন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়েছে। সুতরাং সামনের সারিতে না থাকলেও, ভারতে এর চেষ্টা শুরু হয়েছে এবং দৃঢ় পদক্ষেপে এগোচ্ছে। তবে অন্যেরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। আর এর বাস্তবায়নও প্রায় সাফল্যের মুখে। তবে ভারতের মতো দেশে প্রশ্ন উঠবে এর বাণিজ্যিক দিকটি নিয়েও। সেই বাস্তবতাকে কাটিয়ে হাইপারলুপ (Hyperloop Pod) কবে তার স্বপ্নের ডানা মেলতে পারবে, এখন সেটাই দেখার।