রবীন্দ্রনাথ তখন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজেরই স্কুল বিভাগের ছাত্র। বছর ১৪ বয়স। ছেলেবেলা পেরিয়ে বয়ঃসন্ধিতে পা রেখেছেন ইতিমধ্যে। কিন্তু ইস্কুলের চার দেওয়ালে মন না-বসার পুরোনো রোগ এখানেও সঙ্গী। ক্লাস শেষে কপি করার জন্য রুটিনে আধঘণ্টা বরাদ্দ। কিশোর রবি যথারীতি কলম হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক। কিছুই লেখেননি, খাতা ফাঁকা। তেমনই একটা ক্লাসের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন ফাদার ডি পেনারান্ডা। অত্যন্ত পণ্ডিত মানুষ। কিন্তু ছাত্রদের মনোযোগ আকর্ষণে ব‍্যর্থ। একে তো স্প্যানিস বলে ইংরেজি উচ্চারণ তেমন ভাল নয়, তার উপর দেখতে-শুনতেও একটু কেমন যেন! অথচ তাঁর কথা রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন মনে রেখেছেন। কেন? কারণ, সেদিনের ক্লাসে আনমনা রবির পিঠে হাত রেখে ফাদার পেনারান্ডা সস্নেহে জিজ্ঞেস করছেন, “টাগোর, তোমার কি শরীর ভাল নাই?” ছাত্র রবীন্দ্রনাথের জীবনে এ এক বিরলতম অভিজ্ঞতা, শিক্ষক রবীন্দ্রনাথকে ভবিষ্যতের দিশা দেখাচ্ছে যা।

খুব খুঁটিয়ে দেখলে ঘটনাটা সাধারণ। কথাটুকুও সামান্য। অথচ প্রথাগাত শিক্ষার আঙিনায় এই সামান্য আর স্বাভাবিক আচরণের অভাব বড্ড প্রকট। সমাজের সব পরতেই যে অসহিষ্ণুতা আর অবিশ্বাসের বাতাবরন, তা ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রেও। পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম, আর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ– আনত হওয়া আর আগলে রাখার গুরুশিষ্য পরম্পরা আজ বড্ড সেকেলে। বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় একে অপরকে আড় চোখে মাপাটাই ট্রেন্ডিং। আর ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্রমবিকৃতিই ভবিতব্য। তাই দলিত হয়ে জলের পাত্র ছোঁয়ার ‘অপরাধে’ ছাত্রকে পিটিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন শিক্ষক। প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলার ‘গুরুতর দোষে’ তিন বছরের বাচ্চার শিশ্ন পুড়িয়ে দিতে হাত কাঁপে না শিক্ষিকার। আসে পাল্টা অভিঘাতও। শিক্ষককে গাছে বেঁধে পিটিয়ে অঙ্কে ফেল করার আক্রোশ মেটায় ছাত্র। গণ টোকাটুকি রুখতে চাওয়ার চেষ্টায় জোটে লাশ ফেলে দেওয়ার হুমকি। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে পারস্পরিক অনাস্থা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে, ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষাঙ্গনেও বন্দুকবাজ ছাত্রের হামলা বোধহয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু গুরুশিষ্য সম্পর্কের এই মর্মান্তিক পরিণতির দায় কার?

“আমরা বাপু এমনটি ছিলেম না” বলে অথরিটি-ইন-পার্সন দায় এড়িয়ে যান সহজেই। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে দেখলে স্কুল-কলেজে কর্তৃত্ব ফলানোর অধিকার কিন্তু শিক্ষকের। মেরুদণ্ড বিকিয়ে না গিয়ে থাকলে, নিজের কাজের প্রতি দায়বদ্ধ থাকলে এর অন্যথা হওয়ার কথা নয়। তলিয়ে ভেবে দেখুন তো, আপনার শিক্ষকরা ঠিক কী রকম ছিলেন? আর আপনার প্রথম গুরু মা-বাবা কিংবা পরিবারের অভিভাবকরাই বা কেমন ছিলেন? বিশ্বাস করুন, মেলাতে পারবেন না তাঁদের সঙ্গে নিজেকে। সে আপনি শিক্ষক কিংবা অভিভাবক যে-ই হোন না কেন। এই ভারতবর্ষেই এক কালে গুরুগৃহে  দিনের পর দিন থেকে শিক্ষা লাভ করত শিক্ষার্থী। গুরু আর গুরু মা তখন অভিভাবক। মা-বাবা নিশ্চিন্তে সঁপে দিতেন সন্তানকে তাঁদের কাছে। কালে কালে সবই বদলালো। শিক্ষক আর এখন অভিভাবক নন। বেতনভুক প্রজাতি বিশেষ। তাঁর কাজ ক্লাস নেওয়া, সিলেবাস শেষ করা, কাছা খুলে নম্বর দেওয়া। আর অবশ্যই পাস করিয়ে দেওয়া। তাতে যদি পরীক্ষার্থীর মতো একই কালির পেন দিয়ে দু-চারটে উত্তরে টিক মেরেও দিতে হয়, কুছ পরোয়া নেহি।  ছাত্র মানুষ করা আর শিক্ষকের কাজ নয়। অতএব সেই ছোট্টবেলা থেকে বাচ্চারা এটা জেনেই বড়ো হয়—‘‘স্যর-ম্যাডামরা বড্ড বাজে। খালি পার্সিয়ালিটি করে। ঠিক করে কিচ্ছু পড়াতে পারে না।” সৌজন্যে আমার-আপনার মতো হোয়াটস্যাপ অভিভাবক।

ছোটোবেলায় ইস্কুল থেকে দিদিমণি মা-বাবাকে ডেকে পাঠালেই বাড়িতে জেরা শুরু “সত্যি করে বল কী করেছিস, নইলে আজকে মেরেই ফেলব।” এখনকার  ছবি, “মাম্মা জানো আমি কিছু করিনি, তা-ও ম্যাডাম মিথ্যে মিথ্যে বলছে।” বিশ্বাস করুন, এই হিম্মত ছিল না। ভাগ্যিস! এই বাচ্চাগুলোই যখন বড়ো হয়ে আরেকটু বড়ো ইস্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রাখছে, তখন তাদের কাছে কী প্রত্যাশা করতে পারি আমরা ? কিংবা আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যখন এরাই শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে, কেমন হবে তাদের আচরণ? আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রটির আচরণ নিন্দনীয় নিশ্চিত। কিন্তু কোনো সমাজ-বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একান্তে কান পাতুন টিচার্স রুমের বন্ধ দরজার বাইরে, কোনও বিশেষ শিক্ষার্থীর জন্য বাছা বাছা বিশেষণ ব্যবহৃত হতে শুনলে অবাক হবেন না যেন। শুধু তো দিদিমণির সাঁতার পোশাক নয়, ছাত্রীর লিপস্টিকের রংও কিন্তু সমান মুখরোচক আলোচনার বিষয়। এতে অবশ্য মেয়েটির ছাত্রিত্ব খণ্ডিত হয় না। তবে দিদিমণির চাকরি নিয়ে টানাটানি হতেই পারে।

তবে এতো অন্ধকারের পরেও অনেকটা আলোর সম্ভাবনা জিইয়ে রাখেন কিছু মানুষ। তাঁরা জাত শিক্ষক। কচি হোক বা ধেড়ে, আজীবন ছেলেমেয়েদের বুক দিয়ে আগলে রাখার অঙ্গীকার করেন নিঃশব্দে। জ্ঞান নয়, তত্ত্ব নয়, পাণ্ডিত্য নয়, শুধুমাত্র ভালবাসার জিয়নকাঠিকে সম্বল করে খুঁজে নেন ছেলেমেয়েদের প্রাণভোমরা। তাদের মানুষ করে তোলার সযতন প্রয়াসে ঘাটতি থাকে না এতোটুকু। এই যে আগলে রাখা, সবটুকু উজাড় করে দেওয়া এতটুকু বিফলে যায় না। ছেলেমেয়েরাও ভরিয়ে দেয় শ্রদ্ধা আর পাল্টা ভালবাসায়। শিক্ষকের উপর ভরসা ফেরে ছাত্রছাত্রীর বাড়ির লোকজনের। শিক্ষকই আবার হয়ে ওঠেন সকলের অভিভাবক। গোটা পাড়ার। আস্ত একটা জনপদের। এক্ষেত্রেও তিনি অথরিটি-ইন-পার্সন। তবে এই কর্তৃত্ব পদাধিকার বলে অর্জিত নয়। এ হল নিখাদ ভালবাসার জোর। তেমন মানুষের বদলির অর্ডারে গোটা পাড়াটাই ছেলেমেয়েদের সাথে পথে নেমে আসে। চোখের জল বাঁধ মানে না দুতরফেই।

দুটো ছবির কথা মনে করিয়ে দিয়ে শেষ করব। একদল মানুষ ছাত্রছাত্রীদের চূড়ান্ত আগ্রাসনের মুখে দরজায় খিল তুলে মিটিং করেন। অবাধ্য, একগুয়ে, লাগামহীন রাজনীতির রং লাগা ছেলেমেয়েগুলোর হাত থেকে কীভাবে ক্যাম্পাসকে সুরক্ষিত রাখা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকে। আর একদল মানুষ ব্যস্ত রাস্তায় হাতে হাত রেখে ব্যরিকেড তোলেন ছেলেমেয়েদের কোনো একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের দুষ্কৃতীদের হাত থেকে বাঁচাবেন বলে। প্রথম দলের মানুষ পদাধিকার বলে শিক্ষক। এঁরা ছাত্রসমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেন। পেপার লেখেন। পাণ্ডিত্য-প্রোমোশন সুনিশ্চিত করেন। আর পাঁজি দেখে কেলাসে যান। দ্বিতীয় দল ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকান। পিঠে হাত রেখে জানতে চান “কী হয়েছে, শরীর খারাপ? নাকি মন?” চোখে চোখ রেখে ঠিক ভুলের পাঠ দেন। এঁরা জাত শিক্ষক। বিরল হলেও হারিয়ে যাননি। যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঘুণ ধরা ভিতটাকে আজও বুক দিয়ে আগলে রাখেন এই জাত শিক্ষকরা। তাঁদের জন্যই সমস্ত নেতির পরেও আশা জেগেই থাকে। ক্যালেন্ডারে আজ শিক্ষক দিবস। আসলে তো প্রতিটা দিনই কিছু না কিছু শিখিয়ে যায়।

4 COMMENTS

  1. Ashadharon laglo…satti guru shishyer samporko ta aste aste kemon jeno khin hoye jache…tabuo tomader moto kichu teacher er jiyon kathir choyay asha ta dhore rakhte pari.

  2. ভালো লাগলো। শিক্ষকতা যে শুধু পেশা নয় এই বোধটা আমাদের trainee teacher রা যদি উপলব্ধি করতে পারে তাহলে হয়তো তারা শিক্ষার্থীদের সাথে একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করবে, যা এখন দুর্লভ।

  3. খুবই ভাল লেখা এবং বর্তমানের শিক্ষা ব‍্যাবস্থা ভাল ভাবেই ফুটে উঠেছে।

Comments are closed.