(মজে যাওয়া নদী নিজের মর্যাদা হারিয়েছে। অতীতের বিদ্যাধরী আজ লোকমুখে ‘গুমার খাল’। তবে একদিন এই নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল এক প্রাচীন সভ্যতা। আর ভরা নদী দিয়ে দেশবিদেশ পাড়ি দিত বণিকদের নৌকা— শুনিয়েছেন সুকুমার মিত্র)
আমরা কি নিজের ‘বাবা-মা’কে বয়স হলে ‘বুড়ো-বুড়ি’ বলে সম্বোধন করে থাকি? সে শতোর্ধ ‘বাবা-মা’-ও আমাদের সম্বোধনে ‘বাবা-মা’ থেকে যান। তাহলে একসময়ে প্রবল বহমান গুরুত্বপূর্ণ নদী প্রাকৃতিক নিয়মে ব-দ্বীপ গঠনের কাজ শেষে যখন শীর্ণকায়া হয়ে যায়, সেই নদীকে কেন আমরা ‘খাল’ বলে সম্বোধন করি? উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অশোকনগর এলাকায় লোকমুখে ‘গুমার খাল’— সে তো গ্রিক জ্যোতির্বিদ টলেমির বর্ণনায় ‘মেগা’ অর্থাৎ বিশাল। দু’হাজার বছর আগে টলেমি বর্ণিত ‘মেগা’ সে তো ‘গুমার খাল’ নয়- বিদ্যাধরী নদী। এক সময় এই বিদ্যাধরী নাকি ‘দ্বিগঙ্গা’ অর্থাৎ দ্বিতীয় গঙ্গা। দেগঙ্গা নামটি নাকি তার থেকেই এসেছে এমনটাই অনুমান করা হয়। বর্তমানে বিদ্যাধরী বা লোকমুখে গুমার খালের অতল গভীরে যে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল সম্ভারের সন্ধান মিলেছে, তা আরও স্পষ্ট করে যে এসব এলাকা প্রাগৈতিহাসিক যুগে বঙ্গোপসাগরের দখলে ছিল। ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, রাজমহল পাহাড়ের কাছে ছিল গঙ্গার মোহনা। ক্রমশ নদী ব-দ্বীপ গঠনের কাজ সম্পন্ন করতে করতে সমতলের এই বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ গঠন করেছে। আর এই এলাকায় পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ হওয়া কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। থাক সে কথা। এখন এই বিদ্যাধরীর গতিপথ ধরে পিছনের ইতিহাসকে ধরার চেষ্টা করা যাক।
অবিভক্ত ২৪ পরগনার একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী-বিদ্যাধরী। এই নদীর বর্তমান উৎসস্থল নদিয়া জেলার হরিণঘাটা থানার বরগা বিল। সেখান থেকে বর্তমান বিদ্যাধরী নদী বা নোনা গাং উত্তর চব্বিশ পরগনার উপর দিয়ে সুন্দরবনে কালিন্দী- রায়মঙ্গল নদীর সঙ্গে মিশেছে। বিদ্যাধরীর আর একটি শাখা একসময় বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়, গড়িয়া, সোনারপুর ক্যানিং হয়ে মাতলা নদীতে মিশেছে। বস্তুত ত্রিবেণীর পূবদিক দিয়ে হুগলি নদী থেকে যমুনা নদী বহমান হওয়ার বহু আগে বিদ্যাধরীই ছিল হুগলি(গঙ্গা) নদীর নিম্ন অববাহিকার অন্যতম গতিপথ। লেখকের মতে, রায়মঙ্গল ও মাতলা সমায়ান্তরে বিদ্যাধরীর অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৭৮১ সালের রেঁনেলের মানচিত্রে বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ক্যানিং-এ মাতলা নদীর উত্তরাংশে বিদ্যাধরীর একটি ধারা কাশীনাথপুর, মহেশ পুকুরিয়া, প্রতাপনগর হয়ে তাড়দহ, ধাপা বিল-বাঁওড়ের ওপর দিয়ে কলকাতার শ্যামবাজারের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। তাড়দহে টালির নালা বিদ্যাধরীর সঙ্গে মিশেছে। গড়িয়ার পুব দিকে বিখ্যাত তাড়দহে টালির নালা বিদ্যাধরীর সাথে মিশেছে। তাড়দহ এক সময় ছিল গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। অবিভক্ত ২৪ পরগনায় পর্তুগিজদের প্রথম বসতি স্থাপন হয় এই বন্দরকে ঘিরে।
পুরাতাত্ত্বিক পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত, অতুল সুর এবং এম এ জব্বাররা মনে করেন, মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পা থেকেও প্রাচীন বা সমকালীন সভ্যতার অস্তিত্ব পশ্চিমবঙ্গ সন্নিহিত এলাকায় ছিল। উত্তর ২৪ পরগনার বেড়াচাঁপা, চন্দ্রকেতুগড়, হাদিপুর, হাড়োয়া, মিনাখাঁ প্রভৃতি নানা স্থানে প্রাপ্ত বিভিন্নকালের প্রত্নবস্তুগুলি বিস্মৃত অতীতের রহস্য ভেদ করতে সাহায্য করে। যমুনা উৎসমুখ বন্ধ হওয়ার পর হরিণঘাটার বরগা বিলই আপাত ভাবে বর্তমান বিদ্যাধরী নদীর উৎস বলে মনে হয়। বিদ্যাধরী আদিকাল থেকে যমুনার শাখা নদী ছিল— এ মতকে সমর্থন করা যায় না। যমুনা কোনও মতেই বিদ্যাধরীর থেকে প্রাচীন নদী তো নয়ই, বরং সময়ের বিচারে অনেক নবীন। মধ্যযুগের পুঁথিপত্রে যমুনা নদীর উল্লেখ রয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমার বাদুড়িয়া নিবাসী বিপ্রদাস পিপলাই-এর (১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দ) লেখা ‘মনসামঙ্গল কাব্য’ এবং লক্ষণ সেনের সভাকবি ধোয়ীর ‘পবনদূত’-এ যমুনা নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যমুনাকে মোটামুটি ভাবে মধ্যযুগের নদী বলা যায়। ‘রিভারস অব দ্য বেঙ্গল ডেল্টা’ বইয়ে এস সি মজুমদার (১৯৩০) বলেছেন, বিদ্যাধরী যমুনা থেকেই তার জলের ভাগ পেত। স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল (প্রথম খণ্ড)-এর লেখক হান্টার লিখেছেন, ‘The Jamuna is a deep river and navigable throughout the year by trading boats of the largest size.’ ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই নদী দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চলতো। বেড়াচাঁপার চন্দ্রকেতুগড়েই ছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গঙ্গে বা গঙ্গারিডি বন্দর। অধ্যাপক কল্যাণ গাঙ্গুলি এখানে হরপ্পা সমসাময়িক সভ্যতার কথা বিশ্বাস করেন। পুরাতাত্ত্বিক কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামী চার হাজার বছর পূর্বের ক্রিট দ্বীপের পয়ঃপ্রণালীর সঙ্গে চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত পয়ঃপ্রণালীর সাদৃশ্য আছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অধ্যাপক কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামীর কথায়, ‘…This site of Chandraketugarh seemingly represents the ancient market town of Ganga of the Periplus (1st Century A.D) and Gangaridae of Ptolemy (2nd Century A.D)’।
পুরাতাত্ত্বিক এম এ জব্বারের মতে, ‘বালান্দা (হাড়োয়া) ও চন্দ্রকেতুগড়ের সভ্যতা প্রাক হরপ্পা যুগের।’ তিনি ওই সভ্যতাকে আমরি সভ্যতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর মতে, চন্দ্রকেতুগড়ের সভ্যতা নিছক কোনও আঞ্চলিক সভ্যতা ছিল না। সমগ্র ভারতবর্ষ এবং মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া সহ সুদূর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর ব্যাপ্তি ঘটেছিল। নদীর নাব্যতা হ্রাস ও বন্যা বা গতিপথ পরিবর্তন অথবা জলোচ্ছ্বাস বা ভূ-আলোড়নের ফলে ওই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। বালান্দা-চন্দ্রকেতুগড়ের সভ্যতা ছিল নদীকেন্দ্রিক বঙ্গোপসাগরের মোহনার সন্নিকটে গড়ে ওঠা এক সভ্যতা। এম এ জব্বার ১৮৭৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ৯২ নম্বর দলিল এবং অষ্টম এডওয়ার্ডের আমলে ১৯১২ সালের ২৬ মার্চ ১৩৩১ নম্বর দলিলের (যা কিনা বসিরহাটে রেজিস্ট্রিকৃত) কথা উল্লেখ করেন। সেখানে উল্লেখ থাকা ‘হারওয়ার’ এবং ‘হাড়ওয়ার’ নাম দুটি যে হারবার বা পোতাশ্রয় থেকেই এসেছে, সে বিষয়ে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। বলেন, আজকের ‘হাড়োয়া’ প্রাচীনকালের একটি বিখ্যাত নদীকেন্দ্রিক বন্দর ছিল। তাঁর অনুমান, বিদ্যাধরী নদী তীরেই সেই আন্তর্জাতিক পোতাশ্রয় গড়ে উঠেছিল। আন্তর্জাতিক বন্দরটি প্রাচীন ‘গাঙ্গে’ বন্দর বলে তাঁর ধারনা ছিল। হাড়োয়ার খাসবালান্দা গ্রামের এক বিরাট দিঘির পাড়ে একটি অট্টালিকার ধ্বংসস্তূপ আজও রয়েছে। ওই ভগ্নস্তূপে যে দেওয়ালটি আজও টিঁকে রয়েছে, তার গায়ে সাজানো টেরাকোটাগুলি অপূর্ব শিল্প সুষমামণ্ডিত। এর মধ্যে রয়েছে ধর্মচক্র ও সারনাথ মন্দিরের পাথরের মতো কয়েকটি থাম। পুরনো দলিল দস্তাবেজে একে বলা হয়েছে ‘মির খাঁ-র মসিদ বাটী’। এলাকার মানুষের মুখে আজ ‘লাল মসজিদ’ নামে স্থানটি সমধিক পরিচিত। এম এ জব্বার-এর দৃঢ় বিশ্বাস, এটি একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। নদী বিশেষজ্ঞ ড: কল্যাণ রুদ্রের মতে, ‘During the Second Century A.D. Bidyadhari was one of the five important outlets of the Ganga water and carried considerable discharge towards the Sea. Hence Ptolemy named its estuary as ‘Mega’ of Great. Even the large ships from the Mediterranean countries used to visit this part throughout the then juvenile Bidyadhari’.
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, এখানে অর্থাৎ বালান্দায় লেখা হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ‘অষ্টসহস্রিকা শক্তি প্রজ্ঞাপারমিতা’। ওই গ্রন্থটি নেপাল রাজদরবারে রাখা আছে।‘দেগঙ্গা’, নামটির সঙ্গেও যেন বিদ্যাধরীর অতীত স্মৃতি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত।কমলাকান্ত সার্বভৌম রচিত‘দ্বি-গঙ্গা রাজবংশম’ নামের গ্রন্থের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে,
‘ভাগীরথী নদী তীরে দীর্ঘগঙ্গা গ্রাম
সর্বস্থানে দ্বিগঙ্গা বলিয়া ঘুচে নাম
সুন্দর সে গ্রামখানি কী শোভা তাহাতে
সেই গ্রাম আদিসূল দিল রমানাথে।’
সম্ভবত বারাসত মহকুমার এই দ্বিগঙ্গা গ্রাম অতি প্রাচীন স্থান। সেখানে প্রকাণ্ড দিঘি ও ইটের তৈরি ঘরের ভগ্নাবশেষ আজও রয়েছে। ঐতিহাসিক বিভারিজ এই দ্বিগঙ্গাকে বিদ্যাধরী নদীর তীরে এক সুপ্রাচীন সভ্যতার অস্তিত্বের সম্ভাবনা হিসাবে দেখেছেন। অনুমান করা যায়, দীর্ঘগঙ্গা থেকে অপভ্রংশে দেগঙ্গা নামটি এসেছে।
অনুমান করা যায়, এক সময়ে বিদ্যাধরী ছিল ভাগীরথীর শাখা এবং পরবর্তীকালে বিদ্যাধরী মজতে শুরু করলে দক্ষিণ-পূর্বমুখী জমির ঢাল পরিবর্তন হওয়ায় নতুন প্রবাহের সৃষ্টি হয়। এই প্রবাহটি আজ যমুনা নদী নামে পরিচিত। যমুনার উৎপত্তির কালপর্ব থেকে বিদ্যাধরী তার বিশালতা হারাতে শুরু করে। দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে গঙ্গার মূল স্রোত ভাগীরথীকে ত্যাগ করে পদ্মার দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। সে সময় থেকে ভাগীরথী ক্রমেই সংকীর্ণতর হয়ে বর্তমান অবস্থায় পরিণত হয়েছে। মনে করা হয়, ভাগীরথীর শাখানদী বিদ্যাধরী এই কারণেই মজে গিয়ে তাঁর পুরনো মর্যাদা হারিয়ে আজকের অবস্থায় পরিণত হয়েছে।
পড়ে খুব ভালো লাগলো, এত পুরনো সভ্যতার ইতিহাসের কথা ,,,,,, সেই জায়গাটা আমাদের বাড়ির এত কাছে এই ব্যাপারটা মনে করে একটা অদ্ভুত অনুভুতি ,,,,,,,