নরেন্দ্রনাথ দত্ত যে বছর সন্ন্যাস নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে ওঠেন, সে বছরেরই প্রথম দিকে তিনি চাকরি পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর মশাইয়ের মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউশনের বৌবাজার শাখায়। সেটা ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর ছাত্রজীবনও কেটেছিল ওই স্কুলেই। বিদ্যাসাগরের বদান্যতায় শিক্ষকতা জুটেছিল বটে, কিন্তু সে চাকরি মাসকয়েকের বেশি স্থায়ী হয়নি। তাঁকে অচিরেই বিদায় নিতে হযেছিল। কেন সে চাকরি নরেন্দ্রনাথের বরাতে সইল না, তা নিয়ে রয়েছে একাধিক গল্প।
একটি গল্পে নরেন্দ্রনাথ ক্লাসে পাঠ্য বিষয় না পড়িয়ে পাঠ্য-বহির্ভূত নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। তা নিয়ে নানান সমস্যা তৈরি হয়েছিল। আবার কারুর মতে, তিনি পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে এতটাই বিড়ম্বিত ছিলেন যে নিয়মিত স্কুলে হাজিরা দিতে পারতেন না। সেই কারণেই তাঁর পক্ষে চাকরি টিঁকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
যে গল্পটি বহুল প্রচারিত, সেটি হল, নরেন্দ্রনাথ শিক্ষক হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ছাত্রদের মধ্যে। তাঁর এই জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিত্ব স্কুলের সম্পাদকের পক্ষে হজম করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। বিদ্যাসাগরের জামাই সূর্যকুমার অধিকারী ছিলেন এই স্কুলের সম্পাদক। তাঁর দাপটে সবাই তটস্থ হয়ে থাকতো। স্বভাবতই নরেন্দ্রনাথ তাঁর চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। অবশেষে তিনিই কলকাঠি নেড়ে তাঁকে বিতাড়নের বন্দোবস্ত করেন। ফার্স্ট ও সেকেণ্ড ক্লাসের ছেলেদের দিয়ে অভিযোগ করানো হয় যে শিক্ষক হিসেবে নরেন্দ্রনাথ দক্ষ নন। তিনি ঠিকমতো পড়াতে পারেন না। এই অভিযোগকে হাতিয়ার করে সূর্যকুমার বিদ্যাসাগরের কাছে নরেন্দ্রনাথকে বরখাস্তের সুপারিশ করেন। সম্পাদকের রিপোর্টের ভিত্তিতে বিদ্যাসাগর আদেশ করেন, ‘তাহলে নরেনকে বল আর যেন না আসে’।
এই ঘটনাগুলির মধ্যে কোনটি প্রকৃত কারণ বলা কঠিন। তবে শেষোক্তটিই যৌক্তিক ভাবে বেশি মান্যতা পেযে থাকে। সূর্যকুমার যে মানুষ হিসেবে খুব সদাশয় ছিলেন না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ, বিদ্যাসাগরের জামাই হওয়া সত্ত্বেও কোনও গুরুতর অপরাধে তিনি বিশ্বাসযোগ্যতা হারান অচিরেই। ফলত, বিদ্যাসাগরের স্কুল থেকে তাঁকেও বিদায় নিতে হয়। নরেন্দ্রনাথের চলে যাওয়ার বছর দুই বাদেই, ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর তাঁকে সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করেন।
শিক্ষক হিসেবে নরেন্দ্রনাথের ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলেও, ওই স্কুলে ছাত্রাবস্থায় নরেন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরের যথেষ্ট স্নেহ পেয়েছিলেন। একদিন ক্লাসঘরের ভেতরেই কোনও ঘটনায় ক্লাসশুদ্ধ সব ছেলেরা হই হই করে হেসে ওঠে। নরেন্দ্রনাথও ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। শিক্ষক ক্ষিপ্ত হযে নরেনের কান মুলে দিতে শুরু করেন। কান থেকে টপ টপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকে। শিক্ষকের আদেশে বইপত্র নিয়ে নরেন ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতেই বিদ্যাসাগর মশাই সেখানে উপস্থিত। ক্লাসে ঢুকে তিনি জানতে চাইলেন কী হয়েছে। সবিস্তার শোনার পর রাগে ফেটে পড়লেন বিদ্যাসাগর। শিক্ষকের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি জানতাম তুমি একজন মানুষ। এখন দেখছি, তুমি একটা পশু’।
পরবর্তী জীবনে তিনি স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে উঠেছিলেন বলেই তাঁর বরখাস্ত হওয়ার ঘটনার যাবতীয় দায় আজকের জনমত অনুযায়ী বিদ্যাসাগরের ওপর বর্তায়। অন্যথা, আরও এরকম বহু ঘটনার মতোই এটি হারিয়ে যেত। সে আমলের নিয়ম অনুযায়ী, সম্পাদকের সুপারিশ মতোই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। এভাবে অঢেল শিক্ষক সে যুগে চাকরি খুইয়েছেন। তবে বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে দেখলে এ কথাই মনে হবে যে ঘটনাটিতে শাপে বরই হয়েছিল। শিক্ষকতায় বহাল থাকলে নরেন্দ্রনাথের বিবেকানন্দ হয়ে ওঠা হয়তো কোনও দিনই হতো না। যেমন লন্ডনে আইন পড়া শিকেয় তুলে দেশে ফিরে না এলে আমরা ব্যারিস্টার রবীন্দ্রনাথকে পেতাম, কবিগুরুকে নয়।