(রোজকার জিনিস কিনতে অনেক মধ্যবিত্তেরই ঠিকানা ছিল বিগবাজার। সবচেয়ে সস্তার প্যাকেজ খুঁজতে ক্রেতারা চোখ রাখতেন বিগবাজারের বিজ্ঞাপনে। এখন অবশ্য অন্য কারণে শিরোনামে বিগবাজার। নেপথ্যের কাহিনী শুনিয়েছেন সঞ্জয় গুপ্ত)
গুয়াহাটির ভাঙাগড়ে বিগবাজারের পাশ দিয়ে রাজগড়ের রাস্তায় বিকেলে গাড়ি নিয়ে যেতে হলেই বিরক্তি লাগে। কাতারে কাতারে গাড়ি রাস্তা আটকে রেখেছে, বিগবাজারে পার্কিং নেই বলে।
এখন অবশ্য ভাঙাগড়ের স্টোরটি বন্ধ। তবে শুধু যে গুয়াহাটিতে বিগবাজার বন্ধ হয়েছে তা নয়, পুরো ভারত জুড়ে অনেকগুলি জায়গাতেই বিগবাজারে আপাতত তালা ঝুলছে।
ব্যাপারটার শুরু নাকি বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই।
বিগবাজারের মালিকানা স্বত্ব ছিল “ফিউচার” কোম্পানির হাতে। কোম্পানিটি ২০০১ সালে খুলেছিলেন কিশোর বিয়ানি। এই ফিউচার গ্রূপের আওতায় রয়েছে বিগবাজার, ইজি ডে (Easyday) হাইপার সিটি ইত্যাদি।কিন্তু ভারতে রিটেল মার্কেটে ব্যবসার হিসাবে দু’নম্বরে থাকা এই কোম্পানির ব্যবসা ভাল চলছিল না। বাজারে প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকার ঋণ। রিলায়েন্স কোম্পানির সঙ্গে ২০২০ সালে ২৪৭০০ কোটি টাকায় বিগবাজার বিক্রি করে দেওয়ার একটা চুক্তি হয়।
রিলায়েন্স কিনতে চাওয়ার পিছনে কারণ ছিল, তারাও রিটেল ব্যবসায় রয়েছে। কিন্তু ভারত জুড়ে তাদের এতো দোকান নেই। ওদিকে এই কয়েক বছরে সারা ভারতে বিগবাজার ব্র্যান্ডে প্রায় ১৮০০ দোকান রয়েছে ফিউচার গ্রুপের। কিনে নিতে পারলে, এত বছর ধরে যতখানি কাজ করেছে ফিউচার গ্রুপ, যতখানি পরিচিতি পেয়েছে, সেটা অল্পায়াসে চলে আসবে হাতে।
ওদিকে ফিউচার গ্রুপের অবস্থাও খুব খারাপ। বিক্রি হলে দেনাদারদের হাত থেকে বাঁচতে পারে।
ভারতে তৈরি কোম্পানি, কিনছে আরও একটা ভারতীয় কোম্পানি। কিন্তু চুক্তি নিয়ে একটা জটিলতা হয়ে গেল।
জেফ বেজোস ( Jeff Bezos) নামের একজন আমেরিকান ভদ্রলোক ১৯৯৪ সালে সিয়াটেল বলে একটি শহরের একটি গ্যারেজে , ই কমার্স (e-commerce) আমাজন বলে একটি ব্যবসার গোড়াপত্তন করেন। ২০২২ সালে তিনিই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ। তাঁর ” Everything Store” বলে চেইন স্টোর বছরে ১৩৬ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে। তাঁর তৈরি করা আমাজন বছরে ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসা দেয়।
ভারতে তখন বিয়ানি পরিচালিত ফিউচার রিটেল ব্যবসার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৪৩০০০ কোটি টাকা। কিন্তু নগদ টাকার অভাব। ২০১৯ সালে এই আমাজন কোম্পানি, ফিউচার গ্রুপের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। এই চুক্তির বলে, আমাজন, ফিউচার গ্রুপের, ফিউচার কুপন্স বলে শাখা কোম্পানির ৪৯ শতাংশ শেয়ার আর ফিউচার রিটেল গ্রুপের তিন শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। এতে আমাজনের প্রায় ২০০০ কোটি টাকা লাগে। চুক্তির একটা শর্ত ছিল, কোম্পানির প্রমোটাররা শেয়ার বিক্রি করতে চাইলে কয়েক বছর পর করতে হবে, আমাজনের যারা ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী তাদের কাছে বিক্রি করতে পারবে না। শেয়ার বিক্রি করতে চাইলে প্রথম অফার আমাজনকেই দিতে হবে। কিন্তু আমাজন ব্যবসায় টাকা ঢালার পরেও বিগবাজার ব্র্যান্ডের মালিকদের অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটলো না। অথচ ভারতের সাংসারিক নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আর খাবারের অর্গানাইজড বাজারের প্রায় তিনভাগের একভাগের দখল ছিল এই গ্রুপের কাছে। ভারতীয়রা প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার এই খাতে খরচ করে। কিন্তু অনলাইনে বিক্রি হয় এই টাকার মাত্র এক শতাংশ। তবে আশা রয়েছে, কয়েকবছরের মধ্যেই এটা ৯৯ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায় পৌঁছবে।
আমাজনের জন্য একটু অসুবিধা হচ্ছিল, ভারতে বিদেশি কোম্পানিগুলির মালিকানা নেওয়ার নিয়ম অল্প পাল্টে যাওয়ায়। এই নতুন নিয়মের জন্য তাদের বহুকিছু বদল করতে হল। ওদিকে বিগবাজারের পরিচালনায় থাকা ফিউচার গ্রুপের অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। ২০২০ সালে রিলায়েন্স ফিউচার গ্রুপের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২৪৭০০ কোটি টাকায় ফিউচার গ্রুপের পুরো রিটেল ব্যবসা নিয়ে নেবে। ক্রমেই ব্যবসা বাড়ছে রিলায়েন্স কোম্পানির। ভারতের প্রায় সব ক্ষেত্রগুলিতেই তাদের ব্যবসা জমে উঠেছে। তবে এই কয়েক বছরে রিলায়েন্স অনেক বড় বড় কোম্পানিকেই বিপদে ফেলেছে। যেমন রিলায়েন্স জিও-র জন্যে “ভোদাফোন ” আর “আইডিয়া” জোট করতে বাধ্য হয়েছে। মুকেশ আম্বানীর রিলায়েন্স ভারতে প্রথম আনছে 5G টেকনোলজি, সঙ্গে সেটা চালাবার উপযুক্ত যন্ত্র। এমনকি, সোলার এনার্জিতেও অনেক বড় ব্যবসা করছে তারা। “রিলায়েন্স রিটেল” শুরুতেই “আমাজন” আর রাধাকৃষ্ণ দামানির “ডি মার্ট” বলে ভারতে জমিয়ে বসা দু’টি কোম্পানিকে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এর পর যদি বিগবাজার এদের হাতে চলে যায়, তাহলে ভারতের এক নম্বর অবস্থায় পৌঁছনো শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবে ফিউচার গ্রুপ আর আমাজনের চুক্তির একটা শর্ত ছিল, যদি ফিউচার গ্রুপের শেয়ার বিক্রি করতেই হয়, তাহলে প্রথম অফার দিতে হবে আমাজনকে। কোনও অবস্থায় রিলায়েন্সকে বিক্রি করা চলবে না।
(ক্রমশ)