(প্রকৃতির সঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে যোগ, তা নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। ইছামতীকে দেখে তাঁর মনে হতো, এই নদী ঈশ্বরের এক অর্পূব শিল্প।  আর আজ সেই নদীকেই ভাগাড়ে পরিণত করেছি আমরা। ইছামতীর বুকে সেই দীর্ঘশ্বাসের কথা শুনিয়েছেন সুকুমার মিত্র)

কোথায় সেই বিভুতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখা লাবণ্যময়ী ইছামতী। ভারত-বাংলাদেশ জুড়ে বিস্তীর্ণ আন্তর্জাতিক নদীপথ উৎসমুখে জলধারা হারিয়েছে বহু আগেই। গোটা নদীপথ নাব্যতা হারিয়েছে নেই নেই করেও দেড়শ বছর হয়ে গেল। নদীপথে পাটা দিয়ে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ, নদীর বুকেই ঘরবাড়ি, ইটভাটা তা-ও হয়েছে। গ্রাম-গঞ্জ ও মফস্বল শহরের নর্দমার নোংরা জল ও আবর্জনা ফেলার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক এই নদী।

ইছামতী ও বাংলাদেশের পদ্মা থেকে বেরুনো মাথাভাঙা নদী এক ও অভিন্ন। পূব দিকে প্রবাহিত হয়ে ইছামতী নদিয়ার হাঁসখালি ব্লকের মাজদিয়া স্টেশনের পশ্চিমে ১৮৮ নম্বর রেলসেতুর নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের কুষ্ঠিয়া জেলায় প্রবেশ করেছে। ইছা ও মোতি মিলেই নাকি ইছামতী। ইছা অর্থে গলদা চিংড়ি। মোতি শব্দের অর্থ মুক্তা। ইছামতীর তীরে ধীবর ও চুনুরির বসতি ছিল এই কারণেই। মোতির ব্যবসার রমরমা থেকে বনগাঁর মতিগঞ্জ নামকরণ। জনশ্রুতি, এখানকার মোতি বা মুক্তা বিদেশে রফতানি হতো। আজ গলদা চিংড়ি বা মুক্তা তো দূরের কথা— ইছামতীতে তপসে, মৌরল্লা, চাঁদা, পুঁটি, ফলুই, বোয়াল, শোল, ট্যাংরা, বোড়ো মাছের সেই প্রাচুর্য্য নেই। নেই কামোট ও কুমীরের দেখাও।

ইছামতী নিয়ে বিভূতিভূষণের স্ত্রী রমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ। বালিহাঁস-এ প্রকাশিত।

দক্ষিণে ইছামতী কুমীর-কামট-হাঙর সংকুল বিরাট নোনাগাঙে পরিণত হয়ে কোথায় সুঁদরি, গরান গাছের জঙ্গলের আড়ালে বঙ্গোপসাগরে মিশে গিয়েছে, সে খবর বাংলাদেশের যশোর জেলার গ্রাম্য অঞ্চলের অনেক মানুষই রাখেন না। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, ‘ইছামতীর যে অংশ নদিয়া ও যশোর জেলার মধ্যে অবস্থিত, সে অংশটুকুর রূপ সত্যিই এত চমৎকার, যাঁরা দেখবার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা জানেন। কিন্তু তাঁরাই সবচেয়ে ভালো উপলব্ধি করবেন, যাঁরা অনেকদিন ধরে বাস করেছেন এ অঞ্চলে। ভগবানের একটি অপূর্ব শিল্প এর দুই তীর, বনবনানীতে সবুজ, পক্ষী-কাকলীতে মুখর।’ বিভূতিভুষণের দেখা ইছামতী নদী আর আজকের ইছামতীর করুণ চেহারা দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়, কত দ্রুত বদলে গিয়েছে নিম্ন অববাহিকায় বাংলার নদী সমূহের গতিপথ। ইছামতী নদীটির এখন তিনটি অংশ রয়েছে—

দীর্ঘতর অংশটি পদ্মা নদীর একটি শাখা মাথাভাঙা নদী থেকে ২০৮ কিমি প্রবাহিত হবার পর  হাসনাবাদের কাছে এবং বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটার কাছে কালিন্দী নদীর সাথে যুক্ত হয়েছে। নদীটি দৈর্ঘ্যে মোট ৩৭০ কিলোমিটার।

ইছামতীর উৎসমুখ , মাঝদিয়া নদীয়া জেলা

ইছামতী নদীর প্রবাহ বারোমাসি প্রকৃতির। নদিয়া জেলার মাজদিয়ার কাছে মাথাভাঙা দু’ভাগ হয়ে দুটি নদী ইছামতী ও চূর্ণী নামে প্রবাহিত। আসলে মাথাভাঙা নদীরই নিম্নাংশ ইছামতী নদী। মাজদিয়া থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার ভারতের ভিতর প্রবাহিত হয়ে ইছামতী মুবারকপুরে এসে চলে গেছে বাংলাদেশের ভেতর। প্রায় ৩৫ কিমি পথ বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়ে ফের নদিয়ার হাঁসখালি ব্লকের দত্তফুলিয়ায় প্রবেশ করেছে ভারতের ভিতর। তারপর নদীটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমারেখা তৈরি করেছে যা উত্তর ২৪ পরগণার গাইঘাটার আংরাইল থেকে কালাঞ্চি ও নিম্নাংশে কালিন্দী-রায়মঙ্গল, হাড়িয়াভাঙা হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। ইছামতী  বসিরহাট, ইটিণ্ডা, টাকি, হাসনাবাদ এসে ফের দু’ভাগে প্রবাহিত হয়েছে। একটি ভাগের নাম ডাসা, যা সন্দেশখালির কাছে বিদ্যাধরী নদীর সঙ্গে মিশে রায়মঙ্গল হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। অন্যভাগের নাম কালিন্দী যা গৌড়েশ্বর শাখানদী হয়ে সন্দেশখালির মঠবাড়ির কাছে দু’ভাগে ভাগ হয়ে বিদ্যাধরী-রায়মঙ্গল এবং আর একটি শাখা কালিন্দী নাম নিয়েই রায়মঙ্গল তারপর হাড়িয়াভাঙা হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। আগে মাথাভাঙার অধিকাংশ প্রবাহিত জল কুমার, চিত্রা, কবদুক (ভৈরব) ও ইছামতীতে প্রবাহিত হতো। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আগে এই অঞ্চলের নদীগুলো দক্ষিণ-পূর্ব অভিমুখে প্রবাহিত হত, কিন্তু  জলঙ্গী ও মাথাভাঙ্গা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়েছে। স্থানীয় ভূ-ঢাল পরিবর্তনের জন্য সম্ভবত এটি ঘটেছে। ফলে ইছামতী উৎসমূখে মাথাভাঙার মাধ্যমে সারা বছর জলপ্রবাহ থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করে।

অতীতের ইছামতী ও গরাইল নদীর সংযোগস্থল।

চূর্ণী নদী না খাল? এই নিয়েও রয়েছে বির্তক। ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ সরকার মাথাভাঙার পশ্চিম দিক থেকে চূর্ণী কেটে ইছামতীর জলে ভাগ বসানোর পর থেকেই ইছামতী উৎসমুখে জল প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করে। পশ্চিমের এই শাখা চূর্ণী আড়ংঘাটা, কালীনারায়ণপুর, রাণাঘাট হয়ে চাকদহের কাছে হুগলি নদীতে মিশেছে। কথিত আছে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর প্রজা ও ভক্তদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ও ভাগীরথীতে জলপ্রবাহ বাড়াতে এই খাল খননের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

নদিয়ার মাজদিয়ার কাছে পাবাখালি মৌজায় ১৮৮ নম্বর রেল ব্রিজ তৈরির সময়ে নদীর মধ্যে বোল্ডার ফেলে বাঁধ দেওয়ায় মাথাভাঙা ও ইছামতীর মিলনস্থল কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে প্রায় ১০ কিলোমিটার নদী পথে চড়া পড়ে যায়। মাজদিয়া থেকে বনগাঁ পর্যন্ত প্রায় একশো কিলোমিটার ইছামতী নদীখাত হাজামজা ছাড়া আর কিছুই না। বনগাঁ পেট্রাপোলের উত্তরে ইছামতীর সঙ্গে মিশেছে বাংলাদেশের মকর নদী। আরও কিছু উত্তরে কোদালিয়া বনগাঁ দিয়ে ঢুকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বেতনা নদী পশ্চিমদিক থেকে এসে গাঙ্গুলিয়া ও মুস্তাফাপুর পেরিয়ে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে।

ইছামতীর নিম্ন অববাহিকার ১৫০ কিলোমিটার অংশে জোয়ার-ভাটার প্রভাব রয়েছে। পাঁচ দশক আগেও ইছামতীতে জোয়ারের জল ঠেলে একসময় বনগাঁ পর্যন্ত যেত। এখন গাইঘাটার রামনগর অঞ্চলের বেড়িগোপালপুর পর্যন্ত কোটালে বঙ্গোপসাগরের জল প্রবেশ করে থাকে। জোয়ারের স্রোত চার ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৮-৯ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিবেগে প্রবেশ করে। আর পরবর্তী প্রতি ঘণ্টায় ৪-৫ কিলোমিটার গতিবেগে ভাটায় ফিরে যায়। ফলে জোয়ারে যে পরিমাণ পলি প্রবেশ করে ভাটায় গতিবেগ হ্রাস পাওয়ায় তা ফিরে যেতে পারে না। চলে আসে পরের জোয়ার। আর এই কারণেই ইছামতীর বুকে দ্রুত পলি জমতে শুরু করে। এই ভাবে নিম্নাংশে নদীর নাব্যতা বিনষ্ট হচ্ছে। ইছামতীকে ফের আগের মতো স্রোতস্বিনী করা কোনও মতে সম্ভবপর না। চূর্ণীর জল ইছামতীতে ফেলার চেষ্টা রাজ্য সরকারের সেচ দফতর নিলেও সে চেষ্টা কার্যকরী হয়নি। নদীতে অবিরাম জলপ্রবাহ না থাকলে সেই নদীকে বাঁচিয়ে তোলা কোনও মতেই সম্ভব হয় না। আর এই কাজ বাস্তবায়িত করতে হলে বাংলাদেশ থেকে মাথাভাঙার মাধ্যমে পদ্মার জলকে ইছামতীতে আনতে হবে। পাশাপাশি নিম্নাংশে ইছামতীকে বহমান রাখতে হলে প্রয়োজন জোয়ার-ভাটা প্রভাবিত অংশে পলি উত্তোলনের কাজ নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া। নতুবা ইছামতী অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকার নিকাশি সমস্যাজনিত কারণে ফি বছর বন্যা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।